জাতীয় জীবনে দেশপ্রেমের গুরুত্ব
বা দেশপ্রেম
সূচনা: জন্ম থেকেই স্বদেশের সঙ্গে গড়ে ওঠে মানুষের নাড়ির সম্পর্ক তাই একজন নাগরিক তার স্বদেশকে, দেশের মানুষকে এত ভালােবাসে। এ ভালােবাসাই হচ্ছে স্বদেশপ্রেম। স্বদেশের উন্নতির জন্যে কাজ করা এবং দেশের জন্য যে কোনাে ত্যাগ স্বীকার করার নামই স্বদেশপ্রেম। যে দেশে আমরা জন্ম নিই সে দেশের প্রকৃতি, মানুষ ও সংস্কৃতিকে ভালােবেসেই গড়ে ওঠে স্বদেশপ্রেম। এক কথায়, স্বদেশকে ভালােবেসে তার কল্যাণের লক্ষ্যে জীবন উৎসর্গ করার অনুভূতির নামই স্বদেশপ্রেম।
স্বদেশপ্রেমের অনুভূতি ও চেতনা: যে মাটিতে আমাদের জন্ম সেটাই। আমাদের প্রিয় স্বদেশ। স্বদেশের আলাে-বাতাসে আমরা লালিত-পালিত- বর্ধিত হই। দেশের মানুষের চেতনার সঙ্গে আমাদের চেতনার মেলবন্ধন সৃষ্টি হয়। দেশের ভাষা ও সংস্কৃতির আলােয় গড়ে ওঠে আমাদের মানস-চেতনা। স্বদেশের প্রতি গভীর মমতা, ভক্তি ও শ্রদ্ধায় আপ্লুত হয় আমাদের হৃদয়-মন। এভাবেই আমাদের অন্তরে অনুরণিত হয় স্বদেশপ্রেমের আবেগ। সে আবেগে আমরা গেয়ে উঠি, 'চিরদিন তােমার আকাশ তােমার বাতাস আমার প্রাণে বাজায় বাঁশি।' স্বদেশপ্রেমের মূলে রয়েছে বৃহত্তর ও সামগ্রিক এক জাতীয় চেতনা। একে আমরা বলি জাতীয়তাবােধ। স্বদেশপ্রেমে যখন আমরা উদ্বুদ্ধ হই তখন আমাদের ব্যক্তিগত স্বার্থ হয়ে যায় তুচ্ছ। সামগ্রিকভাবে জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় অগ্রগতি ও দেশের কল্যাণ হয়ে ওঠে আমাদের চিন্তা ও কর্মের প্রধান বিষয়।
স্বদেশপ্রেমের স্বরূপ: জন্মভূমির ভৌগােলিক ও সামাজিক পরিবেশের। আথে আমাদের গভীর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। দেশের মাটি, ভাষা, ঐতিহ্য ইত্যাদি আমাদের মনে শেকড় গাড়ে। এসবের প্রতি আমাদের ভালােবাসার আবেগময় প্রকাশই স্বদেশপ্রেম। কেবল মুখে দেশের জন্যে ভালােবাসার কথা বললেই স্বদেশপ্রেম প্রকাশ পায় না। এর প্রকৃত স্বরূপ পরিলক্ষিত হয় মানুষের চিন্তায়, কথায় ও কাজে। দেশের উন্নতিতে অবদান রাখা, দেশের মানুষের সাথে প্রাণখুলে মেশা, দেশের প্রকৃতিকে ভালােবাসা, প্রয়ােজনে দেশের স্বার্থে জীবন বিসর্জন দেওয়া ইত্যাদিতেই স্বদেশপ্রেমের প্রকৃত স্বরূপ নিহিত।
স্বদেশপ্রেমের পরীক্ষা: স্বদেশপ্রেমের প্রকৃত পরীক্ষা হয় দেশ ও জাতির সংকটময় মুহূর্তে। বিশেষ করে সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বার্থ রক্ষার সময়। সে সময় জাতীয় চেতনায় উজ্জীবিত প্রতিটি দেশপ্রেমিক দেশের স্বার্থে জীবনদানকে নিতান্ত তুচ্ছ মনে করে। যে মনটা করেছিলে ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিযােদ্ধারা। তাঁরাই এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান।
