বা জীবন ধ্বংসকারী এডিস মশা
বা বাংলাদেশে ডেঙ্গুজ্বরের প্রভাব
ভূমিকা: ডেঙ্গু আমাদের দেশে একটি নতুন রােগ। বলতে গেলে গত বছর থেকেই নতুন করে ডেঙ্গুর শুরু। অর্থাৎ গত বছরের আগ পর্যন্ত ডেঙ্গু কোন জনস্বাস্থ্য সমস্যা ছিলাে না। যদিও বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু রােগী ধরা পরে ১৯৬৪ সালে তারপরে পরবর্তী চারদশকে এটি তেমন বাড়বাড়ায়নি। শুধু গেলবারেই কিছুটা প্রাদুর্ভাব ঘটে ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের ৩৯টি শহরে। প্রায় তিন সহস্রাধিক ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় এবং অর্ধশতাধিক মারা যায়। কিছুটা আতঙ্ককও ছড়িয়ে পড়ে দেশ জুড়ে। ডেঙ্গু গবেষকদের ধারণা মে/জুন থেকে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। ব্যাপারটা আসলে এ রকমই। যে সব দেশে ডেঙ্গু রােগের একবার প্রাদুর্ভাব ঘটে ওই সব দেশে প্রতিবছরই বছরের বিশেষ সময়ে এ রােগ দেখা দেয়। বিশেষ করে বর্ষার শুরুর দিকে এবং বর্ষার শেষের দিকের সময়কালে এ রােগের বিস্তার ঘটে বশি
উৎস : ডেঙ্গু রােগের বাহক এডিস মশা এ সময়ে বংশবৃদ্ধি করে। এডিস ইজিপটাই এবং এডিস এলবােটিষ্টাস নামক দুই প্রজাতির স্ত্রী মশা ডেঙ্গুরােগের বাহক। এই স্ত্রী মশাদের ডিম্ব পরিস্ফুটনের জন্য মানুষের রক্ত খাদ্য হিসেবে দরকার। তাই সফল প্রজননের নিমিত্তে তারা মানুষকে কামড়ায়। কোন শত্রুতা থেকে নয়। কোন বিপত্তিও ঘটে না। তবে সমস্যা হয় তখন যখন কোন এডিস মশা ডেঙ্গু আক্রান্ত কোন মানুষকে কামড়ায়। রক্তের সাথে ডেঙ্গু ভাইরাস চলে যায় মশকের দেহে। তখন ওই মশকীটি হয়ে ওঠে খুবই বিপজ্জনক। ডেঙ্গু ভাইরাস বাহী এই মশকী যাকে কামড়াবে সেই ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হবে।
রেশ লক্ষণ : দংশনের ৪-৬ দিনের মধ্যেই হঠাৎ ১০৪-১০৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট জুর ওঠে। মাথা ব্যথা হয়। চোখের ভিতরে পিছনের দিকে ভীষণ ব্যথা করে। বমি বমি ভাব হয় অথবা বমি হতে পারে। চামড়ায় কালচে ছােপ ছােপ, দাগ দেখা দেয়। এসব উপসর্গ দেখা দিলে ডেঙ্গু রােগ বলে সন্দেহ করা যায়। তবে তা অবশ্যই, ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুজ্বর। ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুজ্বর হলে ভয়ের কিছু নেই। চিকিৎসারও দরকার পরে না ৬-৭ দিনের মাথায় এমনিতেই ভালাে হয়ে যায়। তবে উপরােক্ত উপসর্গের সাথে যদি রক্তক্ষরণ থাকে অর্থাৎ নাক, মুখ, চোখ, যৌনাঙ্গ, মল ও মূত্রের সাথে রক্ত যায় তবে তা হেমােরেজিক ডেঙ্গুজ্বর ।
প্রতিকার : এ অবস্থায় রােগীকে দ্রুুত হাসপাতালে নেওয়া উচিত। উচ্চ প্রযুক্তিসম্পন্ন চিকিৎসা ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পারলে রােগীর অবস্থার উন্নতি সম্ভব। তবে চিকিৎসা দেরি হলে কিংবা যথাযথভাবে মনিটরিং না হলে রােগী মৃত্যুর দিকে চলে যেতে পারে। ডেঙ্গু হেমােরেজিক রােগীর চিকিৎসায় সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। যাদের ক্লাসিক্যাল ডেঙ্গুজ্বর হয়েছে তাদেরকে সবসময় সতর্ক থাকতে হবে যাতে এডিস মশকী কামড়াতে না পারে। একবার ডেঙ্গু আক্রান্ত কাউকে যদি ডেঙ্গুভাইরাসবাহী কোন এডিস মশকী কামড়ায় তবে তার হেমােরেজিক ডেঙ্গুজ্বর হবে-যা খুবই মারাত্মক পরিণতি বয়ে আনতে পারে।
মশা চেনার উপায় : আপনাকে চিনে নিতে হবে এ. ঘাতক এডিস মশা। খালি চোখে অন্যান্য মশাদের থেকে আলাদা করে চেনা সম্ভব নয়। দেখতে হবে ম্যাগনিফাইয়িং গ্লাস দিয়ে। এ মশার সারা শরীরে সাদা সাদা দাগ থাকে। বুকের উপর কাস্তের মত দুটি দাগ রয়েছে। কালাের উপর সাদা দাগ অন্যান্য মশারও থাকতে পারে তবে কাস্তের মত দাগ অন্য কোন মশার বুকে সাধারণত দেখা যায় না। আকারে বেশ বড় মশাটি। তবে এর চেয়েও বড় আকারের অন্য মশার অস্তিত্ব বিদ্যমান। তাই এডিস মশা চিনতে হলে অবশ্যই বুকের উপর ওই কাস্তের মত দাগ দেখে নিশ্চিত হতে হবে।
সাবধানতা : মশা চেনার এতােটা আয়ােজন সমসময় সম্ভব নাও হতে পারে। উচিত হলাে সকল মশা থেকেই সাবধানে থাকা। আমাদের বাসস্থান ও তার চারপাশে যে সকল মশা থাকে তারা ম্যালেরিয়া, ফাইলেরিয়া এবং ইয়লােফিভারের জন্যও দায়ী। কোন মশাই ভালাে মশা নয়। বিজ্ঞাপনের ভাষায়—সেটিই ভালাে মশা যেটি মৃত। আপনাকে সারাক্ষণ মশা মেরে বেড়াতে হবে। এটা কী সম্ভব কোন কাজ। কিছুটা সফল হতে পারেন মশার কয়েল, এরােসল ব্যবহার করে। মশারি ব্যবহার করতে পারেন ঘুমের সময়। এ ব্যাপারে আলস্য পরিহার করাই কিন্তু সঠিক সিদ্ধান্ত। তবে সবচেয়ে বুদ্ধিমানের কাজ হবে মশা যাতে জন্মাতে না পারে সে ব্যাপারে পদক্ষেপ নেয়া।
এডিস উৎপত্তি : এডিস মশা পরিষ্কারবদ্ধ পানিতে ডিম পাড়ে। ড্রেন নর্দমার ময়লা গন্ধ পানিতে ডিম পাড়ে না। সাধারণত ফুলের টবে, এসির নিচে, ফ্রিজের নিচে, ঢাকনাবিহীন পানির ট্যাঙ্ক কিংবা ঢাকনাবিহীন ড্রাম বা বালতির পানি, ভাঙা টায়ারে জমে থাকা পানি, আইসক্রীমের কৌটা, কনডেন্সড মিল্কের কৌটা, ভার্জিন কোকাকোলার ক্যান, মিনারেল ওয়াটারের খালি। বােতলে বৃষ্টির পানি জমা হলে সেখানে এডিস মশা ডিম পাড়ে। এসব পাত্র বা আধার যেখানে বৃষ্টির পানি জমা হতে পারে। সেগুলাে সংরক্ষণ করতে হবে। এভাবে বংশবৃদ্ধি রােধ করার মাধ্যমে প্রতিরােধ করা যেতে পারে ডেঙ্গু রােগ।
উপসর্গ : সুখবর হল-ডেঙ্গুর চিকিৎসা আছে। আমাদের দেশের একটি জাতীয় স্বাস্থ্য সংগঠন স্বাস্থ্যলােক'-এর এক জরিপে। দেখা গেছে ৮৫ শতাংশ মানুষ জানে যে, ডেঙ্গুর কোন চিকিৎসা নেই। আর এ কারণেই ডেঙ্গু আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে গেল। চিকিৎসা বিজ্ঞানে যেমন ম্যালেরিয়ার চিকিৎসা আছে, ডায়রিয়ার চিকিৎসা আছে, তেমনি ডেঙ্গুরও চিকিৎসা আছে। পূর্বে আলােচিত ডেঙ্গুর উপসর্গগুলাে দেখা দিলে প্রথমেই রােগীকে হাসপাতালে আনার ব্যবস্থা করতে হবে। হাসপাতালে পৌছানাের সময় সাপেক্ষ হলে যে সব ব্যবস্থা তৎক্ষণাৎ নিতে হবে তা হল রােগীকে বিশ্রামে রাখা, ওরস্যালাইন খেতে দিতে হবে, তাজা ফলের রস খেতে দিন, প্যারাসিটামল ট্যাবলেট খাওয়াতে পারেন। তবে তা অবশ্যই ডাক্তারের সাথে আলাপ করে ডােজ ঠিক করে নিতে হবে বয়স্কারা ৫০০ মিলিগ্রাম করে খেতে পারবেন কিন্তু বাচ্ছাদের মধ্যে যাদের বয়স ৫ বছরের কম অথচ ৪ বছরের বেশি তাদেরকে ৫০০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেটের অর্ধেক দিতে হবে। যাদের বয়স ১-৪ বছরের মধ্যে তাদেরকে ৫০০ মিলিগ্রাম ট্যাবলেটের ৪ ভাগের ১ ভাগ খেতে দিতে হবে। তদুপরি বয়স অনুযায়ী দিনে কতবার খাবে তা ঠিক করে নিতে হবে। তাই ডাক্তারের পরামর্শ খুবই জরুরী। তবে কোন এন্টিবায়ােটিক খেতে দিবেন না। এসপিরিন বা ব্যথানাশক কোন ঔষধও দেওয়া যাবে না। স্টেরয়েড দেওয়া যাবে না। এ সব ব্যাপারে একটু সাবধানী হবেন।
উপসংহার: যথাযথ চিকিৎসা হলে রােগীর উন্নতি সম্ভব। রক্তক্ষরণের পরিমাণ বেশি হলে ঝুঁকিও বাড়ে। সেপারেটেড প্লাটিলেট দেওয়ার ব্যবস্থা করতে পারলে এ ঝুঁকিও উত্তরণ সম্ভব। ঢাকা-চট্টগ্রামে বর্তমানে একাধিক প্লাটিলেট সেপারেটর মেশিন রয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রণালয় দেশী ও বিদেশী ডেঙ্গু গবেষক দ্বারা সারা দেশে প্রতুলসংখ্যক চিকিৎসককে ডেঙ্গু চিকিৎসার প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। সবশেষ কথা- 'ডেঙ্গু রােগের চিকিৎসা/অন্য রােগের মত/এখন খুবই সুলভরে ভাই/ভয় পাসনে অত?'
Post a Comment