ভূমিকাঃ পূর্ব দিগন্তে তখনও আলোর সুরমা পরিপূর্ণরুপে ফুটে উঠে নি । অথচ বনে বনে পাখিদের হৃদয়ে তার গোপন সংবাদ সবার অলক্ষ্যে ছড়িয়ে পড়েছে । বনান্তরালে তাদের মধুর কণ্ঠে ধ্বনিত হয়ে উঠলো দিবারম্ভের কল মুখরিত আনন্দ রাগিনী । এখনই পূর্ব দিগন্তে রাখালের বেশে আবির্ভূত হবে সকাল স্নিগ্ধ শীতল শীতের সকাল । তাকে স্বাগত জানাতে বনে বনে পাখির কণ্ঠে উঠেছে মধুর আহব্বান গীতি । তাদের শিশির সিক্ত কণ্ঠে আনন্দের অনবদ্য জোয়ার লাগল । কুয়াশা জড়িত বনভূমি প্লাবিত করে তাদের কলমধুর গানের সুরলহরী ছড়িয়ে পড়ল দিক দিগন্তে । আর বিলম্ব বেশী নেই । স্বল্প সময়ের মধ্যেই কুয়াশার জাল ছিন্ন ভিন্ন করে আমাদের দ্বারে এসে দাঁড়াবে আলো ঝলমল একটি পরিপূর্ণ সকাল ।
সূর্যোদয়ের পূর্বে শীতের সকালঃ লেপের তলা থেকে উঠি উঠি করেও উঠতে ইচ্ছে করে না; শিয়রে হিংস্র শীত কেশর ফুলিয়ে থাবা পেতে বসে আছে । গরম বিছানার স্বচরিত উত্তাপ ছেড়ে উঠতে গেলে কেমন এক দুর্নিবার আলস্য সমস্ত চেতনা ঘিরে ধরে । তন্দ্রা বিজড়িত চেতনায় দূর বনান্তরালে পাখিদের কল কুজন শোনা যায়, আর শোনা যায় পথচারীদের বাতাসে ভেসে আসা দু-একটি বিচ্ছিন্ন সংলাপ । অথচ, চারিদিকে পৃথিবী এক আশ্চর্য নিস্তব্ধতায় মগ্ন । এক সীমাহীন বিষণ্ণতা ও বৈরাগ্যে সকলের হৃদয় কানায় কানায় ভরে উঠেছে । শূন্যতাই বুঝি তার সঠিক পরিচয় । শীতের সকালে তাই এক নিঃসঙ্গ জড়তা পড়ে থাকে এবং কল্পনা করতে পারে । শীতের বুড়ি কুয়াশার কম্বল গায়ে দিয়ে আগুন পোহাবার জন্য শুকনো পাতা কুড়াতে বনের ভিতর দিয়ে কাঁপতে কাঁপতে চলেছে ।
শীতের সকালে ভাবরূপঃ পূর্ব দিগন্তে ধীরে ধীরে আলো ফুটতে থাকে । উত্তর দিক হতে হিমগর্ভ ঠান্ডা বাতাস একটি দীর্ঘশ্বাসের মতো হঠাৎ শিরশির করে বনের গাছগুলোর ফাঁক দিয়ে যায় । টুপটাপ করে শিশির ঝরে পড়ে । বনের পথ শিশির সিক্ত হয়ে উঠেছে । টিনের চালে এবং ঘাসে ঘাসে শিশির বিন্দু জমে ভোরের আলো ঝলমল করছে । দূরে কোথাও খেজুর রস জ্বাল দেওয়া হচ্ছে । বাতাসে তার লোভনীয় মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে । গ্রামের রাস্তায় কৃষাণেরা বলদ হাঁকিয়ে মাঠের দিকে চলেছে । মুগ, মসুর, ছোলা, অড়হর ইত্যাদি কালাই বুনার জন্য সময় মত ক্ষেত প্রস্তুত করা চাই । এদিকে সরিষার ক্ষেতে মৌমাছিদের গুঞ্জরণ উঠতে শুরু করেছে । দূরে গ্রামের পাঠশালায় ছোট ছোট ছেলে-মেয়েরা এক বিচিত্র সুরে কবিতা মুখস্ত করছে । চারিদিকে এই কর্মপ্রবাহের ব্যাস্ততার মধ্যে বিছানায় পড়ে গভীর আলস্যে তন্দ্রামুখ উপভোগ করা অনুচিত ।
