SkyIsTheLimit
Bookmark

রচনা মানবজীবনে পরিবেশের প্রভাব

ভূমিকা :
মানুষ যে পারিপার্শ্বিকতার মধ্যে বসবাস করে তাই, তার পরিবেশ। পরিবেশ মানব সভ্যতা ও সমাজ ব্যবস্থার বহিঃপ্রকাশ। এটি মানব জীবনে মুখ্য প্রভাবকের ভূমিকা পালন করে। ম্যাকাইভাবে ভাষায়, "জীবন ও পরিবেশ ওতপ্রাতভাবে জড়িত।” মার্সটন বেটস বলেছেন, “পরিবেশ হচ্ছে সে সব বাহ্যিক অবস্থার সমষ্টি যা জীবনের বিকাশকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। মানুষের মধ্যে যে স্নেহ-প্রেমপ্রীতি, ভালােবাসা, চিন্তা=চেতনা, আশাআকাঙ্কষা, উৎসাহ, উদ্দোপনা, সুখ- শান্তি, শিক্ষা-দীক্সা ও কর্মপ্রেরণা প্রভৃতি লক্ষ্য করা যায় তা পরিবেশেরই দান। জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত পরিবেশ মানব জীবনকে আবেষ্টন করে রাখে এবং গভীরভাবে প্রভাবিত করে। সহজ কথায়, পরিবেশ হলাে পারিপার্শ্বিকতা।
পরিবেশের প্রকারভেদ : পরিবেশ বিভিন্ন প্রকারের। তন্মধ্যে প্রাকৃতিক পরিবেশ,সামাজিক পরিবেশ, সাংস্কৃতিক পরিবেশ, রাজনৈতিক পরিবেশ, পারিবারিক পরিবেশ, শিক্ষা পরিবেশ ইত্যাদি প্রধান। এসব পরিবেশের প্রভাবে মানব জীবন পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়।
মানব জীবনে পরিবেশের প্রভাব : পরিবেশে মানবজীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। শুরু থেকে সমাপ্তি পর্যন্ত পরিবেশ ব্যক্তিজীবনকে আবেষ্টন করে রয়েছে। একদিকে যেমন রয়েছে মাতা-পিতা, ভাই-বােন স্বামী-স্ত্রী, স্নে-ভালোবাসা ও প্রীতি -প্রেম, অন্যদিকে তেমনি আছে শিক্ষা-দীক্ষা, সংস্কৃতি -কৃষ্টি ও কর্মপ্রেরণার অনুরণন। উন্নত পরিবেশ মানুষকে দেয় সুরুচির আশীর্বাদ, সুশিক্ষার আলাে, উৎসাহ -উদ্দীপনার অনুভূতি এবং উন্নত জীবনবােধ। অপরদিকে মন্দ পরিবেশ জীবনে আনে স্বার্থপরতার নীচতা, অরুচিকর মানসিকতা, অসমাজিক মনােভাব এবং জীবন সম্পর্কে অসুস্থ ধারণা। দেশের যুবশক্তির জন্য সুস্থ ও উন্নত পরিবেশ একান্ত প্রয়ােজন যেন তাদের মধ্যে গড়ে উঠে বলিষ্ঠ জীবনবােধ, স্নে -মায়া-মমতার উন্নত আদর্শ এবং সহযােগিতা ও ঐক্যের মনােভাব।
পারিবারিক জীবনে পরিবেশের প্রভাব : পরিবার প্রতিটি মানুষের প্রথম বিচরণ ক্ষেত্রও। পরিবারে মা-বাবার স্নেহ, ভাই-বােনের আদর-ভালােবাসা নিয়েই প্রতিটি মানুষের জীবন বিকাশের প্রস্তুতি পর্বের গােড়াপত্তন ঘটে; শুরু হয় অনাগত জীবন নির্মাণের দীক্ষা। পরিবার সামাজিক জীবনের চিরঞ্জীব বিদ্যাপীঠ। শিষ্টাচার, সাধুতা, সততা, ন্যায়পরায়ণতা, নিয়মনিষ্ঠা, পারস্পরিক শুদ্ধবােধ ইত্যাদি গুণাবলি পরিবারেই অর্জন করতে হয়। মানবিক মল্যবােধ সম্পর্কে পরিবার যা শিক্ষা দেয় তাই পরবর্তী জীবনে বড় হয়ে দেখা দেয়। পারিবারিক পরিবেশ ত্রুটিপূর্ণ হলে পরবর্তী জীবনে তার চরম মূল্য দিতে হয়। 
