ভূমিকা: এক অসাধারণ সৌন্দর্যপটের নাম বাংলাদেশ। প্রকৃতির মায়া মমতা যার আপন বৈশিষ্ট্য। যে দেশকে বিধাতা সাজিয়েছেন তাঁর আপন মনের মাধুরী মিশিয়ে, সুচারুরূপে, বর্ণাঢ্য করে। সে দেশর নাম বাংলাদেশ। যে দেশের সৌন্দর্যের মাঝে নেই কোন কৃত্রিমতার ছোঁয়া, আছে কেবল প্রগাঢ় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সমারোহ, সে দেশর নাম বাংলাদেশ। নিসর্গ যে দেশের অলংকার, প্রকৃতি যে দেশের রূপ সুষমার মূল উপকরণ, সে দেশেইতো বাংলাদেশ। অপূর্ব সৌন্দর্যে শস্য-সম্পদে আর প্রকৃতিক বৈচিত্র্যে ভরা এমন দেশ পৃথিবীতে আর একটিও নেই। এদেশে জন্মেছি আমি। আমি ধন্য। আমি তৃপ্ত। এ-বাংলার রূপে বিমুগ্ধ কবি আবেগে উদ্বেলিত হয়ে তাই গেয়ে ওঠেন-
“ধন ধান্যে পুষ্পে ভরা,
আমাদের এই বসুন্ধরা,
তাহার মাঝে আছে দেশ এক
সকল দেশের সেরা;
ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ,
স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।”
বাংলার সীমা ও ভূ-প্রকৃতি: ত্রিশ লক্ষ মানুষ যে দেশের জন্য জীবন দিতে পারে, সে দেশ কি যেই-সেই দেশ। সাড়ে সাত কোটি মানুষ দেশপ্রেমে উদ্বেলিত হয়ে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর অর্জন করে স্বধীন বাংলাদেশ। এ বাংলাকে ঘিরে উত্তর দিকে রয়েছে পশ্চিমবঙ্গের শ্যমলিমায় জলপাইগুড়ি ও কুচবিহার, উত্তর-পূর্বদিকে আসামের পর্বতময় অঞ্চল, পূর্বে বৈচিত্র্যময় দেশ বার্মা, পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গ ও বিহারের সমভূমি আর সর্বদক্ষিণে রয়েছে চির প্রবহমান বঙ্গোপসাগরের শীতল জলধারা।
বাংলার সৌন্দর্য:
“বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছিতই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে চাই না আর।”
গ্রাম বাংলার রূপে বিমুগ্ধ রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশের এ স্বীকারোক্তিতেই প্রতীয়মান হয় বংলার গ্রামীণ সৌন্দর্য। গ্রামকে বাদ দিয়ে বাংলার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কোন চিহ্নসূত্রই থাকবে না। গ্রাম প্রধান দেশ আমাদের এই বাংলাদেশ। তই বাংলার যে দিকে দৃষ্টিপাত করি না কেন চোখে পড়ে শ্যামল শোভাশয় সবুজ অরণ্যানী। কোখাও বা মাঠের পর মাঠ আর সোনালি পাকা ধানের শোভা দৃশ্যমান। সেই ধানের ক্ষেতে যখন মৃদুমন্দ হাওয়া বয়ে যায়, তখন নাবযৌবনা কুমারীর মতই কলহাস্যে নেচে দুলে ওঠে সেই স্বর্ণ রূপিনী ধানের ক্ষেত। কোখাও আবার সারি সারি তাল-নারিকেল-খেজুরের বনানী, কোথাও বা সুজচ্চ বটবৃক্ষ মৌন তপস্যায় মাথা উঁচু করে ঊর্ধ্বপানে তার বাহু প্রসারিত করে আছে আর অকৃপণভাবে স্নেহশীতল ছায়া দান করছে দূরদূরান্ত থেকে আগাত পথিককে। কোখাও বা রাখাল ছেলে গরু-মেষগুলোকে চরাতে দিয়ে কোন সুশীতল তরু মূলে বসে বাঁশিতে তুলছে মেঠো সুর। বাংলার এসব দৃশ্য যুগে যুগে তার সন্তানদের করেছে বাউল, কবি, গল্পকার, চিত্রকার। বাংলার এ রূপ দৃষ্টেই কবিগুরু গেয়েছিলেন-
“অবারিত মাঠ গগন ললাট চুমে তব পদধূলি,
ছায়া সুনিবিড় শান্তির নীড় ছোট ছোট গ্রামগুলি।”
গ্রীষ্মে: এখানে গ্রীষ্ম আসে সূর্যের প্রচন্ড দাবদাহ নিয়ে। গাছে গাছে পেকে ওঠে আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল প্রভৃতি ফল। মাঠ-ঘাঠ-প্রান্তর, জনজীবন সবকিছুই এ সময় মেতে ওঠে। প্রখর তাপদাহে জীবধাত্রী ধরিত্রীর বক্ষ বিধীর্ণ হয়ে যায়, চৌচির হয়ে যায় তার তৃষ্ণার্ত প্রান্তর। তাইতো কবি বলেছেন,
‘ঘাম ঝরে দর দর গ্রীষ্মের দুপুরে
মাঠ-ঘাট চৌচির, জল নেই পুকুরে।’
বর্ষায়: গ্রীষ্ম বিদায় নেয় বর্ষার আগমনের সাথে সাথে। আষাঢ়ের জলধারা বাংলার প্রকৃতিকে দেয় চির সবুজ করে। খাল-বিল-নদী-নালা পানিতে থৈ থৈ করে তখন। কদম্ব, যুঁথী, কেয়া। কবি গেয়ে ওঠেন-
“নীল নবঘনে আষাঢ় গগনে
তিল ঠাই আর নাহিরে
ওগো আজ তোরা যাসনে গোতোরা যাসনে ঘরের বাহিরে।”
শরতে: এর পর ধীরে ধীরে বর্ষার অবসান ঘটে এবং শরৎ তার শুভ্র জ্যোৎস্না ও পুষ্প সুষমা নিয়ে আগমন করে। বর্ষার নিপীড়িতা ধরণী আবার পুলকিত হয়ে ওঠে। শশীর উজ্জল কিরণে কি কাশবন, কি বনের বৃক্ষশীর্ষ, কি গৃহচূড়া, কি নদীর নির্জন বৃক্ষ সমস্তই হাস্যময়ীরূপ ধারণ করে। শরৎকালে শেফালী, কামিনী প্রভৃতি ফুল প্রস্ফুটিত হলে সৌন্দর্য সৌরভে সবাইকে মুগ্ধ করে। এ সময় কবি গেয়ে উঠেন-
“এবার অবগুণ্ঠন খোল
গহন মেঘ-মায়ায় বিজন বন ছায়ায়
তামার আঁচলে অবগুণ্ঠন সারা হল
শিউলি সরভি রাত বিকশিত জোচনাতে
মৃদু মর্মর গানে তব মর্মের বাণী বোলো।”
হেমন্তে: বাংলার মানুষের জীবনে নব আশার সঞ্চার করে প্রকৃতিতে এবার আগমন ঘটে পাকা ধানের গন্ধে মাতাল করা হেমন্তের। শস্যক্ষেত্র ধারণ করে এসময় হরিদ্রাবর্ণ, রাত্রিতে শিশির পড়ে ভিজিয়ে দেয় সতেজ ঘাসের ডগা। ভোরে সেই ভেজা ঘাসের ওপর ঝরে পড়ে শিউলি ফুল।
শীতে: গাছপালাকে শ্রীহীন করে, বিবর্ণ করে দিয়ে, এরপর প্রকৃতিতে ঝেঁকে বসে শীত বুড়ি। অবশ্য শীতে বাংলার প্রকৃতি পায় এক ব্যতিক্রমী সৌন্দর্য। চারদিকে সাদা কুয়াশার চাদর, ভোরে খেজুর রস পাড়ার দৃশ্য, নাড়ার আগুনে শিম পোড়ানো এ সবের মধ্যেই আছে এক স্বতন্ত্র আনন্দ।
ঋতুরাজ বসন্তে: সবশেষে প্রকৃতিরাজ্যে আগমন ঘটে ঋতুরাজ বসন্তের। গাছ-পালা নব পল¬বে সুশোভিত হয়ে ওঠে, ফুলে ফুলে মধুমক্ষিকার গুন গুন তান, গাছে গাছে কোকিলের গান মুখরিত হয়। রাতে জ্যোৎস্না ধারার মাঝে মন কেমন করে ওঠে। হৃদয় ফুঁড়ে বেরোয় গান-
“আজ জ্যোৎস্না রাতে সবাই গেছে বনে,
বসন্তের এই মাতাল সমীকরণে।”
“কোন বনেতে জানিনে ফুল,
গন্ধে এমন করে আকুল।
কোন গগনে উঠেরে চাঁদ এমন হাঁসি হেসে,
আঁখি মেলে তোমার আলো
দেখে আমার চোখ জুড়ালো;
ঐ-আলোতেই নয়ন রেখে মুদবো নয়ন শেষে।”
4 comments