শীতের সকালের বৈরাগ্য মূর্তিঃ দিকে দিকে করমের মুখরতায় শীতের সকাল কর্মব্যস্ত হয়ে উঠেছে । পূর্ব দিগন্তে আলো ছড়িয়ে সূর্যের রথ আকাশ পরিক্রমায় বের হয়ে আসছে । একটি নীলকণ্ঠ পাখি রিক্তপাত্র বাবলার ডালে বসে রৌদ্র পোহাচ্ছে । একজোড়া খঞ্জনা পাখি ডানায় বাতাস কেটে কুয়াশার ভেতর দিয়ে কোথাও উড়ে গেলো । শীতের সকাল যেন এক প্রোঢ়া কুলবধূ । তার সলজ্জ মুখখানি দিগন্ত বিস্তৃত বাড়তে থাকে । শীতের সকালো তার অবগুণ্ঠন ধীরে ধীরে খুলতে থাকে । তার বৈরাগ্য ধূসর অঙ্গ হতে শুভ্র সমুজ্জ্বল ত্যাগের সুষমা ছড়িয়ে পড়েছে । সে তার সমস্ত সঞ্চয় নিঃশেষ উজাড় করে দিয়ে ধারণ করেছে এক সর্ব ত্যাগিনী তাপসী মূর্তি ।
গাম্ভীর্যময় বৈশিষ্ট্যের জন্যে শীতের সকাল বছরের অন্যান্য ঋতুর সকাল থেকে স্বতন্ত্র। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য তাই বলেন-
'শীতের সকাল
দরিদ্রের বস্ত্রের আকাল
শীতের সকাল
অসাম্যের কাল
ধনীর সুখ আর আনন্দ
শ্রেণিসংগ্রাম এ নিয়ে চলে দ্বন্দ্ব।'
সূর্যোদয়ের পূর্বে শীতের সকালঃ লেপের তলা থেকে উঠি উঠি করেও উঠতে ইচ্ছে হয় না। শিয়রে হিংস্র শীত কেশর ফুলিয়ে থাবা পেতে বসে আছে। গরম বিছানার উত্তাপ ছেড়ে উঠতে গেলে কেমন এক দুর্নিবার আলস্য সমস্ত চেতনাকে ঘিরে ধরে। কর্মের আহ্বান সত্ত্বেও এক বিশেষ জড়তায় মানুষ আরামের শয্যায় পড়ে থাকে।
শীতের সকালের রূপ বা প্রাকৃতিক দৃশ্যঃ কুয়াশাচ্ছন্ন প্রকৃতি, শিশিরসিক্ত রাস্তা-ঘাট, হিমেল বাতাসের মিষ্টিমধুর আমেজ ইত্যাদি সব মিলিয়ে শীতের সকালের এক স্বতন্ত্র রূপ পরিলক্ষিত হয় যা অন্য কোনাে ঋতুর সকালের মতাে নয়। পত্র-পল্নবহীন গাছপালাকে অলংকারশূন্য বিধবা বলে মনে হয়। কুয়াশা আচ্ছাদিত আকাশে কুয়াশাকে ভেদ করে যখন সূয্যি উঁকি দেয় তখন শীতের সকালের এক অসামান্য রূপ পরিলক্ষিত হয়। তখন পূর্ব দিকে ধীরে ধীরে আলাে ফুটতে থাকে। উত্তর দিক থেকে ঠাণ্ডা বাতাস একটা দীর্ঘশ্বাসের মতাে হঠাৎ শিরশির করে বনের গাছপালার ফাক দিয়ে বয়ে যায়। পাতাগুলাে সহসা কেঁপে ওঠে। টুপ টুপ করে শিশির ঝরে পড়ে। বনের পথ শিশিরসিক্ত হয়ে ওঠে। ঘাসে ঘাসে শিশিরের বিন্দু জমে ভােরের আলােয় ঝলমল করতে থাকে। দূরে কোথাও খেজুর রস জ্বাল