SkyIsTheLimit
Bookmark

শিষ্টাচার রচনা

আদব-কায়দা
বা সৌজন্যবােধ ও শিষ্টাচার
ভূমিকা : আচার-আচরণ ও ব্যবহারের বলেই মানুষ যেমন অন্যের কাছে শ্রদ্ধার পাত্র হয়ে ওঠে, আবার এ আচরণ বা ব্যবহারই তাকে অন্যের কাছে অশ্রদ্ধার পাত্রে পরিণত করে। মার্জিত, রুচিশীল এবং বিনয়ী আচরণ হলাে শিষ্টাচার। শিষ্টাচারের মাধ্যমে সহজেই অন্যের মনে স্থান করে নেওয়া যায়। শিষ্টাচারের প্রাথমিক শিক্ষা পাওয়া যায় পরিবার থেকে। একজনের বাহ্যিক আচরণ দেখলেই তার পরিবারের অন্য সদস্যদের আচরণ সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায়। সমাজে সুন্দরভাবে বসবাসের প্রয়ােজনে শিষ্টাচারের জন্ম। শিষ্টাচার বা সৌজন্যেবােধ সমাজজীবনের বিকশিত শতদল। ভদ্রতা ও শিষ্টাচারের জন্যে চাই সুন্দর পরিবেশ ও জ্ঞানের আলাে। প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত নয়, এমন মানুষের নিকট থেকে কখনও ভদ্রতা আশা করা যায় না। কারণ অশিক্ষা থেকেই ঘটে অমার্জিত রুচির জন্ম। শিষ্টাচারী লােক সর্বত্রই মহীয়ান।
শিষ্টাচারে স্বরূপ : আত্মীয়-অনাত্মীয়, পরিচিত-অপরিচিত সকলের সঙ্গে প্রীতিপূর্ণ, রুচিসম্মত ব্যবহারই শিষ্টাচার। শিষ্টাচারে সকলেই মুগ্ধ হয়। শিষ্টাচার বলতে বাইরের মার্জিত ব্যবহারই শুধু নয়, নয় ভদ্রতার সামাজিক রীতি অনুসরণ; এর সঙ্গে যুক্ত আছে সুজনের মহৎ হৃদয়ের গভীর উষ্ণ স্পর্শ। আছে অন্তর-সৌন্দর্যের বিকশিত মহিমা। 
শিষ্টাচারের গুরুত্ব ও প্রয়ােজনীয়তা : সমাজজীবনে শিষ্টাচারের গুরুত্ব ও প্রয়ােজনীয়তা অনেক। শেক্সপিয়রের মতে- 'দরিদ্র অথচ সদাচারী এবং ভদ্রজনের কাছে দেশ-বিদেশ থেকে বন্ধুত্ব ও প্রীতির বাণী আসে। An honest man is the noblest work of God.' - পােপের এ কথাটি এ ক্ষেত্রে স্মরণীয়। প্রকৃতপক্ষে জীবনের সবক্ষেত্রে শিষ্টাচারের প্রয়োজন। শুধু ব্যক্তিস্বার্থে নয়, জাতীয় স্বার্থেও এর ভূমিকা অনন্য। পৃথিবীর যে কোনাে উন্নত দেশের দিকে তাকালে দেখা যায় যে, তাদের সকল উন্নতির মূলে রয়েছে শিষ্টাচার। শিষ্টাচার দিয়ে মানুষ অতি সহজে মানুষের মন জয় করে যে কোনাে কাজ উদ্ধার করতে পারে। শিষ্টাচার মানবসভ্যতার শ্রেষ্ঠ সম্পদের ক্রমপুঞ্জিত যােগফল, মানুষের অন্তর সমুদ্র মনজাত দুর্লভ অমৃত ফল।
ছাত্রজীবনে শিষ্টাচারের স্থান : ছাত্রজীবন ভবিষ্যতের পল্লবিত সৌন্দর্যের অস্ফুট পটভূমি। এ সময়টি তার শিষ্টাচার ও সৌজন্য আহরণের যথার্থ কাল। শিষ্টাচারের ছোঁয়াতেই ছাত্র হয় বিনীত ও ভদ্র। নতুন প্রাণ-সম্পদে হয় গৌরবান্বিত। ছাত্রজীবনে যে গুরুজনদের শ্রদ্ধা করতে শিখল না, যার উদ্ধত-অবিনীত ব্যবহারে শিক্ষক বিরক্ত, যার রূঢ় অমার্জিত আচরণে বন্ধুরা ক্ষুব্ধ-বেদনাহত, পরবর্তী জীবনেও তার একই আচরণের পুনরাবৃত্তি ঘটে। তখন সে হয় অশুভ-শক্তি, অকল্যাণের মূর্ত প্রতীক। সমাজের বুকে সে ছড়িয়ে দিয়ে যায় অমৃতের বদলে গরল। ছাত্রজীবনই মানুষের সুপ্ত সুকুমারবৃত্তি লালনের সময়। শিষ্টাচার তাে তার মনুষ্যত্ব অর্জনেরই সােপান। এরই মধ্যে আছে নিজেকে সুন্দর ও সার্থকতায় পরিপূর্ণ করে তােলার মহাশক্তি। বিনয়ী, ভদ্র ছাত্র শুধু শিক্ষকের স্নেহই পায় না, সে অর্জন করে শিক্ষকের আশীর্বাদ, অর্জন করে তাঁর সাহায্য। সৌজন্য ও শিষ্টাচারের অভাব ছাত্রকে অরিনীত, স্বার্থপর, নিষ্ঠুর করে তোলে। 
মানবজীবনে শিষ্টাচারের স্থান : জনৈক সাহিত্যিক বলেছেন যে, মানবজীবনের সবচেয়ে বড় গুণ শিষ্টাচার ও সৌজন্যেবােধ, মানবজীবনের সার্বিক কল্যাণে শিষ্টাচারের স্থান অতি উচ্চে। পৃথিবীর যে কোনাে মহামানবের সাফল্যের মূলে রয়েছে শিষ্টাচার । শিষ্টাচার মানুষকে সমাজের উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করে। সামাজিক জীবনকে করে সর্বাত্মক সুন্দর। তাই আমাদের জীবনের সবক্ষেত্রে শিষ্টাচারী হতে হবে । 
শিষ্টাচারহীনতার বর্তমান চিত্র : আজ সমাজের নানা ক্ষেত্রেই দেখা যায় শিষ্টাচারহীনতা ও সৌজন্যহীনতার নিষ্ঠুর চিত্র। দিন দিনই মানুষের উজ্জ্বলতা বাড়ছে। বাড়ছে তার সীমাহীন ঔদ্ধত্য। বাঙালির সামাজিক আচার-আচরণের যে শাশ্বত মূল্যবােধ, তা এখন বিদেশি বিজাতীয় ভাবধারায় পর্যুদস্ত। মানুষের মধ্যে জন্ম নিচ্ছে বিছিন্নতাবােধ। সৃষ্টি হচ্ছে মানুষে মানুষে বিরােধ। বিত্তবানের নির্লজ্জ ঔদ্ধত্য, প্রবলের সীমাহীন অত্যাচারে আজ শিষ্টাচার ও সৌজন্য দুর্বলের ভীরুতারই অসহায় প্রকাশ মাত্র। মানুষকে অপমান করতে পারলেই বুঝি দুর্বিনীতের তৃপ্তি। অবিনয়ে আজ আর তার লজ্জা নয়। দুর্ব্যবহার, দুমুখতা আর অগৌরবের নয়। দুর্বাক্য এখন বচন-অলংকার। শিষ্টাচার ও সৌজন্যবােধের সৌন্দর্য হারিয়ে মানুষ আজ নিঃস্ব, হৃদয়হীন। অন্তরের পুষ্পিত শতদল আজ ছিন্নভিন্ন। আজকের মানুষ হৃদয় ঐশ্বর্যের স্বর্গ থেকে নির্বাসিত। কিন্তু কেন তার জীবনে আজ এ নির্দয় অভিশাপ? কেন সে আজ এভাবে নিঃস্ব, দেউলিয়া হয়ে গেল? মানুষ একদিন কঠিন তপস্যা আর দীর্ঘ অনুশীলনের ফলে অর্জন করেছিল শিষ্টাচার ও সৌজন্যবােধ। একদিন তাে সে উপলব্ধি করেছিল এই তার গৌরব- আভরণ। তবু কেন মানুষ আজ হৃদয়ের ঐশ্বর্য-বঞ্চিত হয়ে এমন আত্মকেন্দ্রিক, এমন অন্তঃসারশূন্য? কেন মানুষ পুরােনাে মূল্যবােধে বিশ্বাস হারালাে, অথচ নতুন প্রত্যয়ের জন্ম হলাে না। বস্তুত শিষ্টাচারহীনতা আজ জাতির জীবনে চরম সর্বনাশ ডেকে আনছে। 
প্রতিকারের উপায় : আজ দিকে দিকে যখন সামাজিক অসাম্য, যখন ধনবানের উদ্ধত আচরণ, যখন বিচারের বাণী নীরবে-নিভৃতে কাঁদে, যখন নির্লজ্জ অশালীন ব্যবহারে মানুষ কুষ্ঠিত নয়, তখন তা সমাজের এক অন্তঃসারশূন্যতারই করুণ চিত্র। আজ যদি জাতিকে নতুন প্রাণসম্পদে 1. অনুপ্রাণিত করতে হয়, যদি জাতিকে মর্যাদার আসনে প্রতিষ্ঠিত করতে হয়, তবে নতুন করে প্রয়ােজন সৌজন্য ও শিষ্টাচারের উদ্বোধন। গ্রহণ করতে হবে এ দুর্লভ চারিত্রিক ঐশ্বর্য আয়ত্তের শিক্ষাসূচি। গৃহ-পরিবেশ, স্কুল কলেজ, সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান এগুলােই হলো তার যথার্থ ক্ষেত্র। এখান থেকেই মানুষ ভবিষ্যৎ জীবনের পাঠ নেবে। শিষ্টাচারের অনুশীলনই তাকে নম্র, সুন্দর করবে। সমাজ অমার্জিত ব্যবহার ও শিষ্টাচারহীনতার কলঙ্ক থেকে বাঁচবে। 
উপসংহার : শিষ্টাচারের ব্যাপারে আমাদের সকলকে সজাগ ও সচেতন থাকতে হবে। মূল্যবােধের অবক্ষয়ের এ ক্রান্তিলগ্নে শিষ্টাচার খুবই দরকার। মানুষের সবগুণের নির্যাস হলাে শিষ্টাচার। তা কারও একার ব্যাপার নয়। সবারই ঐকান্তিক প্রচেষ্টা আর প্রযত্নে শিষ্টাচার সম্পর্কে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌছানাে সম্ভব। শিষ্টাচার ও সৌজন্যবােধকে আজ আর এড়িয়ে গেলে চলবে না শিষ্টাচার ও সৌজন্যবােধের পুনঃপ্রতিষ্ঠার মাধ্যমে সার্থক হােক মানবসভ্যতা।


লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment