পরিবেশ উন্নয়নে বৃক্ষরােপণ
বা, সামাজিক বনায়ন
ভূমিকা : পরিবেশ সংরক্ষণে বনায়নের একটি বিরাট ভূমিকা আছে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষায় বনায়নের ভূমিকা অভাবনীয়। একটি দেশে পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষার জন্যে শতকরা ২৫ ভাগ বনাঞ্চল থাকা প্রয়ােজন। কিন্তু আমাদের দেশে এ হার খুবই কম। বাংলাদেশে মােট ভূখণ্ডের মাত্র ১৭ ভাগ বনাঞ্চল রয়েছে। ফলে নানা প্রাকৃতিক বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে। এমনিতেই বাড়তি জনসংখ্যার চাপ সামলাতে গিয়ে অনেক গাছপালা কেটে ফেলা হচ্ছে। এরপর যদি বনায়ন কর্মসূচি ঠিকভাবে ত্বরান্বিত না হয়, তাহলে তা মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়াবে। দেশের পরিবেশ হবে মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। তাই পরিবেশকে বাঁচাতে আমাদের ব্যাপক বনায়ন কর্মসূচি প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়ন করতে হবে। | আয়তন ও জনসংখ্যার তুলনায় কম বনাঞ্চল বাড়াতে না পারলে আমরা। মারাত্মক পরিবেশ বিপর্যয়ের মুখােমুখি হব।
পরিবেশ সংরক্ষণ, বনায়ন ও গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া : বনায়ন ঠিকভাবে হলে, কল-কারখানার সংখ্যা বাড়লে, জনসংখ্যার চাপ বেশি হলে, রাসায়নিক তেজস্ক্রিয় দেখা দিলে তা পরিবেশের ওপর মারাত্মক প্রভাব বিস্তার করে। এ পরিবেশ বিপর্যয়কে বিজ্ঞানীরা গ্রিন হাউজ প্রতিক্রিয়া নামে অভিহিত করে থাকেন। এ প্রতিক্রিয়ার ফলে সূর্যের তেজস্ক্রিয় রশ্মিগুলাে বিনা বাধায় পৃথিবীতে আসার সুযোগ পায়। কিন্তু তা আবার মহাশূন্যে ফিরে যেতে পারে না। ফলে ভূমণ্ডল অধিকতর উষ্ণ হয়ে ওঠে। আমাদের দেশেও গ্রিন হাউস প্রতিক্রিয়া রয়েছে। এর ফলে বন্যা, খরা, অতিবৃষ্টি, জলােচ্ছাস, ভূমিকম্প, ভূমিধসের মতাে মারাত্মক বিপর্যয় দেখা দিচ্ছে আমাদের দেশে। এ প্রাকৃতিক বিপর্যয় রােধে ব্যাপক বনায়ন কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে।
বৃক্ষনিধন ও পরিবেশ বিপর্যয় : অধিকহারে বৃক্ষনিধন পরিবেশ বিপর্যয়ে মারাত্মক পরিণতি ডেকে আনে। বৃক্ষরােপণ অভিযান সফল করতে পারলে এ বিপর্যয় কাটিয়ে ওঠা সম্ভব। পরিবেশবিজ্ঞানীদের মতে, ক্রমাগত বৃক্ষনিধনের ফলে ২০৩০ সালে এদেশের ৮° থেকে ১০° সে. তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাবে। আমাদের গড় তাপমাত্রা ৩৫°-৩৬° সে. থেকে বেড়ে ৪৫° সে. এ দাঁড়াবে। পরিবেশবিজ্ঞানীদের এ অভিমত আমাদের উদ্বিগ্ন করে। আজ আমাদের দেশে অধিক হারে গাছ কাটা ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে পরিবেশ হুমকির সম্মুখীন। দেশ আজ জনসংখ্যা বিস্ফোরণের মুখে। অথচ আয়তন মাত্র ১,৪৭,৫৭০ বর্গ কিলােমিটার। আর বন এলাকার আয়তন দাঁড়িয়েছে ৭ থেকে ৮ শতাংশ। কিন্তু পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় বন এলাকার প্রয়ােজন ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ প্রয়ােজনের তুলনায় আমাদের বন এলাকা অত্যন্ত কম। তাই বলার অপেক্ষা রাখে না যে, পরিবেশ সংরক্ষণে ব্যাপক বনায়ন কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
