SkyIsTheLimit
Bookmark

রচনা দুর্নীতি: কারণ ও প্রতিকার

বাংলাদেশের দুর্নীতি: কারণ, প্রভাব ও প্রতিকার
বা দুর্নীতি : উন্নয়নের মূল অন্তরায়
বা দুর্নীতিমুক্ত স্বদেশ বা দুর্নীতি ও তার প্রতিকার
বা সমাজজীবনে দুর্নীতি
ভূমিকা : সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অক্টোপাসের মতাে জড়িয়ে থাকা দুনীতির কালাে থাবায় বিপন্ন আজ মানবসভ্যতা। এ সর্বনাশা ব্যাধির মরণ ছােবলে। বর্তমান সমাজ জর্জরিত। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে আমাদের দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ, শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প, ব্যবসায়- বাণিজ্য সর্বত্রই চলছে দুনীতি। দুর্নীতির করাল গ্রাসে সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ ক্রমশ হয়ে উঠছে অনিশ্চিত ও অনুজ্জ্বল। 
দুর্নীতির ধারণা : দু্নীতি একটি ব্যাপক ও জটিল ধারণা। দুর্নীতির গতি- প্রকৃতি বহুমুখী এবং বিচিত্র বলে এর সংজ্ঞা নিরূপণ জটিল কাজ। দুর্নীতি সমাজের প্রচলিত নীতি, আদর্শ ও মূল্যবােধের পরিপন্থি তথা অপরাধমূলক আচরণ। প্রচলিত ধারণা অনুযায়ী সাধারণত ঘুষ, বলপ্রয়োগ বা ভীতি প্রদর্শন, প্রভাব এবং ব্যক্তিবিশেষকে বিশেষ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে গণপ্রশাসনের ক্ষমতা অপব্যবহারের দ্বারা ব্যক্তিগত সুবিধা নেয়াকে দুর্নীতি বলা হয়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের দুর্নীতির ধারণাসূচক অনুযায়ী - দুর্নীতি হচ্ছে ব্যক্তিগত লাভের জন্যে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার, এতে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ঘুষ গ্রহণ ও প্রদান, সরকারি ক্রয়-বিক্রয়ের মাধ্যমে মুনাফা লাভ, সরকারি সম্পত্তি আত্মসাৎ ইত্যাদি অন্তর্ভুক্ত। এক্ষেত্রে প্রশাসনিক দুর্নীতির সঙ্গে রাজনৈতিক দুর্নীতির কোনাে পার্থক্য করা হয় না।
দুর্নীতির ধরন : বিভিন্ন ধরনের দুর্নীতি আমাদের সমাজে বিদ্যমান। দুর্নীতির প্রধান কয়েকটি ধরন হলাে- ঘুষ, অবৈধ উপায়ে সুবিধা লাভ, চাঁদাবাজি, সরকারি কোষাগার থেকে চুরি-ডাকাতি, অবৈধ পৃষ্ঠপােষকতা, স্বজনপ্রীতি, অবৈধভাবে চাকরি প্রদান, অর্থআত্মসাৎ, কাউকে সুবিধা দেওয়ার বিনিময়ে অর্থ বা অন্যান্য সুবিধা গ্রহণ, অবৈধভাবে কোনাে কিছু ভােগ দখল। 
দুর্নীতির কারণ : বিভিন্ন কারণে দুর্নীতি হয়। এর পেছনে যেমন ব্যক্তিগত কারণ কাজ করে, তেমনি পদ্ধতিগত কিছু কারণও এর প্রসারে ভূমিকা রাখে। মানুষের সীমাহীন লােভ-লালসা থেকে দুর্নীতির উৎপত্তি। দুর্নীতির কোনাে জবাবদিহিতা না থাকায় দুর্নীতির পরিমাণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সাধারণত নিম্নলিখিত বিষয়গুলােকে দুর্নীতির প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়—
১. দুর্নীতি দমন কমিশনসহ জাতীয় প্রতিষ্ঠানগুলাের অকার্যকারিতা। 
২. দুর্নীতিবাজদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি না হওয়া যা পরােক্ষভাবে দুর্নীতিকে উৎসাহিত করে। 
৩. ক্রমবর্ধমান ভােগবাদী প্রবণতা ও নৈতিক মূল্যবােধের অবক্ষয়ের কারণে ক্ষুদ্রস্বার্থ চরিতার্থ করার জন্যে দুর্নীতির আশ্রয় নেওয়া।
৪. স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার অভাব থাকার কারণে সর্বস্তরে দুর্নীতি জেঁকে বসেছে।
বাংলাদেশে দুর্নীতির ব্যাপকতা : বর্তমানে বাংলাদেশের সমাজ, রাজনীতি, অর্থনীতিসহ জীবনযাত্রার প্রায় সবক্ষেত্রে এক মহাবিপর্যয়কর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেছে। দুর্নীতি বিষয়ক জার্মানির বার্লিনভিত্তিক আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণাসূচক (CPI) অনুযায়ী বাংলাদেশ পাঁচবার (২০০১-২০০৫) পরপর শীর্ষ দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। তবে একদিনে দুর্নীতি এ অবস্থানে আসেনি। ক্রমান্বয়ে এর শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে বিশাল মহীরুহ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছে, যার শিকড় বহু গভীরে বিস্তৃত হয়ে দৃঢ়তা লাভ করেছে। 
বাংলাদেশে দুর্নীতি যেভাবে রােধ করা যায় : দুর্নীতি হঠাৎ করে ঘটে না। এটি বিস্তার লাভ করতে যথেষ্ট সময় নেয়। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও  সামাজিকভাবে যারা ক্ষমতাবান তাদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের মাধ্যমে দুর্নীতি বিস্তার লাভ করে। কাজেই শুরুতেই যদি দুর্নীতি প্রতিরােধ করা না যায়, তাহলে এটি ব্যাপক আকার ধারণ করে এবং ধীরে ধীরে পুরাে শাসনব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ে। দুর্নীতি প্রতিরােধে যেসব উদ্যোগ নেওয়া উচিত তা নিম্নে আলােচনা করা হলাে :
১. দুর্নীতি দমন কমিশনকে সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত হতে হবে : বাংলাদেশে দুর্নীতি দমন একটা বিরাট চ্যালেঞ্জ। এ ধরনের সমস্যা একক কোনাে প্রতিষ্ঠানের পক্ষে সমাধান করা কঠিন। এদেশে দুর্নীতি দমনের লক্ষ্যে ২০০৪ সালে প্রজ্ঞাপন জারির মাধ্যমে বহুল আলােচিত ও প্রতীক্ষিত স্বাধীন দুনীতি দমন কমিশন প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কিন্তু তা কার্যকরভাবে দুর্নীতি দমন করতে পারেনি বা পারছে না। দুর্নীতি দমনের জন্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে রাজনৈতিক সদিচ্ছা। দুর্নীতি দমনের জন্যে দুর্নীতি দমন কমিশনের স্বাধীনতা ও নিরপেক্ষতা চাই। এজন্যে কমিশনকে সরকারি নিয়ন্ত্রণমুক্ত করতে হবে। 
২. দুর্নীতি প্রতিরােধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে : দু্নীতি প্রতিরােধে সামাজিক আন্দোলন আমাদের দেশে অনেক সৎ ও মেধাবী সরকারি কর্মকর্তা আছেন। তাদের অনেকে শত প্রলােভন ও চাপ থাকা সত্ত্বেও সততা ও ন্যায়নীতি বজায় রাখার চেষ্টা করছেন। এসব সরকারি কর্মকর্তা এবং সমাজের সুশীল শ্রেণির লােকজনকে সঙ্গে নিয়ে দুর্নীতির বিরুদ্ধে দুর্বার প্রতিরােধ গড়তে হবে। এছাড়া বাংলাদেশের খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ কোনাে প্রকার দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত নয়। তাই সর্বস্তরে যেসব শুভবুদ্ধির লােকজন আছেন তাদের একত্রিত করে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
৩. দুর্নীতি দমনে জাতীয় কমিটি : দুর্নীতিসহ গুরুতর অপরাধ দমন অভিযান পরিচালনার জন্যে ১৬ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় সমন্বয় কমিটি গঠন করা হয়। জাতীয় কমিটির আওতায় সাতটি আঞ্চলিক বা মহানগর কমিটি এবং ৬৪টি জেলায় অন্তত ৬৪টি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। জাতীয় ও আঞ্চলিক কমিটি এবং টাস্কফোর্সকে পর্যাপ্ত আইনগত প্রশাসনিক ক্ষমতা ও সুবিধা দেওয়া হয়েছে। দুঃখের বিষয়, ক্ষমতার পরিবর্তনের পর এ কমিটি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে।
দুর্নীতি একটি আন্তর্জাতিক সমস্যা। বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন দেশে। দুর্নীতির আন্তর্জাতিক প্রভাব উপলব্ধি করে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ১৯৯৬ সালে ঘুষ ও দুনীতিবিরােধী জাতিসংঘ ঘােষণা গ্রহণ করে। ২০০৩ সালের ৩ অক্টোবর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে দুর্নীতিবিরােধী সনদ প্রণয়ন করে যা ২০০৩ সালের ৯ই ডিসেম্বর মেক্সিকোতে স্বাক্ষরের জন্যে উন্মুক্ত করা হয়। এ কারণে ৯ই ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক দুর্নীতিবিরােধী দিবস' হিসেবে ঘােষণা করা হয়। এ সনদে প্রায় ১৫০টি দেশ স্বাক্ষর করেছে। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক এ সনদে অনুস্বাক্ষরের ফলে ২০০৭ সালের ২৭-এ ফেব্রুয়ারি থেকে বাংলাদেশ এ গুরুত্বপূর্ণ জাতিসংঘ সনদের অংশীদারি দেশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
উপসংহার : দুর্নীতি যেকোনাে দেশের জাতীয় উন্নয়নের প্রধান অন্তরায়। তাই দুর্নীতি থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করার জন্যে প্রয়ােজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা, সর্বত্র সততার আবহ, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার পরিমণ্ডল। দুর্নীতি রােধে নাগরিক সমাজ, বিশেষ করে তরুণদের সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রীয় কাঠামাের সকল অনিয়মের বিরুদ্ধে তরুণরা সবসময়। সােচ্চার। দুর্নীতির বিরুদ্ধে তীব্র সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে নিঃস্বার্থ ও দুঃসাহসী তারুণ্যের সে বলিষ্ঠ ভূমিকার কোনাে বিকল্প নেই। 



লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment