পরিবেশ দূষণের পরিণাম
অথবা পরিবেশ দূষণ ও বাংলাদেশ
ভূমিকা : মানুষের চারপাশে যা আছে তাই নিয়ে তার পরিবেশ। এ পরিবেশ আবার দু প্রকার প্রাকৃতিক পরিবেশ ও মানবসৃষ্ট পরিবেশ। সভ্যতার বিবর্তনের ফলে মানুষ একে একে গড়ে তুলেছে নিজেদের পরিবেশ। বিজ্ঞান প্রযুক্তি আয়ত্ত করার ফলে মানুষ অনেকাংশেই হয়ে উঠেছে পরিবেশের নিয়ন্ত্রক আর প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে মানুষ পরিবেশকে নিজের স্বার্থে ধ্বংসও করছে। এর ফলে নষ্ট হচ্ছে প্রাকৃতিক ভারসাম্য।
পরিবেশ দূষণের কারণ : জনসংখ্যা বৃদ্ধি পরিবেশ দূষণের অন্যতম কারণ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির ফলে প্রাকৃতিক সম্পদ জল মাটি বায়ুর ওপর পড়েছে। প্রচণ্ড চাহিদার চাপ। শুরু হয়েছে বনসম্পদ বিনষ্টির অমিত উল্লাস। একই সঙ্গে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উদ্ভিদজগৎ ও প্রাণিজগৎ। প্রকৃতি ও পরিবেশের ভারসাম্য এসে পৌছেছে এক সংকটজনক অবস্থায় । এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ক্রমবর্ধমান হারে শক্তি উৎপাদনের চাহিদা। শক্তি উৎপাদনের সাথে সাথে নির্গত হয় মানুষের স্বাস্থ্য ও পরিবেশ-দূষক নানা রাসায়নিক পদার্থ। রাসায়নিক দ্রব্যই নানাবিধ দুরারােগ্য ব্যাধির দ্রুত প্রসারণের কারণ। এতে বায়ু, জল, খাদ্যদ্রব্য মারাত্মকভাবে দূষিত হচ্ছে।
পরিবেশ দূষণের ধরন : আমাদের পরিবেশ দূষণকারী অপদ্রব্যগুলাে মােটামুটি দু ভাগে বিভক্ত। এক প্রাকৃতিক, দুই কৃত্রিম। প্রাকৃতিক দূষণের মধ্যে রয়েছে সিসা, পারদ, সালফার ডাই-অক্সাইড, কার্বন ডাই-অক্সাইড কার্বন মনােক্সাইড ইত্যাদি। এর মধ্যে কতকগুলাে আবার আমাদের মল মূত্র, শরীরের পচন থেকে উৎপন্ন। তার ওপর আছে কৃত্রিম-দূষকের সমস্যা। কৃত্রিম-দূষকের অন্তর্গত হলাে নানা কীটনাশক, গুঁড়াে সাবান, ঔষধপত্র ও প্রসাধনসামগ্রী, এমনকি প্লাস্টিকও। এসব যৌগের কয়েকটি আমাদের পরিবেশে বহুদিন ধরে টিকে থাকে। রােদ, জল, বাতাস, জীবাণু এর কোনাে ক্ষতিই করতে পারে না। এ ধরনের যৌগ নিয়েই পরিবেশ বিজ্ঞানীদের দুশ্চিন্তা বেশি। কেননা কিছুদিন আগেও পৃথিবীর বুকে এ ধরনের যৌগের অস্তিত্ব ছিল না।
বায়ুদূষণ : দূষণের প্রকৃতি ও পদ্ধতির মধ্যেও রয়েছে বিভিন্নতা। আমাদের প্রাকৃতিক সম্পদের অন্যতম সম্ভার হলাে বায়ু। সেই বায়ু দূষণ আজ সারা বিশ্বজুড়ে। সকলের স্বাস্থ্যের পক্ষেও এ এক গুরুতর সমস্যা। ঝুলজাতীয় কাকা থেকে শুরু করে ভারি ধাতু, জটিল জৈব যৌগ, নিউক্লীয় আবর্জনা, জীবাশ্ম জ্বালানি অর্থাৎ তেল কয়লা ইত্যাদি পুড়িয়ে কার্বন ডাই-অক্সাইড বাতাসে ছড়িয়ে দেওয়া ক্লোরােফ্লুরােকার্বন, নাইট্রাস অক্সাইড, আলােক রাসায়নিক ধোঁয়াশা ইত্যাদি সবই হলাে বায়ু দূষণের প্রধান উপকরণ। বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ প্রতিনিয়ত বাড়ছে। এর ফলে জলবায়ুর তাপমাত্রা ক্রমশই বেড়ে চলেছে। অকাল-বর্ষণ, ঝড়ঝঞ্জা, কুয়াশা এরই ফলশ্রতি। কুয়াশা আর তেল-কয়লা দহনের ফলে নির্গত গ্যাসের মিশ্রণে ধোঁয়াশার সৃষ্টি। তার ক্ষতিকারক ক্ষমতা মারাত্মক। মাথাধরা, শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, দীর্ঘস্থায়ী ব্রংকাইটিস, ফুসফুসের ক্যান্সার এ জাতীয় দূষণের ফল। বিভিন্ন যানবাহনের নির্গত ধোয়া সূর্যের আলাের সংস্পর্শে এসে তৈরি করে আলােক রাসায়নিক ধোঁয়াশা। অক্সাইড ও হাইড্রো কার্বনের বিক্রিয়ায় আরও কিছু বায়ু দূষকের সৃষ্টি হয়। ওজোন গ্যাস ও পারক্সি- অ্যাসিটাল নাইট্রেট তার অন্যতম। এতে তরকারি ও শস্যের ক্ষতির পরিমাণ মারাত্মক। এ ছাড়া আরও একধরনের বায়ুদূষক আবহাওয়ায় ছড়িয়ে থাকে। ওগুলাে হলাে বাতাসে ভেসে বেড়ানাে জীবাণু। এ্যালার্জিজনিত রােগে এসব জীবাণুর ভূমিকা অনেকখানি।
পানি দূষণ : পানি দূষণ আধুনিক সভ্যতার আর এক অভিশাপ। পৃথিবীর সমুদ্র, নদ-নদী, পুকুর, খাল-বিল ইত্যাদির পানি নানাভাবে দূষিত হচ্ছে। ভারী ধাতু, হ্যালােজেন নিষিক্ত হাইড্রোকার্বন, কার্বন ডাই-অক্সাইড, পেট্রোলিয়াম, কৃত্রিম তেজস্ক্রিয় উপাদান, সর্বোপরি সংলগ্ন শহরের নির্গমন নালী বেয়ে আসা দূষিত তরল আবর্জনা এগুলোই হলো সমুদ্র দূষণের প্রধান উপকরণ। তা ছাড়া পারিপার্শ্বিক আবহাওয়ার পরিবর্তনও সমুদ্র দূষণের কারণ। নদীর তীরে গড়ে উঠেছে সমৃদ্ধ জনপদ, শহর । প্রতিষ্ঠিত হয়েছে আধুনিক চটকল, কাপড় কল, কয়লা ধােলাই কল, চিনি কল, কাগজের কল, ভেষজ তেল তৈরির কারখানা, চামড়া পাকা করার কারখানা ইত্যাদি। এসব কল-কারখানার বর্জ্য পদার্থ প্রতিনিয়ত নদ-নদীকে দূষিত করছে। পুকুর, খাল-বিল দূষণের জন্যে নালা-নর্দমা, ঘর-বাড়ির আবর্জনা ইত্যাদি দায়ী। এর থেকেই দূষিত হয় মাটি, দূষিত হয় পানীয়জল। সমুদ্র, নদী, খাল-বিল, পুকুরের মাছেও নানারূপ দূষণ ঘটছে। ছড়িয়ে পড়ছে নানারকমের সংক্রামক রােগ। মাঝে মাঝে তা মহামারি আকার ধারণ করে। মৃত্যু এসে ছিনিয়ে নিয়ে যায় অসংখ্য জীবন। এমন করেই দিনের পর দিন জনস্বাস্থ্য বিনষ্ট হচ্ছে।
শব্দ দূষণ : শব্দ দূষণ এ যুগের এক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। শহরে শব্দ দূষণের মাত্রা সর্বাধিক। প্রতিনিয়তই এখানে মােটর গাড়ির হর্ন, কল-কারখানার বিকট আওয়াজ, বাজিপটকার শব্দ, রেডিও, টেলিভিশনের শব্দ, লােকজনের চিকার চেঁচামেচি, উৎসবের মত্ততা, মাইকে চড়া সুর, সব মিলে-মিশে শব্দদূষণ সৃষ্টিরমহাযজ্ঞ চলছে। শব্দ দূষণের পরিণাম ভয়াবহ। এর ফলে অনেক ক্ষেত্রে শ্রবণ-ক্ষমতার বিলােপ ঘটে। মানসিক বিপর্যয় দেখা যায়, রক্তচাপ বেড়ে যায়। অনিদ্রা রােগের শিকার হয় মানুষ। হৃৎস্পন্দন বৃদ্ধি ও স্নায়বিক অস্থিরতাও শব্দ দূষণের পরিণাম। শব্দের ২০ থেকে ৪০ ডেসিবল পর্যন্ত মাত্রা হলাে স্বাভাবিক। ঢাকায় এখন শব্দের মাত্রার পরিমাণ ৬০ থেকে ৬৫ ডেসিবল, কোথাও কোথাও ৮০ ডেসিবল।
তেজস্ক্রিয় দূষণ : আয়নকারী বিকিরণ তেজস্ক্রিয় দূষণের এক ক্ষমতাশালী উৎস। সায়ানাইড বা অন্যান্য বিকারকের তুলনায় এর তাপশক্তি দশ কোটি গুণ তীব্র। পারমাণবিক যুদ্ধ পারমাণবিক অস্ত্রের পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্যে তেজস্ক্রিয় দূষণের বিপদ সবচেয়ে বেশি নিহিত। ১৯৬৩-তে একটি মার্কিন নিউক্লীয় সাবমেরিন আটলান্টিক সাগরে হারিয়ে যায়। তা থেকে প্রচুর পরিমাণে তেজস্ক্রিয় পদার্থ ছড়িয়ে পড়ে প্রাকৃতিক পরিবেশে। নিউক্লীয় জ্বালানি উৎপাদন কেন্দ্রের আবর্জনা তার ক্ষতিকারক ক্ষমতা নিয়ে ৬০০ বছর টিকে থাকতে পারে। ১৯৪৫ সালে জাপানের হিরােশিমা-নাগাসাকিতে যে পারমাণবিক বােমা ফেলা হয়, তার প্রতিক্রিয়ায় এখনও সেখানে বিকলাঙ্গ শিশু জন্ম নিচ্ছে।
দূষণের প্রতিকার : দূষণের ভয়াবহ পরিণামের কথা ভেবে বিশ্বের সভ্য মানুষ আজ আতঙিকিত। কী উপায়ে এ ভয়ঙ্কর সমস্যার মােকাবেলা সম্ভব তা নিয়ে ভাবনা-পরিকল্পনার শেষ নেই। বায়ু দূষণের প্রতিকারের জন্যে গ্রহণ করা হয়েছে কল-কারখানার দহন-প্রক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রণ করে নির্গত দূষকের পরিমাণ কমানাের ব্যবস্থা। চেষ্টা চলছে নির্দিষ্ট এলাকায় যাতে দূষণের প্রভাব ঘনীভূত না হয় তার জন্যে দূষকগুলােকে আরও বড় এলাকাজুড়ে ছড়িয়ে দেওয়ার। চেষ্টা চলছে দহনে উৎপন্ন গ্যাসে অতিরিক্ত কোনাে পদার্থ মিশিয়ে দেওয়ার, যাতে নির্গত হওয়ার আগেই কোনাে কোনাে দূষক অপসারিত হতে পারে। তা ছাড়া গ্রহণ করা হয়েছে বৃক্ষরােপণ পরিকল্পনা | দূষণ-প্রতিরােধী উদ্ভিদের ব্যবহার খুবই জরুরি। সমুদ্র দূষণের প্রতিকারের জন্যে প্রয়ােজন বিভিন্ন উপদ্বীপ ও উপকূলীয় অঞ্চলে সমুদ্র দূষণের পরিমাণ নিয়মিত পরিমাপ করা, প্রয়ােজন সেসব এলাকায় দূষণ-বিরােধী পদক্ষেপ গ্রহণ করা। দূষিত পানিকে পানযােগ্য করে তুলতে হলে উপযুক্ত পরিস্রাবণ দরকার। শব্দ দূষণের কুপ্রভাব কমানাের প্রধান উপায় হলাে শব্দের ব্যবহার সম্পর্কে জনসাধারণকে সচেতন করে তােলা। প্রযুক্তিবিদ্যার সাম্প্রতিক অগ্রগতিতে এমন কতকগুলাে পদ্ধতির উদ্ভাবন হয়েছে, যাতে পরমাণু চুল্লির আবর্জনা-নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হয়েছে। এর ফলে নিউক্লীয় বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিবেশে কোনাে তেজস্ক্রিয় থাকবে না।
উপসংহার : পরিবেশ দূষণ সমস্যা নিয়ে আজ সকল দেশই চিন্তিত। মানবসভ্যতার অস্তিত্বই আজ সংকটের মুখােমুখি। ১৯৯২ সালে ব্রাজিলের রিও ডি জেনিরােতে অনুষ্ঠিত হয়েছে বারাে দিনব্যাপী ধরিত্রী সম্মেলন। আরও বহু সংস্থা পরিবেশ দূষণের মােকাবেলা করতে কাজ শুরু করেছে। আমেরিকা, রাশিয়া, সুইডেন, জার্মানি, জাপান, সিঙ্গাপুর ও অন্যান্য বহুদেশে জাতীয় স্তরে গঠিত হয়েছে পরিবেশ সংস্থা। বাংলাদেশের সংবিধানেও পরিবেশ দূষণ প্রতিরােধের শর্ত আরােপ করা হয়েছে। এখানেও প্রতিবছর ৫ই জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবসরূপে পালিত হচ্ছে। আজ পরিবেশ দূষণ মানবসভ্যতার জন্যে এক ভয়ংকর বিপদ। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যে একটি নিরাপদ পৃথিবী গড়ে তােলার লক্ষ্যে যে কোনাে মূল্যে পরিবেশ দূষণ রােধ করার প্রয়ােজন অনস্বীকার্য।
Post a Comment