পুস্তক পাঠের আনন্দ
বা গ্রন্থপাঠের আনন্দ
ভূমিকা : সভ্যতার সূচনালগ্ন থেকেই মানুষ কেবল দিনযাপনের সংগ্রাম নিয়েই মেতে থাকল না, শৃঙ্খলিত থাকতে চাইল না দৈনন্দিন প্রয়ােজনের বন্দিশালায়। আকাশ তাকে হাতছানি দিল। সাগর শুনাল মহাজীবনের 1. সংগীত। অরণ্য দিল মুক্তির সংবাদ। কল্পনার রং দিয়ে সে, এক নতুন রঙ্গমহল বানাল। ব্যাপৃত হলাে সৃষ্টি রহস্যের নিরন্তর গবেষণায়। সভ্যতা বিনির্মাণে জ্ঞান স্বীকৃত হলাে। আর জ্ঞানার্জনে পুস্তকের প্রয়ােজনীয়তাও স্বীকৃত হলাে সর্বাগ্রে। অর্জিত হলাে সমাজের সঙ্গে পুস্তকের, পুস্তকের সঙ্গে পাঠকের অন্তরঙ্গ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক।
বইয়ের বৈশিষ্ট্য : বই হচ্ছে মানুষের মেধা-মনন ও প্রজ্ঞা-চেতনা পরিস্ফুটনের উৎকৃষ্ট মাধ্যম। বইয়ের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এটি নিঃস্বার্থভাবে পাঠকের হৃদয়বৃত্তিকে জাগ্রত করে এবং মানবিক মূল্যবােধের বিকাশ ঘটায়। মহাকালের অনন্ত স্রোতধারায় যেসব মহাজ্ঞানী মহাজন তাঁদের জীবনের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে অনাগত প্রজন্মের জন্যে সৃজন করেছেন কালােত্তীর্ণ ইতিহাস, পুস্তকের পাতায় সংরক্ষণের মাধ্যমে আমরা সেগুলােকে পেয়ে থাকি মূল্যবান পথপ্রদর্শক হিসেবে। জ্ঞানের সে অমিতধারা যুগ-যুগান্তর ধরে বহতা নদীর মতাে চির প্রবহমাণ বলে পুস্তক পাঠের কোনাে জুড়ি নেই।
বই পাঠের আনন্দ : বই জীবনেরই জন্যে। দেশ-কালের কত তুচ্ছাতিতুচ্ছ ঘটনা, জীবনের চড়াই-উত্রাই-এর কত অভিজ্ঞতা বইয়ে লিপিবদ্ধ হয়েছে। বই হতে পারে নিরানন্দ জীবনের আনন্দের উপকরণ। পাঠক হিসেবে বইয়ের সঙ্গে মিশে একাকার হতে পারলে, বই আমাদের জীবনে দিতে পারে আনন্দের ফল্গুধারা, শান্তির মহাপ্রস্রবণ। ইতিহাস, সাহিত্য, দর্শন, আইন ইত্যাদি বিষয়ক বই পাঠ করে মানুষ বিশেষ ধরনের আনন্দ লাভ। করতে পারে, পেতে পারে পরিপূর্ণ আত্মিক তৃপ্তি। L. A. G. Strong বলেছেন- 'The diversity of the books expressing different factor has created coruscation among the readers'.
বইয়ের সঙ্গে পাঠকের সম্পর্ক : বই কেবল যে জ্ঞানার্জনের উপায় তা নয়। বই সত্য সুন্দর আনন্দময় অনুভূতিতে পাঠকচিত্তকে আলােড়িত করে। হতাশাক্লান্ত-বিভ্রান্ত, নৈরাশ্যগ্রস্ত মানুষকে পৌছে দেয় জীবনের মহৎ প্রাঙ্গণে। উৎকৃষ্ট গ্রন্থই মানুষকে পশুবৃত্তির স্থূল স্তর থেকে মনুষ্যত্বলােকে নিয়ে যেতে পারে। পাষণ্ড প্রাণ আবার নতুন করে খুঁজে পায় মনুষ্যত্ব। বইয়ের মধ্যেই তার ঘটে নতুন জন্ম। পুস্তকই আমাদের ত্রিকালসূত্রে আবদ্ধ করে, আশা জাগায়, স্বপ্ন দেখায়, শােনায় বিপ্লবী সংগীত। বই আমাদের হাতে তুলে দেয় নতুন প্রভাতের মঙ্গল আলা, সঠিক পথের নির্দেশনা। তাই বই এর সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে উন্নত ও আনন্দপূর্ণ জীবন গঠন করা যায়। বই ব্যক্তির মনুষত্ববােধ জাগরণে ক্রিয়াশীল ভূমিকা রাখে। সৃজনশীল চিন্তাভাবনা করার খােরাক জোগাতে এর কোনাে বিকল্প নেই। জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার সঙ্গে সমন্বয় সাধিত হতে পারে বই পড়ার মাধ্যমে অর্জিত জ্ঞানের। সে জ্ঞানের আলাে ব্যক্তিকে সত্য-মিথ্যা, ভালাে-মন্দ চিনতে এবং বুঝতে সহযােগিতা করতে পারে। জ্ঞান অর্জনের স্পৃহা যার প্রচণ্ড, সে ইচ্ছে করলে কম পয়সায় বইয়ের মাধ্যমে জ্ঞান অর্জন করতে পারে। ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এসব বিষয়ের পাশাপাশি দার্শনিকতা-সমৃদ্ধ বিভিন্ন লেখকের লেখা বই ব্যক্তিকে ইতিবাচক জ্ঞানার্জনে যেমন সহায়তা করে তেমনি ঐতিহাসিক স্থান সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান ও অনুভূতি প্রদান করে।
উপযুক্ত বই নির্বাচন : উপযুক্ত বই নির্বাচনে একজন পাঠককে অবশ্যই সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। কুরুচিপূর্ণ ও অশ্লীল বই যুবসমাজকে সাময়িক আনন্দ দিলেও সময়ের ব্যবধানে তা দেশ ও জাতির জন্যে অকল্যাণ ডেকে আনে। যে বইয়ে সমাজের নানা বিষয়, পােশাক-পরিচ্ছদ, অলংকার, হাসি-ঠাট্টা, রসালাপ, সুখ-দুঃখ ইত্যাদি নিপুণভাবে উঠে এসেছে, পাঠককে সেরকম বই-ই মনােনীত করতে হবে। তা ছাড়া মনীষীদের জীবন চরিত পড়া উচিত। এতে করে তাদের জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতা, দর্শন প্রভৃতি বিষয়ে জানা যায় এবং অর্জিত জ্ঞান নিজেদের জীবন গঠনে কাজে লাগিয়ে জীবনকে উন্নত করা যায়। ভ্রমণকাহিনিমূলক বই ব্যক্তিকে ইতিহাস বিখ্যাত স্থান সম্পর্কে প্রত্যক্ষ জ্ঞান দান করতে পারে বলে এ ধরনের বই পড়া খুবই উপকারী। বিচিত্র বিষয়ে বই রচিত হলেও বেছে বেছে ভালাে বই-ই পড়া উচিত। একেক বই পাঠে একেক ধরনের আনন্দ পাওয়া যায়। তবে নিছক আনন্দের চেয়ে আনন্দের পাশাপাশি জীবনে কাজে লাগতে পারে এমন ধরনের বই পড়লে ভালাে হয়।
বই পড়ার সময় নির্বাচন : বই পড়ার আনন্দ সবসময় একরকম হয় না। পরিবেশ-পরিস্থিতি এবং পারিপার্শ্বিকতা অনুযায়ী বই পড়ার আনন্দ বিভিন্ন মাত্রা লাভ করে। পাহাড়ি নির্জন এলাকায় কোনাে ঝরনার পাশে বসে একটি বই পড়লে মনে যে আবেগ-অনুভূতি দোল খেয়ে উঠবে, কোনাে ব্যস্ত এলাকায় বইটি পড়লে সেরকম অনুভূতি হবে ভিন্নরকম। চাদনি রাতে খােলা জানালার পাশে ঘরের মৃদু আলােয় বসে একা একা কোনাে বই পড়লে যে অনুভূতি সৃষ্টি হয় মধ্য দুপুরের অলস প্রকৃতির নীরবতায় বিছানায় শুয়ে বই পড়লে সে অনুভূতি হবে না। প্রকৃতপক্ষে সমঝদার পাঠক মাত্রই জানেন, কোন সময় কোন বই পড়তে হবে। ভ্রমণের সময় বই পড়ার একটা অন্যরকম আনন্দ পাওয়া যায়। নিঃসঙ্গতা কাটাতে বইয়ের জুড়ি নেই। যে সময়ের জন্যে যে বইটি মানানসই হবে সে সময়ে সে বইটি পাঠে আনন্দ লাভ করা যায় বেশি।
বই যখন কথা বলে : বই যখন পাঠকের সঙ্গে কথা বলে তখন পাঠকের মনে ধ্যানমগ্নতা ভর করে। পাঠক একমুখী চিন্তা-চেতনা-কল্পনা ও আবেশে মােহাবিষ্ট হয়ে পড়ে। একটি ভালাে বই একজন সরস গল্পকারের মতাে। যে কোনাে বিষয়ের বই লেখকের লেখার গুণে সরস হতে পারে। বিজ্ঞানের মতাে কাঠখােট্টা বিষয়ও সাহিত্য রসে সিদ্ধ হয়ে পাঠককে মােহাবিষ্ট করে তােলে। তবে বইয়ের এ গুণগুলাে পাঠককে আবিষ্কারের ক্ষমতা অর্জন করতে হবে। পাঠকের এ ক্ষমতা না থাকলে বই নির্জীব পদার্থের মতাে হয়ে পড়ে এবং পাঠক বই পড়ার আনন্দ থেকে বঞ্চিত হয়। বই যখন কথা বলে, বইয়ের সে কথা পাঠককে সজা লাভের চরম সুখ দেয়, অথচ বিনিময়ে কিছুই প্রত্যাশা করে না।
উপসংহার : একটি পুস্তক যুগের হয়েও যুগাতিক্রান্ত। আবহমানকাল ধরে এর বক্তব্য পথহারা মানুষকে দেবে পথের সন্ধান, ঠিকানাহীন মানুষকে দেবে মনুষ্যত্ব অর্জনের দীক্ষা। এজন্যে চাই সময়ােপযােগী বক্তব্যধর্মী উৎকৃষ্ট বই, উত্তম পরিবেশ ও উপযুক্ত সঙ্গ। ম্যান্সফিল্ড যথার্থই বলেছেন, বই পড়ার আনন্দ দ্বিগুণ হয়, যখন এমন একজনের সঙ্গে বাস করা যায়, যে আমার, মতাে একই বইগুলাে ভালােবাসবে।
1 comment