বাঙালির স্বদেশেপ্রেম: স্বদেশপ্রেমের পরীক্ষায় বার বার উত্তীর্ণ হয়েছে বাঙালি। ব্রিটিশ-বিরােধী স্বাধীনতার লড়াইয়ে জীবন দিয়েছেন তিতুমীর, সূর্যসেন, প্রীতিলতা প্রমুখ। ফাঁসির মঞ্চে জীবন উৎসর্গ করেছেন ক্ষুদিরাম, সূর্যসেন। জনগণকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে গিয়ে ব্রিটিশের দেওয়া 'নাইট' উপাধি বিসর্জন দিয়েছেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কারাবরণ করেছেন বিদ্রোহী কবি নজরুল। বায়ান্নর ভাষা-আন্দোলনে যাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষায় আত্মত্যাগ করেছেন সালাম-বরকত-রফিক- জব্বার প্রমুখ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্তি-সংগ্রামের নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের চরিত্রে স্বদেশ প্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত নিহিত। এছাড়া, মওলানা ভাসানী, কমরেড মণি সিংহ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, এইচ. এম. কামরুজ্জামান প্রমুখ ব্যক্তিত্ব দেশপ্রেমের উজ্জ্বল নিদর্শন রেখে গেছেন। বীর মুক্তিযােদ্ধাগণ দেশপ্রেমের মহান ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন। অর্জিত হয়েছে স্বাধীন স্বদেশ-ভূমি বাংলাদেশ। দেশের জন্যে মঙ্গলজনক নানা কাজেও মানুষ স্বদেশেপ্রেমের পরিচয় দেয়। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, রােকেয়া, জগদীশচন্দ্র বসু, জয়নুল আবেদীন, ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, সুফিয়া কামাল প্রমুখ মনীষীর অবদানের মধ্যেও রয়েছে দেশপ্রেমের পরিচয়।
ছাত্রজীবনে স্বদেশপ্রেম: ছাত্রজীবন হলাে স্বদেশপ্রেম অনুশীলনের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সময়। এ সময় দেশের সেবায় আত্মনিয়ােগের উপায়গুলাের চর্চা করতে হবে। যথার্থ উপায়ে জ্ঞানার্জন করে মানুষের মতাে মানুষ হতে পারলেই দেশের মঙ্গল হবে। তাই ছাত্রজীবনে অবহেলায় সময় নষ্ট না করে নিজেকে গড়ে তােলার সাধনায় রত থাকতে হবে।
স্বদেশপ্রেম ও বিশ্বপ্রেম: স্বদেশপ্রেমের মাঝেই নিহিত রয়েছে বিশ্বপ্রেমের অনুভূতি। বর্তমানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির কল্যাণে গােটা পৃথিবীটা ছােটো হয়ে এসেছে। পৃথিবীর প্রতিটি দেশ, প্রতিটি মানুষ পরস্পর নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত। তাই নিজের দেশকে যথার্থরূপে ভালােবাসা বিশ্বপ্রেমেরই নামান্তর। আবার যার মাঝে বিশ্বপ্রেম রয়েছে সে স্বভাবতই স্বদেশপ্রেমিক হয়ে ওঠে।
উগ্র জাতীয়তাবাদের বিপদ: অনেক সময় ©গ্র জাতীয়তাবাদ তথা সং জাতীয়তাবাদ মানুষকে অন্ধকারের দিকে ঠেলে দেয়। এ জাত্যভিমান পৃথিবীতে মহাযুদ্ধ ডেকে এনেছে, সৃষ্টি করেছে জাতিতে জাতিতে সংঘাত। তাই অন্ধ জাতীয়তাকে কখনো প্রশ্রয় দেওয়া উচিত নয় । মনে রাখতে হবে, সত্যিকারের স্বদেশপ্রেম মানবপ্রেমেরই অনুষঙ্গী। স্বদেশেপ্রেম যখন জাতিতে জাতিতে মৈত্রী ও ভ্রাতৃত্ব রচনা করে, তখনই স্বদেশপ্রেম হয় সার্থক।
উপসংহার: একুশ শতকে পদার্পণ করেছে মানবজাতি। ছােট হয়ে এসেছে পৃথিবী। শুরু হয়েছে দেশে দেশে, জাতিতে জাতিতে সহযোগিতার নতুন পর্ব। এই নতুন পরিস্থিতিতে অন্ধ স্বদেশপ্রেম যেন আমাদের আচ্ছন্ন না করে। দেশপ্রেমের মধ্যে দিয়েই আমাদের বিশ্বের মানুষকে ভালােবাসতে হবে। দেশপ্রেমের উত্তরণ ঘটাতে হবে বিশ্বপ্রেমে। এ চেতনা থেকে নিজের দেশের কল্যাণে ব্রতী হয়েই বিশ্বের কল্যাণে অবদান রাখতে হবে।
Post a Comment