ভূমিকা : সৃষ্টির উষালগ্নে মানুষ একটিমাত্র সম্প্রদায় বা গােত্রে পরিচিত ছিল আর সে গােত্রটির নামই হলাে 'মানুষ'। কালের আবর্তে বিভিন্ন ধর্ম ও মতবাদের ওপর ভিত্তি করে মানুষ’ নামক এ শ্রেষ্ঠ জীব বিভিন্ন সম্প্রদায় ও শ্রেণিতে বিভক্তি লাভ করে। এ বিভাজনের ফলে মানুষের মধ্যে ধর্মীয় ও মতবাদগত অনৈক্য দেখা দেয় এবং একে অন্যের ক্ষতি সাধনে প্রলুব্ধ হয়। সম্প্রদায়গত এ সংকীর্ণ মানসিকতার ফলে মানুষ ভুলে যায় তার আসল পরিচয়। ফলে সৃষ্টি হয় সন্ত্রাস, হানাহানি, প্রতিহিংসার। একশ্রেণির যারা সবসময় সাম্প্রদায়িক বৈষম্য সৃষ্টিতে তৎপর। বাস্তবে চিন্তা করলে দেখা যাবে সব মানুষই এক ও অভিন্ন বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। এ শ্রেষ্ঠত্বের মূল কারণ হলাে মানুষের বিবেক ও মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গি। এ মানবতাকে মূল্য দিতে হলে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখতে হবে।
সাম্প্রদায়িকতা ও বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতি : বর্তমান বিশ্বে সাম্প্রদায়িকতার কালাে ছায়ায় ঘটে সবচেয়ে নিষ্ঠুর অমানবিক ঘটনাবলি। সাম্প্রদায়িকতার ফলে ঘটছে সভ্যতার চরম বিপর্যয়। দেশে দেশে সংখ্যালঘুদের ওপর চলছে অমানবিক নির্যাতন। সংখ্যাগুরুরা তাদের আধিপত্য বিস্তারের জন্যেই সংখ্যালঘুদের ওপর চালাচ্ছে অত্যাচারের স্টিমরােলার। সম্প্রদায়িক চেতনাই বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের ধারণাকে নস্যাৎ করে দিচ্ছে। অথচ পৃথিবীর সব ধর্মেই মানুষের শ্রেষ্ঠত্ব ঘােষণা করা হয়েছে এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বজায় রাখার জন্যে বলা হয়েছে 'ধর্মের ব্যাপারে কোনাে প্রকার বাড়াবাড়ি করা যাবে না। কিন্তু এ কথা এখন আর কেউ মানছে না। এ সাম্প্রদায়িকতার ফলেই হিটলার তার গ্যাস চেম্বারে লক্ষ লক্ষ ইহুদিকে হত্যা করেছে। অন্যদিকে ফিলিস্তিনের মুসলিমরা প্রতিনিয়ত নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। একই পরিস্থিতি মিয়ানমারসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিরাজ করছে। আবার শ্বেতাঙ্গ ও কৃষ্ণাঙ্গদের বিরােধ তাে লেগেই আছে। এ সাম্প্রদায়িকতা বিশ্বের অগ্রগতির পথকে রুদ্ধ করে দিচ্ছে।
মানবতার মুক্তি ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি : পৃথিবীতে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান, শিখ, জৈন ধর্মসহ অসংখ্য ধর্মের মানুষ বসবাস করে। আবার পেশার দিক দিয়েও বিভিন্ন পেশা ও বৃত্তিজীবী মানুষ সমাজে বসবাস করে। এদের মধ্যে আছে কামার, কুমার, মুচি, ডােম, কুলি, মালি, সুইপার। এরই | উ পাশাপাশি রয়েছে উচ্চবিত্ত ভদ্র, মার্জিত শিক্ষিত বুদ্ধিজীবী শ্রেণির মানুষ। এসব শ্রেণির মানুষরাই একই সারিবদ্ধ হয়ে কাজ করার মধ্য দিয়ে বর্তমান বিশ্বের অগ্রগতির ধারাকে এগিয়ে নিতে পারে। লাঞ্ছিত মানবতাকে মুক্তি দিতে হলে চাই সব ধর্মের সব মতবাদের ও সব শ্রেণির মানুষের এক হয়ে কাজ করার মানসিকতা। কবি এ সত্য উপলব্ধিকেই ছন্দোবদ্ধ চরণে ব্যক্ত করে বলেছেন :
'জগৎ জুড়িয়া এক জাতি আছে
সে জাতির নাম মানুষ জাতি।
এক পৃথিবীর স্তন্যে লালিত
একই রবি শশী মােদের সাথী।'
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির প্রয়ােজনীয়তা : সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি শুধু দেশ ও জাতীয় জীবনেই প্রয়ােজনীয় নয় বরং বিশ্ব সমাজ গঠনে ও বিশ্ব শান্তির জন্যে তা একান্ত প্রয়ােজন। হিংসাবিদ্বেষ, হানাহানি, কাটাকাটি, যুদ্ধবিগ্রহ, খুন, রাহাজানি সর্বদা বিশ্ব শান্তি ও বিশ্ব সমাজ গঠনের প্রধান অন্তরায়। আর এসবের মূল কারণই হলাে সাম্প্রদায়িক বিরােধ । তাই বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে এবং বিশ্ব সমাজ গঠনে ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় সব সম্প্রদায়কে সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে উঠে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও বাংলাদেশ : সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অন্যতম পীঠস্থান আমাদের বাংলাদেশ। সেই প্রাচীন কাল থেকেই এদেশে বিভিন্ন ধর্ম ও সম্প্রদায়ের মানুষরা পরস্পর মিলেমিশে বসবাস করে আসছে। একই বাড়িতে, একই মহল্লায় ও একই গ্রামে একসাথে বসবাস করছে হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান ও মুসলিম। এখানে মুসলিমদের ঈদ, হিন্দুদের পূজা, খ্রিস্টানদের বড় দিন এবং বৌদ্ধদের বৌদ্ধপূর্ণিমা পালিত হয় ধর্মীয় উৎসব হিসেবে। কারও উৎসবে কারও বিদ্বেষ নেই বরং আছে সাহচর্য, সহমর্মিতা, পারস্পরিক ভালােবাসা ও মহানুভবতা। এদেশের মানুষ একসাথে মিলেমিশে কলকারখানায় কাজ করছে এবং জাতীয় উন্নতিতে বড় রকমের অবদান রেখে চলেছে। জাতীয় দুর্দিনে এদেশের সকল মানুষ সাম্প্রদায়িক ভেদাভেদ ভুলে একই সাথে ঝাঁপিয়ে পড়ে। যার বড় উদাহরণ ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। এভাবে পাশাপাশি বসবাসের ফলে এদেশে কখনােই সাম্প্রদায়িক বিভেদ দেখা দেয়নি যা আমাদের জন্যে গৌরবের বিষয়। এদেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মহানমন্ত্রে দৃঢ়ভাবে আস্থাশীল।
সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠায় ছাত্রসমাজের ভূমিকা : সাম্প্রদায়িকতা এক দুরারােগ্য ব্যাধি। এ ব্যাধি দূরীকরণে সমাজের সুশীল নাগরিকদের পাশাপাশি ছাত্ররাও রাখতে পারে গুরত্বপূর্ণ ভূমিকা। তরুণ ছাত্রসমাজহ এদেশের আদর্শ সম্পদ। তারা কেবল শিক্ষা গ্রহণ করে এবং জীবিকার্জনের হাতিয়ার হিসেবেই অবলম্বন করবে না বরং শ্রদ্ধার মনােভাব, আন্তরিক মেলামেশা, ভাবের আদানপ্রদানের মধ্য দিয়ে তারা অনুভব করবে মানবতার মহান মহিমা। ছাত্রাবস্থায়ই ছাত্রদের সাম্প্রদায়িকতার অভিশাপ থেকে মুক্তির শপথ নিতে হবে। সম্প্রীতির মহাব্রত অনুষ্ঠানের তারাই হবে প্রধান পুরােহিত। শিক্ষার উদ্দেশ্য হওয়া উচিত ছাত্রদের সুকুমার বৃত্তিগুলাের যথাযথ বিকাশে সহায়তা করা ও মনুষ্যত্বের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা। যাতে করে শিক্ষার্থীরা সহজেই উপলব্ধি করতে পারে সবার উপরে মানুষ সত্য।
উপসংহার : আমরা বলতে পারি বর্তমান বিশ্ব উন্নতি, অগ্রগতি ও উৎপাদনশীলতায় বিশ্বাস করে। তাই আজ বিশ্ব জনমত যুদ্ধের বিপক্ষে, সন্ত্রাসের বিপক্ষে, সাম্প্রদায়িকতার বিপক্ষে। অগ্রগতিশীল বিশ্বে অগ্রগতি ও উন্নতির ধারাকে গতিশীল করার জন্যে প্রয়ােজন বিশ্ব শান্তি, বিশ্ব ভ্রাতৃত্ব ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠা। সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার উর্ধ্বে উঠে এক নতুন বিশ্ব প্রতিষ্ঠা করতে সকলকে একই শ্রেণিভুক্ত হয়ে কাজ করে যেতে হবে।
Post a Comment