কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞানের প্রয়ােগ
বা কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞান
ভূমিকা : আদিম মানুষ যেদিন মাটিতে বীজ বুনে ফল ও ফসল ফলাতে শুরু করল, সেদিন থেকেই কৃষিবিজ্ঞানের যাত্রা শুরু। ক্রমশ তারা ফসল ফলানোর কাজে লাঙল, কোদাল ইত্যাদি প্রাথমিক হাতিয়ার ব্যবহার করতে শুরু করল। সে ছিল আদিম ধরনের বিজ্ঞান-প্রযুক্তি। তারপর কত শতাব্দী চলে গেছে। বিজ্ঞানের হয়েছে অভাবনীয় অগ্রগতি। এখন কৃষিতে লেগেছে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া। বাংলাদেশের কৃষিতেও বিজ্ঞানের প্রয়ােগ অগ্রযাত্রা সূচিত বাংলাদেশ মানেই গ্রাম বাংলা, মাটি ও মানুষের বাংলা। এদেশের শতকরা। ৮০ জন অধিবাসী কৃষিজীবী। গােটা বাংলাই যেন একটা কৃষিক্ষেত্র। বাংলাদেশ ও এর অধিবাসী সবই কৃষিনির্ভর। কৃষি আমাদের প্রাণ, কৃষি আমাদের ধ্যানজ্ঞান ও সাধনা। তাই এদেশের কৃষিতে বিজ্ঞানের প্রয়ােগ খুবই গুরুত্ব বহন করে।
কৃষিকাজে বিজ্ঞান : একবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে বিশ্ব ও বিশ্ববাসীর কোনাে কাজেই বিজ্ঞানের অনুপস্থিতি নেই। বিজ্ঞানের জয়যাত্রা আজ সর্বত্র। বিজ্ঞানের কল্যাণে অন্ধকার পৃথিবী আজ আলােকিত। বিজ্ঞানের কল্যাণেই মরু হয়েছে সরস ও উর্বর, দুর্গম পাহাড়ের খাড়াই-উত্রাই পরিণত হয়েছে দিগন্ত বিস্তৃত সমভূমিতে, নদী পেয়েছে নতুন গতি, শুকনাে খেতে চলছে জল-সেচ। জগৎ ও জীবনের কর্মপ্রবাহের প্রতিটি স্তরে বিজ্ঞান তার অবদানের স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। কৃষিবিজ্ঞানীরা বর্তমান শতাব্দীতে কৃষিকাজে বিজ্ঞানের ব্যবহারকে সাফল্যজনক পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। অল্প জমিতে অধিকতর ফসল উৎপাদনের লক্ষ্যে নিবিড় চাষের জন্যে যান্ত্রিক সরঞ্জামের আবিষ্কার কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লবের সূচনা করেছে। ট্রাক্টর ও পাওয়ার টিলারের সঙ্গে আরও নানা ধরনের যান্ত্রিক সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতির আবিষ্কার মানুষ ও পশুশ্রমকে মুক্তি দিয়েছে। একই সঙ্গে গােবর সার, কম্পােস্ট সার ও সবুজ সারের স্থলে রাসায়নিক সার; যথা- ইউরিয়া, টিএসপি ও এএসপি ইত্যাদির আবিষ্কারের ফলে একর প্রতি উৎপাদন দ্বিগুণের ওপরে চলে গেছে। পাশাপাশি উল্লেখ করা যায় ধান ও গমের ক্ষেত্রে উচ্চ ফলনশীল বীজ আবিষ্কারের কথা। ফিলিপাইনের আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্রে ইরি ধান আবিষ্কৃত হয়। এরপর বাংলাদেশের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ইরি-৮ নামক উচ্চ ফলনশীল ধান আবিষ্কার করে এদেশের কৃষিক্ষেত্রে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা আবশ্যক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নােবেল প্রাইজ বিজয়ী বিজ্ঞানী নর্মান বেরলগের মাক্সিপাক ও অন্যান্য জাতের উচ্চ ফলনশীল গম আবিষ্কার করে কৃষিকাজের বৈজ্ঞানিক অগ্রগতিতে মহতী উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। কৃষিকাজে বিজ্ঞানের প্রয়ােগজনিত সাফল্য শুধু ধান ও গমের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। বিজ্ঞানের এ সাফল্য দেশের প্রায় সকল ধরনের ফল, ফলারি ও কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রেই সাধিত হয়েছে। কৃষিক্ষেত্রে পােকামাকড় দমন ও নির্মূল করার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের প্রয়ােগ ঘটেছে অন্য সকল ক্ষেত্রের মতােই। নানা ধরনের পােকার আক্রমণ থেকে শস্যকে রক্ষার জন্যে ইনসেকটিসাইড বা পােকা দমনকারী বহু রাসায়নিক দ্রব্য আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে এন্ড্রিন, ডায়াজিন, ক্লোর ছাড়াও রয়েছে অনেক পােকাধ্বংসী ওষুধ।
বাংলাদেশের কৃষিতে বিরাজমান অবস্থা : অধিক জনসংখ্যার ভারে বাংলাদেশ আজ নুয়ে পড়েছে। জনসংখ্যার গুরুভার সৃষ্টি করেছে প্রকট খাদ্য সমস্যা। আমাদের দেশের প্রচলিত প্রাচীন চাষাবাদ পদ্ধতি জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সমতা বজায় রেখে কৃষিক্ষেত্রে ফসল উৎপাদন করতে পারছে না। আমাদের মাটির তুলনায় জাপানের মাটির স্বাভাবিক উৎপাদনক্ষমতা এক-চতুর্থাংশ। অথচ তারা কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমাদের চেয়ে প্রায় অর্ধেক জমিতে সর্বাধিক ফসল ফলিয়ে খাদ্য সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে। যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিপাইন, চীন, কোরিয়া প্রভৃতি দেশের কৃষিবিজ্ঞানকে আমরা ব্যবহার করতে পারি ।
আমাদের কৃষি এবং আধুনিক প্রযুক্তি : আমাদের কৃষক সম্প্রদায় এখনও অনেক জায়গায় জমি চাষের জন্যে গবাদিপশু চালিত লাঙল ব্যবহার করেন। এ ব্যবস্থা যেমন কষ্টকর, তেমনই সময়সাধ্য। এ কাজে আমরা ট্রাক্টর ব্যবহার করে অল্প আয়াসে অধিক জমিতে চাষাবাদ করতে পারি। কৃষিক্ষেত্রের মান অনুযায়ী রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ওষুধ ব্যবহার করে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা যেতে পারে। উন্নত দেশগুলাের মতাে আমরাও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে ফসল ফলানাে থেকে শুরু করে অল্প আয়াসে অধিকতর ফসল কেটে ও মাড়াই করে আমাদের খাদ্য সমস্যার সমাধান করতে পারি। মানুষের মৌলিক চাহিদার সবটাই জোগান দেয় কৃষি। তাই কৃষিকে অবহেলা করে বেঁচে থাকা যেমন সম্ভব নয়, তেমনই দেশ ও জাতির সামগ্রিক কল্যাণসাধনও অসম্ভব। আশার কথা, এদিকে লক্ষ রেখেই সরকার কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে সচেতন। কৃষিব্যবস্থার সামগ্রিক কল্যাণের স্বার্থে এদেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কৃষিকে মাধ্যমিক স্তর থেকে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় কৃষি সম্প্রসারণে সবরকম সাহায্য-সহযােগিতা করে আসছে।
উপসংহার : আমাদের জাতীয় উন্নয়ন সম্পূর্ণরূপে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তাই বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমেই কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে আমরা পরনির্ভরশীলতার অভিশাপ থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি।
Post a Comment