SkyIsTheLimit
Bookmark

শীতের সকাল রচনা

ভূমিকা:  যড়ঋতুর দেশ বাংলাদেশ। প্রত্যেকটিরই রয়েছে আলাদা আলাদা রূপবৈচিত্র্য, আলাদা আলাদা বৈশিষ্ট্য। তবে শীতকালের বৈশিষ্ট্যাবলি অন্যান্য ঋতুর থেকে একেবারে পৃথক। শীতের সকালের আবির্ভাব কুয়াশাচ্ছন্ন অনন্যসাধারণ রূপ নিয়ে। বাংলাদেশের ঋতুচকে পৌষ ও মাঘ এ দুই মাস শীতকাল। প্রকৃতির সর্বত্রই এসময় পরিবর্তন লক্ষ করা যায়। শীতের সকালে জীবনের চাঞ্চল্য তেমন চোখে পড়ে না। শীত আড়ষ্ট করে তােলে জনজীবন। সকলেই রৌদ্রের প্রত্যাশায় থাকে। কিন্তু পূর্ব দিকে তখনও আলাের সুষমা পুরােপুরি ফুটে ওঠে না; অথচ বনে বনে পাখিদের হৃদয়ে তার গােপন সংবাদ সবার অলক্ষে ছড়িয়ে পড়ে। কিছুক্ষণের মধ্যেই কুয়াশার পর্দা সরিয়ে ছড়িয়ে পড়ে ভােরের ছায়ামাখা আলাে, বনে বনে পাখির কণ্ঠে ভেসে ওঠে মধুর আবাহন-গীতি। আমার গানের সুর-লহরা  ছড়িয়ে পড়ে দশ-দিগন্তে। অল্পসময়ের মধ্যেই আমাদের দ্বারে এসে দাঁড়ায় আলাে ঝলমল একটি সুন্দর সকাল। 
সূর্যোদয়ের পূর্বের শীতের সকাল : লেপের তলা থেকে উঠি উঠি করেও উঠতে ইচ্ছে হয় না। শিয়রে শীত যেন কেশর ফুলিয়ে থাবা পেতে বসে আছে। গরম বিছানার উত্তাপ ছেড়ে উঠতে গেলে কেমন এক অপ্রতিরােধ্য আলসেমি সমস্ত চেতনাকে আচ্ছন্ন করে রাখে। কর্মের আহ্বান সত্ত্বেও কেমন এক মধুর জড়তায় মানুষ আরামের শয্যায় পড়ে থাকে। 
শীতের সকালের রূপ : পূর্ব দিকে ধীরে ধীরে আলো ফুটতে থাকে। উত্তর দিক থেকে ঠাণ্ডা বাতাস একটি দীর্ঘশ্বাসের মতাে হঠাৎ শির শির করে বনের গাছগুলাের পাতার ফাঁক দিয়ে বয়ে যায়। পাতাগুলো সহসা কেঁপে ওঠে। টুপ টুপ করে শিশির ঝরে পড়ে। বনের পথ শিশিরসিক্ত হয়ে ওঠে। টিনের চালে এবং ঘাসে ঘাসে শিশিরের বিন্দু জমে ভােরের আলােয় ঝলমল করতে থাকে। দূরে কোথাও খেজুর-রস জ্বাল দেওয়া হচ্ছে। বাতাসে তার লােভনীয় মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছে। জ্বাল দেওয়া খেজুর-রসের ম-ম গন্ধ চারিদকি মাতাল করছে। গ্রামের কৃষকরা বলদ হাকিয়ে মাঠের দিকে চলছে। দূরে কোনাে মাদ্রাসায় ছােট ছােট ছেলেমেয়েরা সুর করে কোরআন তেলাওয়াত করছে। তখনই মন শাসন করে, সকাল হয়েছে। এখন বিছানায় পড়ে পড়ে গভীর আলস্যে তন্দ্রাসুখ উপভােগ করা অনুচিত। তাই অগত্যা গায়ের লেপ সরিয়ে বিছানা থেকে বের হওয়ার জন্যে সচেষ্ট হতে হয়। 
শীতের সকালের বৈরাগ্য মূর্তি : ততক্ষণে বাইরের পৃথিবীর ঘুম ভেঙেছে। দিকে দিকে কর্মের মুখরতায় শীতের সকাল কর্মব্যস্ত হয়ে উঠেছে। পূর্বদিগন্তে আলাে ছড়িয়ে সূর্যের রথ আকাশ পরিক্রমায় বের হয়ে পড়েছে। একটি নীলকণ্ঠ পাখি রিপত্র বাবলার ডালে বসে রােদ পােহাচ্ছে। এক জোড়া নাম না জানা পাখি ডানায় বাতাস তুলে কুয়াশার ভেতর দিয়ে কোন অজানার পানে ছুটছে। শীতের সকাল যেন এক প্রৌঢ়া কুলবধূ। তার মুখখানি দিগন্ত বিস্তৃত কুয়াশার অবগুণ্ঠনে ঢাকা। বেলা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে শীতের সকালও তার কুয়াশার অবগুণ্ঠন ধীরে ধীরে খুলতে থাকে। 