সামাজিক জীবনে পরিবেশের প্রভাব : মানুষ সামাজিক জীব। সমাজবদ্ধ হয়ে বসবাস করাই মানুষের ধর্ম। তাই সমাজের কল্যাণ ও অকল্যাণ দুটোই মানব জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। উন্নত সামাজিক পরিবেশ মানব জীবনে বয়ে আনে সুরুচির আশীর্বাদ, সুশিক্ষার আলাে, উৎসাহ উদ্দীপনার অনুভূতি এবং উন্নত জীবনরােধ। সামাজিক পরিবেশ যদি নােংরা ও অনুন্নত হয় তাহলে তা সমাজিক জীবনে বয়ে আনে স্বার্থপরতা, নীচতা, অরুচিকর মানসিকতা এবং জীবন সম্পর্কে অসুস্থ ধারণা। সুস্থ সামাজিক পরিবেশ বিদ্যমান না থাকলে সুস্থ জীবন গড়ে উঠতে পারে না। সামাজিক পরিবেশের কারণেই মানুষের জীবন যাত্রায় ভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। তাই মানুষের জীবনের উন্নতি-অবনতি, গৌরব-অগৌরব এবং ব্যক্তিত্ব বিকাশে সামাজিক পরিবেশের গুরুত্ব অপরিসীম। 
সাংস্কৃতিক জীবনে পরিবেশের প্রভাব : সাধারণভাবে বলা যায়, মানুষের কার্যাবলি হল প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশের ফলাফল। প্রকৃতির সৃষ্ট বস্তু, যেমন ভূমি ও ভূমির উর্বরতা, জলবায়ু, উদ্ধিদ জগৎ, প্রভৃতির সমন্বয় প্রাকৃতিক পরিবেশ। তেমনি প্রযুক্তি, সাহিত্য, সমাজ জীবন প্রভৃতি মানুষের সৃষ্টি করা উপাদানসমূহের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত সমগ্র জ্ঞান ভাণ্ডার এবং জীবন পদ্ধতি হল সাংস্কৃতিক পরিবেশ। প্রকৃতি যেন বিশাল ক্ষেত্র। এ বিশাল ক্ষেত্রে সৃজনশীল মানবের উদ্যোগে যা সৃষ্টি হয়েছে তাই সংস্কৃতি। প্রকৃতির ভূমিকা সিন্ধান্তকারী নয়, তবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। প্রকৃতি মানুষের সম্মুখে অনেকগুলাে সম্ভাবনা তুলে ধরে। মানুষ তার জ্ঞানবৃদ্ধি প্রয়ােগ করে তার সৃষ্টি অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে ঐ সকল সম্ভাবনার কোনটিকে গ্রহণ করে এবং অগ্রগতির পথে অগ্রসর হয়। সুস্থ সাংস্কৃতিক পরিবেশ ব্যক্তিমনে গভীর রেখাপাত করে। ফলে সমাজ জীবনে নেমে আসে বিরাট পরিবর্তন। সাংস্কৃতিক পরিবেশের অন্তর্ভুক্ত ধর্মীয় অনুষ্ঠান, শিল্পকলা, সাহিত্য সঙ্গীত প্রভৃতি। উন্নত সংস্কৃতি জনসাধারণের জীবনযাত্রায় সংযােজন। করে নতুন সুর; তাদের মানসিক বৃত্তি বিকশিত করে, নতুন সফ্টি প্রেরণা যােগায়, মানবিক গুণাবলি বিকাশের পথ প্রশস্ত করে। কবি-সাহিত্যিকরা মনকে সংকীর্ণতার উর্ধ্বে তুলে ধরে, জাতীয় জীবনের গতি প্রকৃতি পাল্টে দেয়। একাত্তরের স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্নিঝরা দিনগুলাে আমরা এর হাজারাে দৃষ্টান্ত দেখেছি। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য, নজরুলের গান প্রতিটি সংকটে এ জাতিকে উদ্দীপ্ত করেছে। বাঙালি মন যে সংবেদনশীল তার অন্যতম কারণ উন্নত বাংলাদেশী সংস্কৃতি। 
রাজনৈতিক জীবনে পরিবেশের প্রভাব : ব্যক্তি জীবনে রাজনৈতিক পরিবেশের গুরুত্ব অত্যাধিক। কেননা, সমাজবদ্ধ মানুষের রয়েছে রাজনৈতিক বিশ্বাস, আদর্শ, আচার-আচরণ ও রাজনৈতিক আশা-আকাঙ্কা। এ সব কিছুই যেমন পরিবেশের উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল, তেমনি পরিবেশও মানুষের জীবনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করে। অর্থাৎ মানব জীবনের অনেক কিছুই রাজনৈতিক পরিবেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। উন্নত রাজনৈতিক পরিবেশ মানুষের মধ্যে সহনশীলতা বা পরমত সহিষ্ণতা, আবেগের পরিবর্তে যুক্তিতে বিশ্বাস, সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, জনপ্রতিনিধিদের সরকার পরিচালনা প্রভৃতি রাজনৈতিক মুল্যবােধ সৃষ্টি করে। রাজনৈতিক পরিবেশ অস্থিতিশীল, নৈরাজ্যজনক ও বিশৃঙ্খল হলে এসব গুণাবলি যথাযথ বিকাশ সম্ভব হয় না। তাই মানব জীবনকে সুস্থ, সুন্দর করে গড়ে তুলতে রাজনৈতিক পরিবেশ পরিলক্ষিত হওয়া প্রয়ােজন। 
শিক্ষাক্ষেত্রে পরিবেশের প্রভাব : শিক্ষার পরিবেশ মানব জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। আদর্শ শিক্ষা পরিবেশের মধ্যে মানুষ খুঁজে পায় জীবন বিকাশের প্রকৃত উপাদান। সুশিক্ষা মানুষের চিন্তাশক্তি ও মনের প্রসার ঘটায়। শিক্ষার মাধ্যমে আয়ত্ত বিভিন্ন কলা-কৌশল মানুষকে জীবন সংগ্রামে উপযােগী করে তােলে। সেই শিক্ষার পরিবেশ যদি সুস্থ, সুশৃঙ্খল ও অনুকূল না হয়, শিক্ষা যদি হয় গতানুগতিকতায় আচ্ছন্ন-তাহলে শিক্ষার্থীর জীবনে তার মারাত্মক প্রভাব পড়ে। পক্ষান্তরে, হয় অনুকূল, উত্তম এবং অনাবিল, তাহলে তা শিক্ষার্থীর জীবনে আশীর্বাদ হয়ে ধরা দেয়। 
প্রাকৃতিকক্ষেত্রে পরিবেশের প্রভাব : প্রকৃতির সাথে মানব জীবনে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক বিদ্যমান। মানুষের জীবন ব্যবস্থা, সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশে প্রাকৃতিক পরিবেশ গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব বিস্তার করে। প্রাকৃতিক পরিবেশের বিভিন্নতার কারণে বিশ্বের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের আচার-আচরণ, চাল-চলন, পেশা, পােশাক-পরিচ্চদ, খাদ্য, বুদ্ধিমত্ডা, মানসিকতা, দৈহিক গঠন ও বর্নের বিভিন্নতা পরিলক্ষিত হয়। মানুষের জীবনকে প্রকৃতি নিয়ন্ত্রিত করে। কেননা, উদার আকাশ মানুষকে দেয় মুক্তির আনন্দ, নদীর বহমান স্রোতধারায় সে শশানে জীবনের কলতান, সবুজের সমারােহে খুঁজে পায় তারুণ্য ও নতুন জীবনের উদ্দীপনা। তাই ইংরেজ কবি ওয়ার্ডসওয়ার্থ বলেছেন, “প্রকৃতি ও মানব চরিত্রের মধ্যে রয়েছে গভীর আত্মীয়তার সম্পর্ক। প্রকৃতি মানুষকে মহৎ করে, উদারতা শেখায়, নিজের অজান্তেই ঘটায় মনুষ্যত্বের জাগরণ। জীবন যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার সংগ্রামের মন্ত্র মানুষ প্রকৃতি থেকেই গ্রহন করে। ষান্তরে, প্রকৃতির বৈরীতা মানুষকে করে তােলে নিঃস্ব ও অসহায়। অসহনীয় প্রকৃতি মানুষের জীবনের জন্যও হুমকী হয়ে দাঁড়ায়। প্রকৃতি সুস্থ ও স্বাভাবিক না হলে মানুষের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যাবে। অতএব আমরা বলতে পারি যে, মানব জবিনে প্রাকৃতিক পরিবেশের প্রভাব অত্যন্ত নিবিঢ় ও সুদূর প্রসারী। 
উপসংহার : মানুষ পরিবেশের দাস। তাই মানব জীবনে পরিবেশ আশীর্বাদ ও অভিশাপ উভয়েরই প্রতিফলন ঘটাতে পারে। পরিবেশ একদিকে যেমন মানুষকে স্বার্থপর, চরিত্রহীন, অসভ্য ও বর্বর করে তুলতে পারে তেমনি পরিবেশেও মানুষের জীবনে বইয়ে দিতে পারে মহৎ গুণাবলির সুশীল ফরুধারা। প্রতিকূল পরিবেশ যেমন মানব জীবনকে হুমকির মুখে নিক্ষেপ করতে পারে তেমনি অনুকূল পরিবেশ এনে দিতে পারে স্বর্গীয় সুখ, সাফল্যের আকাশচুষ্বী কৃতিত্ব। তাই মানব জীবনে পরিবেশের প্রভাব অনস্বীকার্য।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
1 comment

1 comment

  • Anonymous
    Anonymous
    18 October, 2022
    খুব সুন্দর বৌদি
    Reply