সূচনা: বাঙালি জাতির ইতিহাসে একটি উজ্জ্বল অধ্যায় বিজয় দিবস। লাখাে শহিদের আত্মত্যাগ, স্বজন হারানোর বেদনা ও বীরত্বপূর্ণ সংগ্রামের ভেতর দিয়ে ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর অর্জিত হয় মুক্তিযুদ্ধের বিজয়। এ দিনে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী পরাজয় স্বীকার করে। তাদের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে জন্ম হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। তাই বিজয় দিবস আমাদের আত্মমর্যাদা, বীরত্ব ও সার্বভৌমত্বের প্রতীক।
বিজয় দিবসের ইতিহাস: বাংলাদেশের বিজয় দিবসের পটভূমিতে রয়েছে দুই দশকের আন্দোলন-সংগ্রামের ইতিহাস। সে ইতিহাসের এক অনন্য মাইল ফলক ভাষা আন্দোলন। এ আন্দোলনের মধ্য দিয়ে উন্মেষ ঘটেছিল বাঙালির ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনার। এই চেতনা ক্রমে বিকশিত হয়ে স্বাধিকার আন্দোলনে পরিণত হয়। এরপর ১৯৬২-র শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬-র ছয় দফা আন্দোলন, ১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের মধ্য দিয়ে জাতি ধীরে ধীরে স্বাধীনতার দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এরপর ১৯৭১ সালে ৭ই মার্চে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ভাষণের মাধ্যমে স্বাধিকার আন্দোলন চরম শক্তি লাভ করে। বাঙালি জাতি স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী অতর্কিতে হামলা চালায় নিরস্ত্র বাঙালির ওপর। তারা নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ চালায় পিলখানা, রাজারবাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে। মধ্যরাতের পর হানাদার বাহিনীর হাতে গ্রেফতার হন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। গ্রেফতারের পূর্বেই, অর্থাৎ ২৬শে মার্চের প্রথম প্রহরে তিনি বাংলাদেশের প্রথম স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। তাঁর স্বাক্ষরিত ঘােষণা বার্তাটি তকালীন ইপিআর-এর ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে চট্টগ্রামে প্রেরণ করা হয়। এরপর চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র' থেকে ২৬ ও ২৭শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর নামে প্রচারিত হয় স্বাধীনতার ঘােষণা। সারা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে স্বতঃস্ফূর্ত মুক্তির সংগ্রাম। নয় মাস সশস্ত্র সংগ্রামের পর বিজয় ছিনিয়ে আনে মুক্তিযােদ্ধারা। শেষে পাকিস্তানি বাহিনী পরাজয় স্বীকার করে আত্মসমর্পণ করে। ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে এ ঐতিহাসিক ঘটনাটি সংঘটিত হয়েছিল। এ দিনটি পরবর্তীকালে জাতীয় ইতিহাসে বিজয় দিবস হিসেবে মর্যাদা পায়।
বিজয় দিবসের উৎসব: স্বাধীনতার জন্যে যারা জীবন উৎসর্গ করেছেন সেই সব বীর শহিদের পবিত্র স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে এই দিনের প্রথম প্রহরে সাভারে অবস্থিত জাতীয় স্মৃতিসৌধে তােপধ্বনির মাধ্যমে দিবসটির কার্যক্রম সূচনা করা হয়। মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মননীয় প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রীপরিষদের অন্যান্য সদস্যসহ সর্বস্তরের মানুষ এদিন জাতীয় বীরদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে। বিজয় দিবসের দিন সারা দেশে লাল-সবুজের সাজ দেখা যায়। বাড়ির ছাদে, দোকানে, রাস্তার পাশে, গাড়ির সামনে, স্কুল-কলেজে, এমনকি রিক্সার হ্যান্ডেলেও শােভা পায় আমাদের লাল-সবুজ পতাকা। রাজধানী ঢাকার রাস্তায় রাস্তায় বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গােষ্ঠী আয়ােজন করে নানা অনুষ্ঠানের। স্বাধীনতার আবেগে উদ্বেলিত নারী-পুরুষ উৎসবের সাজে সেজে সেখানে জড়াে হয়। স্কুল-কলেজে ছাত্রছাত্রীরা নানা রকম অনুষ্ঠানের আয়ােজন করে। এদিন সকালবেলা ঢাকার জাতীয় প্যারেড স্কয়ারে সামরিক কুচকাওয়াজের আয়ােজন করা হয়। সব ধরনের প্রতিরক্ষা বাহিনীর সদস্যরা ঐ কুচকাওয়াজে অংশ নেয়। মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্য, কূটনীতিবিদ, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গের উপস্থিতিতে হাজার হাজার মানুষ এ কুচকাওয়াজ উপভােগ করেন। চট্টগ্রামে বিজয় দিবস উপলক্ষে ৭ দিনব্যাপী ঐতিহ্যবাহী বিজয় মেলার আয়ােজন করা হয়। চট্টগ্রাম এবং তার আশেপাশের এলাকা থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এই মেলা দেখতে আসে। দেশের প্রতিটি জেলায় উৎসবমুখর পরিবেশে এ দিনটি পালিত হয়।
তাৎপর্য: দেশ স্বাধীন হবার পর পেরিয়ে গেছে অনেকগুলাে বছর। কিন্তু বিজয় দিবসের গুরুত্ব কমেনি এতটুকু। এই দিনটির মাধ্যমেই আমরা নতুন প্রজন্মকে এবং বিশ্বকে বারবার মনে করিয়ে দেই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের কথা, শহিদদের কথা। মনে করিয়ে দেই, বাংলাদেশ নামে একটি দেশের গৌরববাজ্জ্বল ইতিহাসের কথা, যা প্রতিটি বাঙালি তার হৃদয়ে ধারণ করে আছে।
উপসংহার: বিজয় দিবস কেবল আমাদের বিজয়েরই দিন নয়, এটি আমাদের চেতনা জাগরণেরও দিন। তাই এই দিনে প্রতিটি বাঙালি নতুন করে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয় দেশকে গড়তে। সবার প্রত্যাশা, বিশ্ব সভায় আমরাও যেন সবার সামনের সারিতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারি, গণতন্ত্রকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারি, অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করতে পারি, অশিক্ষা ও দারিদ্র্য থেকে দেশকে মুক্ত করে একুশ শতকের অগ্রযাত্রায় সামিল হতে পারি। তাহলেই আমাদের শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীনতার বিজয় যথার্থ অর্থবহ হয়ে উঠবে।
Post a Comment