বনায়ন ও বাসযােগ্য পরিবেশ : বাসফযোগ্য পরিবেশ নিশ্চিত করতে হলে। ব্যাপক বনায়নের কোনাে বিকল্প নেই। অথচ আমরা বন না বাড়িয়ে ক্রমাগত বৃক্ষনিধন করে চলেছি। ১৯৭৪ সালেও আমাদের দেশে শতকরা ২৪ ভাগ বনভূমি ছিল। আজ তা প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। সমগ্র বাংলাদেশের মাত্র ১৭ ভাগ বনাঞল। কিন্তু আগেই বলেছি, পরিবেশগত ভারসাম্য রক্ষায় বনাঞ্চলের প্রয়ােজন ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ প্রয়ােজনের তুলনায় আমাদের দেশে বনাঞলের পরিমাণ অত্যন্ত কম। অথচ বিরূপ প্রাকৃতিক পরিবেশের মােকাবেলা করতে হলে আমাদের বনায়ন যত বাড়ানাে যাবে, ততােই আমাদের জন্যে মঙ্গল হবে।
বনায়ন ও সামাজিক সচেতনতা : বনায়ন কার্যক্রম জোরদার করলে পরিবেশ সংরক্ষণ অনেক সহজ হয়। আর বনায়ন কার্যক্রম জোরদার করতে, হলে চাই সামাজিক সচেতনতা। বাস্তবতার নিরিখে ব্যাপক বনায়নের জন্যে আমাদের দেশে সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। পরিবেশ বিপর্যয়ের ভয়াবহতার কথা তাদের বুঝিয়ে বনায়ন কার্যক্রমে উৎসাহিত করতে হবে। দেশের সবকটি জেলায় এখন বনায়ন কর্মসূচি চালু আছে। এজন্যে প্রত্যেক থানায় থানা বনায়ন ও নার্সারি উন্নয়ন প্রকল্প চালু আছে। বন বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের প্রয়ােজনবােধে এজন্যে প্রণােদনামূলক কার্যক্রম চালাতে হবে।
সামাজিক বনায়ন ও পরিবেশ সংরক্ষণ : জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও বন উজাড় হওয়ার কারণে বর্তমানে বনজ সম্পদের চাহিদা ও সরবরাহের মধ্যে ব্যবধান অনেক। এ সমস্যার সমাধানের লক্ষ্যে অব্যবহৃত জমিগুলােতে বন সৃষ্টি বা গাছ লাগানাের ব্যাপারে জনগণকে উৎসাহিত করতে হবে। জনগণের স্থায়ী অংশগ্রহণেই কেবল বনজ সম্পদের বৃদ্ধি ঘটানাে সম্ভব। দেশি ও বিদেশি প্রায় ১০০ বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) তাদের গ্রামােন্নয়নমূলক বিভিন্ন কর্মসূচিতে সামাজিক বনায়নকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। এর মধ্যে রয়েছে রাস্তার দু পাশে গাছ লাগানাে, গৃহস্থালি বনায়ন এবং স্থানীয় জনগণের কমিউনিটির ভিত্তিতে নেওয়া কৃষিজমিতে খামার বনায়ন। পরিবেশ সংরক্ষণে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি সুদূরপ্রসারী ভূমিকা পালন করতে পারে। বর্ধিত জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে গিয়ে বনজ সম্পদের মাত্রাতিরিক্ত ব্যবহার করা হচ্ছে। বৃক্ষরােপণ হারের চেয়ে বেশি মাত্রায় গাছকাটার ফলে পরিবেশের মারাত্মক বিপর্যয় ঘটছে। এজন্যে সামাজিক বনায়ন কর্মসূচি জোরদার করার মাধ্যমে পরিবেশ সংরক্ষণে আমাদের সকলকে এগিয়ে আসতে হবে ।
উপসংহার : পরিবেশ সংরক্ষণে বনায়নের রয়েছে অবিকল্প ভূমিকা। দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থেই বনায়ন কর্মসূচিকে ব্যাপক ও বিস্তৃত করতে হবে। বৃক্ষনিধন রােধ করতে হবে। বনজ সম্পদ রক্ষায় সকল স্তরের মানুষকে সচেতন হতে হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে বাসযােগ্য ও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে বনায়ন বাড়ানাে ছাড়া কোনাে উপায় নেই। দিনে দিনে আমাদের বৃক্ষরােপণ কার্যক্রম সম্প্রসারিত ও প্রখর করতে হবে। এক্ষেত্রে বনজ ও ফলদ উভয় বৃক্ষই রােপণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে যে, এক একটি গাছ, এক একটি অক্সিজেন ফ্যাক্টরি। | গাছের সঙ্গে রয়েছে আমাদের দমের সম্পর্ক, বেঁচে থাকার সম্পর্ক বনায়ন জোরদার করার ক্ষেত্রে যে কোনাে ধরনের আলস্য, অবহেলা, অসচেতনতা, উদ্যমহীনতা পরিবেশের জন্যে বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাড়াবে। । পরিবেশ সংরক্ষণে বনায়নের অবিকল্প ভূমিকার কথা মনে রেখেই আমাদের বনায়ন কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
Post a Comment