দেশ গঠনে নারীসমাজের ভূমিকা
বা জাতীয় উন্নয়ন ও নারীসমাজ
বা জাতীয় উন্নয়নে নারী সমাজের ভূমিকা
ভূমিকা : 'বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।'
নারীসমাজ জাতীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। জাতীয় জীবনে তাদের যেমন গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে তেমনি তাদের অধিকারও রয়েছে। মহানবি (স) বলেছেন, 'তােমাদের যেমন অধিকার রয়েছে। নারীদেরও তেমনি অধিকার রয়েছে। নারী-পুরুষের সম্মিলিত শ্রম ও চেষ্টায় আমাদের সমাজজীবনের বৃদ্ধি, সুখ-শান্তি-সমৃদ্ধি নির্ভরশীল। কিন্তু সভ্যতার কোনাে একপর্যায়ে এসে নারী পুরুষের বৃত্তে বন্দি হয়ে পড়তে থাকে। তখন নারী ভােগের সামগ্রী হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে এ বন্দিদশা থেকে মুক্ত হয়ে নারী আজ পুরুষের মতােই কর্মশীল জীবনের অধিকারী। একটি সমাজের উন্নতি বর্তমান বিশ্বে নারী সমাজের ওপর । বহুলাংশে নির্ভরশীল।
নারীত্বের গৌরব : নারীর সার্থকতা মাতৃত্বে। এ কারণে ইসলাম 'মাতার পদতলে সন্তানের বেহেশত' বলে নারীর মাতৃত্বকে সর্বোচ্চ গৌরবে ভূষিত । করেছে। জাতির জন্যে, দেশের জন্যে নারীর সবচেয়ে বড় অবদান, সবচেয়ে। বড় উপহার তার সন্তান। পৃথিবীর সকল সমাজসংস্কারক, চিন্তাবিদ বিজ্ঞানী, কবি, লেখক, রাষ্ট্রনায়ককে তারাই প্রতিপালন করেছেন। কেবল প্রতিপালন নয়, সন্তানের জীবন গঠন এবং জীবনের দিকনির্দেশনায়ও তারা অমূল্য অবদান রেখেছেন। হজরত মুহম্মদ (স) এর মতাে মহান ব্যক্তিত্ব, নিউটনের মতাে বৈজ্ঞানিক, প্লেটো, সক্রেটিস, অ্যারিস্টটলের মতাে রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, বিশ্ববিজয়ী বীর নেপােলিয়ন সবাইকে গর্ভে ধারণ করে মাতৃত্বের গৌরব অর্জন করেছে নারীই। আগামী দিনেও বৈজ্ঞানিক, রাষ্ট্রনায়ক, লেখক, সাহিত্যিক, কবি, সমাজসংস্কারক, চিন্তানায়ক প্রভৃতি। দেশ গড়ার মানুষদের মানুষ করার দায়িত্ব পালন করবে নারীই। এ দায়িত্ব, এ কাজ মহাগুরুত্বপূর্ণ। এ কারণেই মাতার ঋণ সন্তান কোনােদিনও শােধ করতে পারে না। অনুরূপভাবে দেশ ও জাতির পক্ষেও নারীর ঋণ শােধ করা। সম্ভব নয়।
নারীর কর্তব্য : জাতীয় জীবনের উন্নয়ন ও দেশ গঠনে পুরুষের পাশাপাশি নারীসমাজের ভূমিকাও বিশেষভাবে পরিলক্ষিত হয়। বর্তমানে বিশ্বে ৭০০ কোটি লােকের অর্ধেক নারী। সুতরাং সমাজ ও সভ্যতার উন্নয়নের জন্যে নারীর ভূমিকা একান্ত প্রয়ােজন। সন্তান প্রতিপালন, সন্তানের জীবন গঠন নারীর প্রথম এবং প্রধান কর্তব্য হলেও জীবনের আরও অনেক ক্ষেত্রে নারীর করণীয় অনেক কিছুই রয়েছে। অতীতের মতাে আজ নারীসমাজ পিছিয়ে নেই। আজ যুগের বিবর্তনে জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্র প্রসারিত হয়েছে। সে সাথে পরিবর্তিত হয়েছে মানুষের জীবনের গতি, বেড়েছে কাজ। আর এ পরিবর্তিত অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নারীর দায়িত্বও বেড়েছে।
শিশুর চরিত্র গঠনে নারী : আজকের শিশু আগামী দিনের জাতিকে নেতৃত্ব দেবে। আর এ শিশুকে নেতৃত্বের আসনে পৌছে দেওয়ার দায়িত্ব অনেকখানি মায়ের ওপর নির্ভর করে। কারণ শিশু জন্মের পর থেকে মায়ের কাছেই মানুষ হয়। মায়ের স্নেহ-মমতা ও শাসনের মধ্যেই তার আত্মবিকাশ ঘটে। মা যদি সন্তানকে সুপথে পরিচালিত করেন তবে সে সন্তান মনুষ্যত্ববােধে দীপ্ত হবে, শিক্ষার আলােকে উজ্জ্বল হবে। তাই তাে বিশ্ববিখ্যাত বীর নেপােলিয়ন বলেছিলেন 'আমাকে একজন শিক্ষিত মা উপহার দাও, আমি ভালাে জাতি উপহার দেব'। সুতরাং শিশুর চরিত্র গঠন ও মানবিক বিকাশের জন্যে মায়ের অবদান সবচেয়ে বেশি।
জাতি গঠনে নারী : জাতি গঠনে নারী সমাজের দায়িত্ব পুরুষের চেয়ে কোনাে অংশে কম নয়। জাতীয় জীবনে সচলতা, জ্ঞান, কর্ম ও প্রাণ- চাঞ্চল্যের সৃষ্টি না হলে জাতি অচল হয়ে যায়। নারীরা যেহেতু পুরুষের মতােই সমাজের একটা অংশ, তাই পুরুষের মতাে নারী সমাজকেও জাতি তথা সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে হয়। উন্নত দেশসমূহে নারী জাগরণের ফলে দেশের সমৃদ্ধি এসেছে, সমাজজীবন সচল ও গতিশীল হয়েছে। আমাদের দেশের নারীরা সমাজগঠনে সক্রিয়ভাবে এগিয়ে এলে সমাজ যে উন্নতির পথে অগ্রসর হবে তাতে কোনাে সন্দেহ নেই। শুধু সেবা ও গৃহকর্মের মধ্যে নারীকে সীমাবদ্ধ না রেখে নারীকে জাতীয় ক্ষেত্রে পুরুষের পাশাপাশি সব স্তরে কর্মময় জীবনের অধিকারিণী করে তুলতে পারলে দেশের সমৃদ্ধি ও জাতির মঙ্গল ত্বরান্বিত হবে।
নারীর অধিকার : নারীসমাজের কর্তব্যের পাশাপাশি অধিকারের বিষয়টিও আমাদের ভেবে দেখা দরকার। কারণ কর্তব্যের সাথে অধিকারের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। অধিকার ছাড়া কর্তব্য পালনে মানুষ উৎসাহ বােধ করে না। আমাদের সমাজে নারীরা এখনও চরমভাবে অবহেলিত। পুরুষশাসিত এ সমাজে অধিকাংশ নারী পুরুষের ইচ্ছার বাইরে এখনও তেমন কিছু করতে পারে না। শিক্ষা, সংস্কৃতি সকল ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে নারীরা সাধারণভাবে অনেক পিছিয়ে আছে। অশিক্ষা ও কুসংস্কারের বেড়াজালে তাদের জীবন আবদ্ধ। বিশেষ করে গ্রামের অশিক্ষিত নারীরা সারাদিন স্বামী-সংসারে পরিশ্রম করে বিনিময়ে সামান্যতম অধিকার ভােগ করতে পারে না। অবশ্য শহরের আধুনিক শিক্ষিত মহলের মধ্যে কিছুটা হলেও এ মনােভাবে পরিবর্তন এসেছে। ধর্মে নারীর অধিকারের কথা বলা হলেও আমাদের সমাজব্যবস্থায় এখনও তার চর্চা শুরু হয় নি। কিছু কিছু ক্ষেত্রে এমনকি স্বাধীনভাবে চলা তাে দূরের কথা স্বাধীন ইচ্ছা পূরণের অধিকারও তাদের নেই। অবশ্য এক্ষেত্রে উন্নত দেশের নারীদের অনেকেই স্বাধীনভাবে জীবনযাপন করতে পারলেও আমাদের সমাজ কাঠামাে এখনও সেভাবে গড়ে ওঠেনি।উপসংহার : শুধু পুরুষের সেবা ও কর্মে একটি জাতি আত্মবলে বলীয়ান ও নৈতিক শক্তিতে তেজী হতে পারে না। নারীর ত্যাগ, সেবা ও শিক্ষা জাতিকে গৌরবদীপ্ত মহিমা দিতে পারে। উন্নত দেশগুলােতে নারীসমাজ জাতি গঠনে পুরুষের সমান অবদান রাখছে। আমাদের দেশেও সুস্থ ও সুখী জাতি গঠনে নারীসমাজের অংশগ্রহণ একান্ত প্রয়ােজন। জাতিকে সুস্থ, উন্নত ও কর্মক্ষম করে গড়ে তােলার কাজে নারীসমাজের কর্তব্য অনেক। জাতি গঠনে তাদের ভূমিকা পুরুষের চেয়ে ছােট করে দেখার অবকাশ নেই।
2 comments