রূপ-বদল : ধীরে ধীরে বেলা বাড়তে থাকে। শীতের সূর্য পূর্ব-দিগন্তের কুয়াশার জাল ছিন্ন-ভিন্ন করে এক গভীর আলস্যে ওপরে উঠতে থাকে। তার কিরণবাণে কমতে থাকে শীতের তীব্রতা। সােনালি রােদে চারদিক ভেসে যায়। সে রােদের স্পর্শ শীতের সকালে যেন একবিন্দু শিশিরের মতাে টলমল করে কাপতে থাকে। 
গ্রামীণ জীবনে শীতকাল : গ্রামের অধিকাংশ মানুষ পেশাগত দিক থেকে কৃষির সাথে জড়িত। তাই শীতের সকালেও তাদের শীতের আরাম ও আনন্দকে উপভােগ করার সময় থাকে না। শীতের কুয়াশা ভেদ করে লাঙ্গল নিয়ে তারা ছােটে ফসলের মাঠে। শীতকাল ইরি ধান রােপণের প্রধান সময়। এ সময়ে কৃষকের বসে থাকলে চলে না। অন্যদিকে কৃষাণি বধূরাও সবজি খেতে শুরু করে পরিচর্যা, আবার কেউ তােলে শাকসবজি। শীতের কনকনে ঠাণ্ডা বার্ধক্য পীড়িতদের খানিকটা বেশিই চেপে ধরে। তাই ভাের হলেই খড়কুটোর আগুন জ্বালিয়ে তারা উষ্ণ করে নেয় তাদের শরীর। এ সময় শিশুরাও এসে যােগ দেয় আগুন পােহানােয়। আর মাঝে মধ্যে চলতে থাকে রসপূর্ণ গল্পকথা। ওদিকে পিঠে বানানোের ধুম পড়ে যায় রান্নাঘরে। গরম গরম পিঠা আর মিঠে রােদ সব মিলিয়ে যেন অভূতপূর্ব আনন্দের আয়ােজন। 
নগরজীবনে শীতকাল : নগরজীবনে সাধারণত শীতকে উপভােগ করার সুযােগ কম। নগরের উঁচু তলার মানুষেরা গরম কম্বল জড়িয়ে ঘুমিয়ে কাটায় শীতের প্রভাত। ফলে তাদের পক্ষে সকালের কুয়াশাচ্ছন্ন সুন্দর রূপ অবলােকন সম্ভব হয় না। অন্যদিকে চাকরিজীবী ও নিম্নবিত্ত মানুষ অফিসে  আর কাজে বেরিয়ে পড়ে নগরের পথে পথে। কুয়াশা ভেদ করে ছুটে চলে তারা নিজ নিজ গন্তব্যে। জীবনের ব্যস্ততা চোখে পড়ে নিয়ত। গাড়িগুলাে দিনের বেলাতেও হেডলাইট জ্বালিয়ে ছুটে চলে অবিরাম। এখানে শিশিরে পা ভেজে না, পিঠার গন্ধে বাতাস ব্যতিক্রম হয়ে ওঠে না। দরিদ্র এ দেশে শীত বস্তিবাসীর জন্যে নিয়ে আসে দুর্ভোগ। নগরে ভাসমান মানুষ হয় শীতের নির্মম শিকার। বাস্তুহীন শিশু-বৃদ্ধ-বৃদ্ধা ফুটপাতে, রেলস্টেশনে  গরম কাপড় ছাড়াই প্রচণ্ড শীতের সাথে লড়াই করে‌।উপসংহার : শহরে এবং গ্রামে শীতের সকাল দু রকমভাবে উপস্থাপিত হয়। শহরের ইট-কাঠ-পাথরের নিদারুণ চাপে শীতের সকাল তার নিজস্ব মূর্তিতে প্রকাশিত হতে পারে না। এখানে কুয়াশায় ঢাকা গ্রামের স্নিগ্ধ জৌলুস নেই। তার পরিবর্তে আছে কুয়াশা উপেক্ষা করে বিচিত্র সব গরম পােশাকে শরীর ঢেকে জীবিকা সন্ধানী মানুষের ছুটে চলা। শহরের রাজপথে শীতের রূপ ম্লান হলেও গরম চা ও পরােটার গন্ধে তাকে সংগােপনে আত্মপ্রকাশ করতে দেখা যায়। কিন্তু শীতের সকালের প্রধান আকর্ষণ খেজুরের রস, পায়েস, ভাপাপিঠা, পুলিপিঠা ইত্যাদির মনমাতানাে ঘ্রাণ শহরে বিরল |

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment