SkyIsTheLimit
Bookmark

রচনা নারীর ক্ষমতায়ন

একবিংশ শতাব্দীতে নারীর ক্ষমতায়ন 
বা, নারীর ক্ষমতায়নে বাংলাদেশ
ভূমিকা : নারীর অবারিত কর্মক্ষেত্র প্রস্তুত ও নারীর ক্ষমতায়ন বাংলাদেশের মতাে উন্নয়নশীল দেশের জন্য খুবই জরুরি। কারণ, দেশের অর্ধেক জনগােষ্ঠীই নারী। কাজেই এ দেশে গঠনমূলক কোনাে কাজ করতে গেলে পুরুষের পাশাপাশি নারীদেরও ক্ষমতায়ন করতে হবে। নারীদেরকে অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও উন্নয়ন পরিকল্পনা থেকে দূরে রেখে কখনাে দেশের অগ্রগতি সম্ভব নয়। তাই শিক্ষার পাশাপাশি কর্মক্ষেত্রে নারীর প্রবেশাধিকার নিশ্চিত এবং সামাজিক রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে নারীদের অধিক হারে সম্পৃক্ত করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নারীরা যত বেশি প্রবেশাধিকার পাবে, তত তারা দেশের উন্নয়ন ও জাতিগঠনে বিশেষ অবদান রাখার সুযােগ পাবে। 
নারীর ক্ষমতায়ন কী : 'ক্ষমতায়ন শব্দটি অপেক্ষাকৃত আধুনিক। নারীর ক্ষমতায়ন বলতে বােঝায় ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ব্যক্তি অধিকার ও রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক সার্বজনীনতা সংরক্ষণ করে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে নারীর স্বকীয় ও সার্বভৌম সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা। নারীর ক্ষমতায়নের অর্থই হলাে মূলত, সমাজের প্রতিটি স্তরে এমন একটি পরিবেশ থাকবে যেখানে নারী স্বমহিমায় স্বাধীন ও মর্যাদার অধিকারী হয়ে উঠবে; নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে বস্তুগত, মানবিক ও জ্ঞান সম্পদের উপর। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য নারী জাগরণের অগ্রগদূত বেগম রােকেয়া, জননী সাহসিক বেগম সুফিয়া কামাল দীর্ঘদিন ধরে সংগ্রাম করেছেন। তারা সামাজিক পারিবারিক বন্ধন থেকে মুক্তি দিয়ে নারীকে ক্ষমতাবান ও সামর্থ্যবান করার নিরলস সাধনা করে গেছেন। 
নারীর ক্ষমতায়নের উদ্দেশ্য : দেশের সার্বিক উন্নয়নের চাকাকে ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের নারীদেরকে বিভিন্ন দিক দিয়ে ক্ষমতায়ন করতে হবে। কেননা দেশ ও জাতি গঠনে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও যদি অংশগ্রহণ করে তাহলে দেখা যাবে বাংলাদেশ একদিন সােনার বাংলায় পরিণত হবে। আমাদের দেশে প্রায় ১৬ কোটি মানুষের বসবাস। এর অর্ধেকের মতাে নারী সমাজ। সমাজের এই বৃহত্তর জনগােষ্ঠীকে উপেক্ষা করে কখনােই দেশের বৃহত্তম কিছু করা সম্ভব নয়। সমাজের যা কিছু মজ্গাল তা যদি করতে হয়, তাহলে নারীকে সাথে নিয়ে করতে হবে। নারী সমাজের অবদানের কথা স্বীকার করে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম বলেছেন- 
'বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর। 
অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।'
 জাতি গঠনে, দেশের উন্নয়নে যুগে যুগে নারীরা অসামান্য অবদান রেখেছে। তাই সব দিক বিবেচনা করে নারীর ক্ষমতায়ন বর্তমানে আবশ্যক। 
অন্যান্য দেশের তুলনায় বাংলাদেশের নারীদের অবস্থান : সময়ের চলমানতায় উন্নত বিশ্বের নারীরা পুরুষের পাশাপাশি রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে। কিন্তু সে তুলনায় বাংলাদেশের নারীর অবস্থান অত্যন্ত নাজুক। এখনাে বাংলাদেশের নারীরা পিতৃতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার কঠিন বেড়াজালে আবদ্ধ হয়ে বন্দি পাখির মতাে পরাধীন জীবন-যাপন করছে। পরিসংখ্যানে দেখা যায় বাংলাদেশের প্রায় ৮০% নারী গৃহকোণে বন্দি জীবনযাপন করছেন। তাদেরকে যদি শিক্ষাদীক্ষার সাথে সমাজ উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অংশগ্রহণ করানােনা যায়, তাহলে উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে আমরা চলতে পারব না। এক্ষত্রে সরকারের সাথে বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এন.জি.ও এবং সমাজের সমাজকর্মীদের অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে।