দেওয়া হয়। বাতাসে তার লােভনীয় মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে আসে। জ্বাল দেওয়া খেজুর রসের ঘ্রাণে বাতাস মৌ মৌ করে। গ্রামের কৃষকরা হালের গরু নিয়ে মাঠের দিকে চলে। মক্তব-মাদ্রাসায় ছােট ছােট ছেলেমেয়েরা স্বর উচিয়ে সুর করে কোরআন তেলাওয়াত করে। সকালে এমন মধুর ব্যঞ্জনার মধ্যে বিছানায় পড়ে পড়ে গভীর আলস্যে তন্দ্রাসুখ উপভােগ করা অনুচিত। তাই অগত্যা গায়ের লেপ সরিয়ে রেখে বিছানা থেকে বের হওয়ার জন্যে সচেষ্ট হতে হয়।
শীতের সকালের বৈরাগ্য মূর্তিঃ ততক্ষণে বাইরের পৃথিবীর ঘুম ভেঙেছে। দিকে দিকে কর্মের মুখরতায় শীতের সকাল কর্মব্যস্ত হয়ে উঠেছে। পূর্ব দিগন্তে আলাে ছড়িয়ে সূর্যের রথ আকাশ পরিক্রমায় বের হয়ে পড়েছে। একটি নীলকণ্ঠ পাখি রিক্তপত্র বাবলার ডালে বসে রােদ পােহাচ্ছে। এক জোড়া নাম না নর। জানা পাখি বাতাসে ডানা ঝাপটিয়ে কুয়াশার ভেতর দিয়ে কোনাে অজানার পানে ছুটছে। শীতের সকাল যেন এক প্রৌঢ়া কুলবধু। তার মুখখানি দিগন্ত বিস্তৃত কুয়াশার অবগুণ্ঠনে ঢাকা। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শীতের সকালও তার কুয়াশার অবগুষ্ঠন ধীরে ধীরে খুলতে থাকে।
ত্যাগের মূর্তিঃ শীতের সকালের হাতে যেন বৈরাগীর একতারা। সে তার একতারার নিঃসঙ্গ তারে আঘাত হানে নির্মমভাবে। বনের শুষ্ক বিবর্ণ রে কে লে কে নি ও পাতাগুলাে একে একে ঝরে পড়ে। উত্তরের হিমগর্ভ হাওয়া তাদের দু হাতে লুফে নিয়ে অবলীলায় উড়িয়ে দেয়।
গ্রামে শীতের সকালঃ গ্রামে ভিন্ন এক রূপ নিয়ে শীতের সকাল উপস্থিত হয়। শীত নিবারণের জন্যে দরিদ্র মানুষেরা আগুনের কুণ্ড জ্বালিয়ে তার চারপাশে বসে গা গরম করে। গাছপালার ফাক দিয়ে রােদের ঝলকানি এসে পড়ে। সেখানে বসে সবাই গল্পে মেতে ওঠে। শিশুদের কাছে এ রােদের আকর্ষণ বেশি। খেজুরের রস, শীতের পিঠা, কোঁচড় ভরা মুড়ি, গুড় বা পাটালি নিয়ে শীতের সকালকে অভ্যর্থনা জানানাের পরিচিত দৃশ্য পল্লিগ্রামের সর্বত্রই লক্ষ করা যায়। কৃষকেরা তাদের সবজি বাগানের পরিচর্যায় ব্যস্ত থাকে। শিশুরা চাদর মুড়ি দিয়ে মক্তবে যায়। এভাবে গ্রামে শিশির-ভেজা সকাল আসে।
শীতের সকালে নদনদীর দৃশ্যঃ কুয়াশাচ্ছন্ন শীতের সকালে নদীতে যেন ধুম্রজালের সৃষ্টি হয়। শীতে নদীর পানি শুকিয়ে যায়। শীতের কুয়াশাকে ভেদ করে স্বল্প পানির নদীতে নৌকা, ফেরি, লঞ চলতে খুব অসুবিধা হয়। নদীগুলাের দিকে তাকালে মনে হয় তারা যৌবন হারিয়ে ফেলেছে।
শীতের সকালের সুবিধাঃ শীতের সকালে গ্রামবাংলার ঘরে ঘরে নানা ধরনের পিঠাপুলি তৈরি হয়। এসব পিঠা, চিড়া-মুড়ি-গুড় এবং খেজুর রসের পাটালি গুড়ে তৈরি পায়েস খেতে ভারি মজা লাগে। তীব্র শীতে খেজর রস খেয়ে পরিতৃপ্তি লাভ করা যায়। শীতের সকালের মিষ্টি রােদ দারুণ প্রশান্তি নিয়ে আসে মানুষের দেহে-মনে। ঠাণ্ডার জন্যে কোনাে খাবার সহসা নষ্ট হয় না।
শীতের সকালের অসুবিধাঃ শীতের সকালে কুয়াশার জন্যে সবকিছু অস্পষ্ট দেখায় এবং প্রচণ্ড শীতে স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়। কুয়াশাচ্ছন্ন রাস্তা-ঘাটে যানবাহন চলাচল ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে। এসময়টা বস্ত্রহীন দরিদ্র মানুষের কাছে অভিশাপদ্বরূপ। শিশুরা ও বৃদ্ধরা শীতে বেশি কষ্ট পায়। প্রচণ্ড শীতের জন্যে মানুষ শীতের সকালে নিত্যনৈমিত্তিক কাজে বেরােতে অস্বস্তি বােধ করে। প্রকৃতির সর্বত্র এক ধরনের শূন্যতা পরিলক্ষিত হয়।
শহরের শীতের সকালঃ শহরের শীতের সকালের মূর্তি, গ্রামবাংলার শীতের সকালের মতাে নয়। ভােরে কাকের ডাকে শহুরে জনতার শীতের সকালের ঘুম ভাঙে। সেখানেও শিশির পড়ে, কিন্তু তাতে সবুজ ঘাসের করুণ গভীর ঘ্রাণ মিশে থাকে না। সেখানেও উত্তরের শীতল হাওয়া বয়ে যায়, কিন্তু তাতে খেজুরের রস কিংবা পাকা ধানের মৌ-মৌ গন্ধ হৃদয়কে আন্দোলিত করে না। শহরের শীতের সকাল কেবল কাকের ডাক, কলের পানির শব্দ, ফেরিওয়ালার হাকডাকের মধ্যেই সীমিত থাকে। এক কথায় শহরের ইট-কাঠ-পাথরের কৃত্রিম কাঠিন্যের মধ্যে গ্রামবাংলার উদাস করুণ শীতের সকালের স্নিগ্ধ মধুর রূপটিকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।
রূপ-বদলঃ ধীরে ধীরে বেলা বাড়তে থাকে। শীতের সূর্য পূর্ব দিগন্তের কুয়াশার জাল ছিন্ন-ভিন্ন করে ওপরে উঠতে থাকে। তার কিরণ-বাণে পর্যুদস্ত হয় শীতের তীব্রতা। সােনালি রােদে চারিদিক ভেসে যায়।
উপসংহারঃ শহরের ইট-কাঠ-পাথরের নিদারুণ চাপে শীতের সকাল তার নিজস্ব মূর্তিতে প্রকাশিত হতে পারে না। এখানে কুয়াশার সেই স্নিগ্ধ জৌলুস নেই। তবে শহরের রাজপথে শীতের রূপ ম্লান হলেও গরম চা ও পরােটার গন্ধে তাকে সংগােপনে আত্মপ্রকাশ করতে দেখা যায়। কিন্তু শীতের সকালের প্রধান আকর্ষণ খেজুরের রস, পায়েস, ভাপাপিঠা, পুলিপিঠা ইত্যাদির মন মাতানাে ঘ্রাণ শহরে বিরল।
4 comments