বা কাজী নজরুল ইসলাম
বা তােমার প্রিয় কবি
ভূমিকা: যে কবির কাব্যে আছে মৃত্যুঞ্জয়ী চিরযৌবনের জয়ধ্বনি, অগ্নিবীণার সুর ঝংকার, যিনি ধীরস্থির অচ্ল বাংলা কাব্যে বয়ে এনেছিলেন দুর্বার কালবােশেখির ঝড়াে হাওয়া, তিনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, আমার প্রিয় কবি। এ পরাধীন জড়তাগ্রস্ত সমাজের বুকে তিনি সজ্ঞারিত করেছিলেন নবযৌবন।
বাংলা কাব্যে নজরুল: বিদ্রোহের জয়ধ্বজা উড়িয়ে ধূমকেতুর মতাে কাজী নজরুল ইসলাম আবির্ভূত হয়েছেন বাংলা কাব্যে। তাঁর 'বিদ্রোহী কবিতাটি বাংলা কবিতার ক্ষেত্রে তার স্বীকৃতির ছাড়পত্রস্বরূপ। উদাত্তকরণ্ঠে তিনি ঘােষণা করলেন-
'বল বীর
বল উন্নত মম শির
শির নেহারি আমারি নত শির ঐ শিখর হিমাদ্রীর।'
কেবল এ 'বিদ্রোহী' কবিতার মাধ্যমেই বাংলা কবিতার আসরে তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত হলেন। কবি নজরুল হলেন বাংলার 'বিদ্রোহী কবি'। কবির বিদ্রোহী আত্মার জন্মের মূলে যে অনুপ্রেরণা কাজ করেছিল, তা হলাে কবির প্রেম। কবি তার আত্মপ্রকাশে গেয়ে গেছেন-
'মম এক হাতে বাঁকা বাঁশের বাঁশরী
আর হাতে রণ তূর্য।'
কবিকণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে, 'জগতে আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, যেখানে আমি প্রেম পাইনি, সেখানেই বিদ্রোহ করেছি। কবি সত্য, সুন্দর ও মানবতার পজারি। সকল প্রকার অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সােচ্চারকণ্ঠ। তাই তিনি শাসক শ্রেণির শাসন-শােষণে ব্যথিত হয়ে ক্ষু্ধ কণ্ঠে উচ্চারণ করেন-
'বন্ধু বড় বিষ জ্বালা এ বুকে
দেখিয়া শুনিয়া খেপিয়া গিয়েছি।
তাই যাহা আসে কই মুখে।
রক্ত ঝরাতে পারি নাতাে একা
তাই লিখে যাই রক্ত লেখা।'
কৈশাের ও প্রথম যৌবন: কবি নজরুলের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। ছেলেবেলাতেই পিতৃহারা হয়ে নিদারুণ দারিদ্র্য আর অভিভাবকহীনতার জন্য বােহেমিয়ান হয়ে পড়েন। এ সময়ে লেটো গানের দলে গীত রচনা ও সুর সংযােজনা করার প্রয়াসের মধ্যে নজরুল প্রতিভার বিকাশ পরিলক্ষিত হয়। পরবর্তীতে তিনি লেখাপড়ার চেয়ে কর্মজীবনের প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়েন। প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে তিনি বাঙালি পল্টনে যােগদান করেন এবং সেনাবাহিনীতে যােগ্যতার পরিচয় দিয়ে হাবিলদার পদে উন্নীত হন।
প্রতিভার উৎস: প্রথম মহাযুদ্ধের অবসান হলে ছাঁটাইয়ের খাতায় নাম ওঠে নজরুলের। মহাযুদ্ধের স্মৃতি ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের দাবাগ্নি জ্বালিয়ে দুর্দান্ত আবেগ নিয়ে বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে আসেন বাংলার অখ্যাত হাবিলদার কবি। যুদ্ধক্ষেত্রে বসে রচিত তার কবিতা 'মুক্তি এরই মধ্যে পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এবার তিনি বিদ্রোহের বহ্নিচ্ছটা নিয়ে বাংলা কবিতার আসরে অবতীর্ণ হলেন। কোরআন, গীতা ও মহাভারতের গভীর জ্ঞান এবং আরবি, ফারসি, সংস্কৃত ও বাংলার শব্দ ভাণ্ডারের দুর্লভ চাবিকাঠি ছিল তাঁর হাতে। আর ছিল উদাত্তকণ্ঠ ও রাগ-রাগিণীর জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার কীর্তন-বাউল-জারি-সারি-ভাটিয়ালির প্রতি প্রাণের টান ও সেইসঙ্গে ফারসি গজলের প্রাণ মাতানাে সুর বাহার ।
বিদ্রোহী-যৌবনের কবি: নজরুল চিরযৌবনের কবি। দুর্বার প্রাণ-প্রাচুর্যই যৌবনের নিশ্চিত প্রাণ-স্পন্দন। সব ধরনের শােষণ-শাসন-শৃঙ্খলের বিরুদ্ধাচরণে আর দুর্জয় সাধনায় তিনি ছিলেন ব্রতচারী, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যুদ্ধ থেকে প্রত্যাবর্তনের পর নজরুল দেখলেন দেশ পরাধীনতার জিঞ্জিরে বন্দি। ধনিক শ্রেণি ও সাম্রাজ্যবাদীদের নির্লজ্জ শােষণে সমগ্র সমাজ যখন পরিণত হয়েছিল কঙ্কাল পরিকীর্ণ এক বিশাল শ্মশান ভূমিতে তখন তিনি গাইলেন-
'কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙে ফেল কর রে লােপাট
রক্ত জমাট শিকল-পূজার পাষাণ বেদী।' (ভাঙার গান)
সামাজিক জড়তা ও ক্লান্তিকর নৈষ্কর্ম্যের মধ্যে কালবােশেখি ঝড়ের মতাে তিনি আবেগজড়িত কণ্ঠে গাইলেন-
'মেনে শত বাধা টিকি হাঁচি
টিকে দাড়ি নিয়ে আজো বেঁচে আছি
বাঁচিতে বাঁচিতে প্রায় মরিয়াছি, এবার সব্যসাচী,
যা হােক একটা তুলে দাও হাতে, একবার মরে বাঁচি।'
নজরুলের বিদ্রোহ যেমন পরাধীনতার বিরুদ্ধে, তেমনি তাঁর বিদ্রোহ সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধেও। তাঁর দৃষ্টিতে সমস্ত সামাজিক বিভেদই কৃত্রিম ও মিথ্যে। তাঁর কথায়-
'ও কি চণ্ডাল। চমকাও কেন? নহে ও ঘূণ্যজীব
ও হতে পারে হরিশ্চন্দ্র, ওই শ্মশানের শিব!'
তার 'অগ্নিবীণা', 'বিষের বাঁশী', 'সর্বহারা', 'ফণি-মনসা' প্রভৃতি কাব্যগুলােতে মূলত বিদ্রোাহেরই সােচ্চার জয়ধ্বনি।
অসাম্প্রদায়িক নজরুল: ভারতবর্ষে একদিকে যখন স্বাধীনতার আন্দোলন প্রবল হয়ে ওঠে, অন্যদিকে তখন হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা চরম আকার ধারণ করেছিল। নজরুল তখন ডাক দিলেন-
'হিন্দু না ওরা মুসলিম?- ওই জিজ্ঞাসে কোন জন?
কাণ্ডারী, বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মাের মার।'
এভাবে তিনি হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে সম্প্রীতির মিলনমন্ত্র রচনা করে গেছেন। নজরুলের কাব্য তাই হিন্দু-মুসলমানের মিলন তীর্থ।
উপসংহার: নজরুল বিদ্রোহী কবি, ব্যথিত মানবাত্মার কবি, আমার প্রিয় কবি। তিনি তাে বিদ্রোহী যৌবনের কপালে জয়তিলক এঁকে দিয়ে তাকে 'দুর্গম গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার' উত্তরণের মন্ত্রে দীক্ষিত করেছেন। নজরুলের সৃজনশীল সৃষ্টিকর্ম আজও আমাদের প্রাণে দোলা দেয়। আমাদের অনুপ্রাণিত করে। আমাদের চলার পথে সঠিক নির্দেশনা দেয়। তাই তাে নজরুল গণজাগরণের কবি, নিপীড়িত মানুষের কবি এবং আমার প্রিয় কবি।
Post a Comment