প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়ন : প্রশাসনে নারীদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে ১৯৭২ সালে সরকারি চাকরিতে ১০ ভাগ কোটা নারীর জন্য সংরক্ষণ করা হয়। পরবর্তী সময়ে পুলিশ, বিচার ব্যবস্থা, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়সহ নানা ক্ষেত্রে নারীদের অবস্থান বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের নারীর শ্রমশক্তির পরিমাণ প্রায় ২৫ মিলিয়ন। প্রায় ৭৯% নারী কাজ করে কৃষি ও বনায়ন খাতে, ৯.৯% নারী বিপনণ শ্রমিক, ০.৬% নিয়ােজিত করণিক পর্যায়ের কাজে। সীমিত সংখ্যক নারী জড়িত আছেন সরকারের প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ স্তরে। বর্তমানে সংরক্ষিত কোটা পদ্ধতি প্রচলন হওয়ায় নারীরা পুরুষের পাশাপাশি সরকারি বিভিন্ন দপ্তর, মন্ত্রণালয়, সচিবালয়সহ নানা সেক্টরে কাজ করতে পারেন। সংসদে ৬০ জন নারীর জন্য সংরক্ষিত মহিলা আসন রাখা আছে। তাছাড়া বর্তমান বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী ও বিরােধীদলীয় নেতাও মহিলা। বাংলাদেশে। বর্তমানে পােশাক শিল্পের রপ্তানি আয় প্রায় পয়ষট্টি ভাগ। আর এ ক্ষেত্রে নারী শ্রমিকদের অংশগ্রহণ প্রায় আশি শতাংশ। সুতরাং দেখা যায় জাতীয় আয়ের প্রায় পয়ষট্টি ভাগই নারীদের হাতে অর্জিত হয়। এটি সম্ভব হয়েছে। পােশাক শিল্পের নারী শ্রমিকদের কর্মসংস্থানের সুযােগ দেওয়ার কারণে।
বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়নে বিভিন্ন বাধা : মুষ্টিমেয় কিছু নারী সব ধরনর বাধা দূর করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হলেই সেটা নারীর ক্ষমতায়ন হয় না। দেশের অর্ধেক জনগােষ্ঠী যে নারী তারা সবাই সঠিকভাবে সমাজ তথা দেশ উন্নয়নে নিজেকে সকল প্রকার বাধা-বিঘ্ন দূর করে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করলেই হয় নারীর ক্ষমতায়ন। নারীর ক্ষমতায়ন এবং উন্নয়নে  নারীদের অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে কিছু বাধা বা প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। সেগুলাে নিচে তুলে ধরা হলাে: 
১. পুরুষ শাসিত সমাজে প্রচলিত ধ্যান-ধারণা ও মূল্যবােধই নারীর ক্ষমতায়নের প্রধান বাধা। কেননা পরিবার বা সমাজে পুরুষের মনগড়া কিছু মূল্যবোেধ রয়েছে। সেসব আচার-আচরণ ও সংস্কৃতিকে পদদলিত করে নারীরা কখনাে স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে না। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে এমন সব মূল্যবােধ তৈরি হয় যা নারীকে ছুঁড়ে ফেলে দেয় অন্ধকারের অতল গহবরে। সেখান থেকে নারীরা বেরিয়ে এসে শিক্ষার আলাে পায় না, স্বাবলম্বী হতে পারে না। সর্বোপরি তাকে ১. আর্থিক ও মানসিক ভাবে পুরুষের দয়ার ওপর নির্ভরশীল হতে হয়। 
২. দেশের বিদ্যমান আইনও নারীর ক্ষমতায়নের বিপক্ষে। সংবিধানে নারী-পুরুষের সম অধিকারের কথা বলা হলেও তা কেবল কাগজ- কলমের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বাস্তুবে তা আদৌ কার্যকর হয় না। যৌতুক, মানসিক ও শারীরিক নির্যাতন, ধর্ষণ, এসিড নিক্ষেপ প্রভৃতি জঘন্য অমানবিক অপরাধের শাস্তির বিধান থাকলেও অপরাধারা  আইনের ফাঁক ফোকর দিয়ে বেরিয়ে যায় মােটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে।
৩. সম্পত্তির উত্তরাধিকার, বিবাহ-বিচ্ছেদ, সন্তানের অভিভাবকত্ব সব কিছুই পুরুষের মর্জির ওপর নির্ভরশীল। আইনের কাঠামােগত দুর্বলতায় নারী হয় পদে পদে বঞ্চিত। তাছাড়া নারীরা সন্তান লালন-পালন করেও অভিভাবকত্ব পায় না।
৪. সমাজের রক্ষণশীল এমন কিছু স্বার্থপর মানুষ রয়েছে যারা নিজেদের স্বার্থে নারীদের অবদমিত করে রাখে। নারীমুক্তিকে তারা ধর্মের অবমাননার শামিল বলে মনে করে। আজও গ্রাম বাংলার অসংখ্য নারী রক্ষণশীল উগ্রবাদী ধর্মীয় ভাবাপন্ন কিছু সংখ্যক লােকের মনগড়া ফতােয়ার শিকার। এটিও নারীর স্বাবলম্বী হওয়ার পেছনে। অন্যতম বড় বাধা হিসেবে কাজ করে। 
নারীর ক্ষমতায়নের জন্য করণীয় : নারীর ক্ষমতায়নের জন্য নারীর দক্ষতাবৃদ্ধির পাশাপাশি তাদের সার্বিক অবস্থা পরিবর্তনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ অত্যাবশক। নিচে নারীর ক্ষমতায়নের কিছু বাস্তব কার্যকরী পদক্ষেপ তুলে ধরা হলাে -
  • নারীদেরকে শিক্ষিত করা : নারীদেরকে তাদের অধিকার, দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তােলার জন্য প্রথমে তাদেরকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে। শিক্ষার আলােয় আলােকিত হলে তারা নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে সমাজে স্বাধীনতা ও মত প্রকাশের অধিকার আদায় করতে পারবে।
  •  যে কোনাে কাজে অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ : নারীকে সমাজের সকল উন্নয়নমূলক কাজ কর্মে অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। যে কোনাে বিষয়ের সিদ্ধান্ত দেওয়ার ক্ষমতা দিলে নারীরা ক্ষমতায়ন ফিরে পাবে।
  •  মিডিয়াতে নারীদের মর্যাদা প্রদান : বিভিন্ন গণমাধ্যমে নারীদেরকে নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন না করে তাদেরকে যথাযােগ্য মর্যাদা ও সম্মান দিতে হবে।
  •  নারীর কাজের মূল্যায়ন : নারীদের বিভিন্ন কাজকর্মের যথাযথ স্বীকৃতি দিয়ে কাজের প্রতি উৎসাহিত করতে হবে। তাদের গৃহস্থালি যাবতীয় কাজকর্মের মূল্যায়ন করতে হবে। কোনাে কাজকেই হেয় বা খাটো করে দেখা চলবে না। বরং নারীদেরকে সকল কাজে পুরুষের সহযােগতাির হাত বাড়াতে হবে। 
  • প্রচলিত আইন সংশােধন : বিয়ে, বিয়ে বিচ্ছেদ, সন্তান ধারণে পূর্ণাঙ্গ স্বাধীনতা, সম্পত্তিতে সম অধিকার, অভিবাবকত্ব প্রভৃতি বিষয়ে যে আইন বর্তমানে প্রচলিত তা সংশােধন করে নারী স্বার্থরক্ষাকারী আইন প্রবর্তন করতে হবে।
নারীর ক্ষমতায়নে বর্তমান সরকারের সাফল্য : বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী একজন নারী। তাই তিনি নারীর অধিকার ও ক্ষমতায়নে গুরুত্বপূর্ণ  পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। সম্প্রতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জাতিসংঘ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত ৭১ তম অধিবেশনে নারীদের জন্য টেকসই ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের লক্ষ্যে সুযােগ সম্প্রসারণ এবং কর্মক্ষেত্রকে প্রসারিত করতে ওমেনস লিডারশিপ অ্যান্ড জেন্ডার পার্সপেক্টিভ অন প্রিভেন্টিং অ্যান্ড কাউন্টারিং ভায়ােলেন্স এক্সট্রিমিজম' শীর্ষক এক পার্শ্ব বৈঠকে আহ্বান জানান। তাছাড়া বাংলাদেশের নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বব্যাংকসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ বর্তমান সরকারের ভূয়সী প্রশংসা করেছেন। নারীর ক্ষমতায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২১শে সেপ্টেম্বর ২০১৬ জাতিসংঘ উইমেন প্লানেট ৫০-৫০ চ্যাম্পিয়ন এবং গ্লোবাল পার্টনারশিপ ফোরাম এজেন্ট অব চেজ অ্যাওয়ার্ড গ্রহণ করেন। 
উপসংহার : নারীর ক্ষমতায়ন যে কোনো দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। একটি দেশের অর্থনৈতিক সমাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীকে সামর্থ্যবান ও ক্ষমতাবান করার জন্য নারীর উন্নয়নের কোনাে বিকল্প নেই। নারী মুক্তি তখনই সম্ভব হবে যখন সমাজের নারীরা সমাজ, রাষ্ট্র, তথা আন্তর্জাতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ করবে। এতে নারীর ক্ষমতায়নের সকল প্রতিবন্ধকতার অবসান হবে। এক কথায় বলা যায়, অদূর ভবিষ্যতে নারীর ক্ষমতায়ন যত বৃদ্ধি পাবে জাতিগঠনে নারী সমাজের ভূমিকারও তত প্রবৃদ্ধি ঘটবে।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment