বা ইন্টারনেট
সূচনা: আধুনিক বিশ্বে যােগাযােগের সর্বাধুনিক প্রযুক্তির নাম ইন্টারনেট। ইন্টারনেট তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী বিপ্লব সাধন করেছে। ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৃথিবীর এক প্রান্তের কম্পিউটার থেকে অপর প্রান্তের আর একটি কম্পিউটারের সাহায্যে ছবিসহ যাবতীয় তথ্য দ্রুত আদান- প্রদান করা যায়। এদিক থেকে ইন্টারনেটকে একটি বিশাল নেটওয়ার্কিং সিস্টেম' বলা যায়। ইন্টারনেটের অবদানের ফলে এক যুগ পূর্বে যােগাযােগের ক্ষেত্রে যা ছিল অসম্ভব বা অকল্পনীয়, বর্তমানে তা চোখের পলকে সম্ভব হচ্ছে।
ইন্টারনেটের উদ্ভব ও বিকাশ: ১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বাহিনী সর্বপ্রথম ইন্টারনেট ব্যবহার করে। শুরুতে কেবল যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় তাদের গবেষণার প্রয়ােজনে এ ইন্টারনেট সিস্টেমকে কাজে লাগায়। সেসময় এন.এস.এফ. ইন্টারনেটের দায়িত্ব নেয়। ইন্টারনেটের টেকনিক্যাল সহযােগিতা প্রদান করে এনএসএফ। যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা বিভাগের কম্পিউটার বিজ্ঞানীরা মাত্র ৪টি কম্পউটারের মধ্যে গড়ে তুলেছিলেন প্রথম অভ্যন্তরীণ এই নতুন যােগাযােগ ব্যবস্থা। এর তিনটি কম্পিউটার ছিল 'ক্যালিফোর্নিয়ায়' ও একটি ছিল 'উটাই'-তে। এই যােগাযােগ ব্যবস্থার নাম ছিল ডাপানেট'। এরপর শুধু সাফল্যের ইতিহাস; বিশ্বজয়ের বিস্ময়কর সাফল্যের ইতিহাস। তিন বছর যেতে না যেতেই ‘ডাপার্নেট'-এর নাম বদল করতে হয়। কম্পিউটারের সংখ্যা তখন চার থেকে তেক্রিশে-এ পৌছােয়। এর নাম রাখা হয় আপার্নেট যার উদ্দেশ্য ছিল পারমাণবিক আক্রমণ ঠেকানাের জন্যে বৈজ্ঞানিক তথ্য ও অন্যান্য প্রয়ােজনীয় তথ্য আদান-প্রদান করা। সত্তর ও আশির দশকে যুক্তরাষ্ট্রের আরও অনেক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বিশ্ববিদ্যালয় এই নেটওয়ার্কের সাথে সংযুক্ত হয়। ক্রমশ চাহিদার ভিত্তিতে ১৯৮৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সায়েন্স ফাউন্ডেশন সর্বসাধারণের জন্যে এরকম অন্য একটি যােগাযােগ ব্যবস্থা চালু করে। এর নাম দেওয়া হয় 'নেস্ফনেট'। তিন বছরের মধ্যে ‘নেস্ফেনেট'-এর বিস্তার সমগ্র বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ইতােমধ্যে গড়ে ওঠে আরও অনেক ছােট-মাঝারি নেটওয়ার্ক। এতে করে এ ব্যবস্থাপনায় কিছুটা অরাজকতা দেখা দেয়। এ অরাজকতা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য সমস্ত ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ন্ত্রণের প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয়। প্রয়ােজন দেখা দেয় একটি কেন্দ্রীয় 'নেটওয়ার্ক গড়ে তােলার। গত শতকের নব্বই দশকের শুরুতে এই নেটওয়ার্ক গড়ে তােলা হয়। বিশ্বের মানুষ পরিচিত হয় ইন্টারনেট' নামক একটি ধারণার সাথে। বর্তমান বিশ্বে প্রায় এক শ সাতানব্বই কোটি ব্যবহারকারী এ কার্যক্রমের সাথে সম্পৃক্ত।
বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবস্থা: ১৯৯৩ সালের ১১ নভেম্বর বাংলাদেশে ইন্টারনেটের ব্যবহার শুরু হয়। সে সময় অফলাইনের মাধ্যমে ইন্টারনেট সার্ভিস চালু হয়। এর মধ্যে 'প্রদেষ্টা, ছক, ট্যাপ, আগ্র, সিস্টেম, বিডিমেল, বিডিনেট এবং অরােরা-১ উল্লেখযোেগ্য। অফলাইনে সংযুক্ত থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে তথ্যের বিশাল জগতের সকল সম্পদ ব্যবহার করা সম্ভব হয়নি। সে সময় ই-মেইলের মাধ্যমে কেবল ডাউনলােড (মেইল গ্রহণ) ও আপলােড (মেইল-প্রেরণ) ছাড়া আর কিছুই করা সম্ভব হয়নি। এক্ষেত্রে গ্রাহকরা তাদের কম্পিউটার থেকে যােগাযােগ সফ্টওয়্যারের মাধ্যমে মডেম ও টেলিফোন লাইনের সাহায্যে সার্ভিস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানের সাথে মেল বিনিময় করত। সার্ভিস প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো দিনে কয়েকবার আইএসডি, টেলিসংযােগ তারের সাথে সংযুক্ত কম্পিউটারে পাঠিয়ে দিত। একই সাথে গ্রাহকদের কাছে আসা মেলগুলাে ডাউনলােড করা হতাে। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে, উপরি-উক্ত ছয়টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনাে যােগাযোগ প্রতিষ্ঠা না হওয়ায় একটি প্রতিষ্ঠানের গ্রাহক অন্য প্রতিষ্ঠানের গ্রাহকের কাছে সরাসরি ই-মেল পাঠাতে পারত না। তাদের একজনের পাঠানাে তথ্য সারা বিশ্ব ঘুরে আবার অপর গ্রাহকের কাছে যেত। কিনতু অনলাইন সার্ভিস চালু হওয়ার পর যােগাযােগের সকল বাধা দূর হয়। বেশ কিছুদিন আগে বাংলাদেশ অন-লাইন ইন্টারনেট সার্ভিসের বিশাল জগতে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে। ১৯৯৬ সনের ৪ জুন VSAT চালুর মাধ্যমে প্রথম অনলাইন ইন্টারনেট চালু করে ISN (Information Services Network). এরপর গ্রামীণ সাইবারনেট, ইউ অনলাইন, BRAC, BDMAIL, PRADESHTA NET, AGNI SYSTEM ইত্যাদি সংস্থাসহ বিভিন্ন সংস্থা ইন্টারনেট সার্ভিস প্রােভাইডার হিসেবে কাজ করছে। সম্প্রতি অপটিক্যাল হাইওয়ের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার ফলে বাংলাদেশের মানুষ আরও দুত ও সহজে বিশ্বের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করতে পারছে।
ইন্টারনেটের গুরুত্ব: আমাদের দৈনন্দিন জীবনে ইন্টারনেটের গুরুত্ব অপরিসীম। এই যোেগাযােগ নেটওয়ার্কের মাধ্যমে আজ অনেক অসম্ভবকে সম্ভব করা যাচ্ছে। তথ্য প্রেরণ ও গ্রহণ থেকে শুরু করে বিশ্বের সকল প্রান্তের মানুষের সাথে আড্ডা, সম্মেলন, শিক্ষা, বিপণন, অফিস ব্যবস্থাপনা, বিনােদন ইত্যাদি ইন্টারনেটের সাহায্যে সম্ভব হচ্ছে। মাল্টিমিডিয়ার বিকাশের সাথে সাথে প্রতিদিন এর সম্ভাবনা আরও উজ্জ্বল হচ্ছে। বাংলাদেশের একজন লােকের পক্ষে ইন্টারনেটের মাধ্যমে নিউইয়র্কের কোনাে ওপেন এয়ার কনসার্ট উপভােগ করা সম্ভব হচ্ছে। বাংলাদেশের একজন রােগী লন্ডনের একজন ডাক্তারের পরামর্শ নিতে পারেন। ক্রেডিট কার্ডের মাধ্যমে এক দেশে বসে অন্য দেশের জিনিসপত্র কেনাকাটা সম্ভব হচ্ছে। একটি লােকাল টেলিফোন কলের খরচে পৃথিবীর এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশে কথা বলা সম্ভব হচ্ছে। মহাকাশ গবেষণায় ইন্টারনেট বিজ্ঞানীদের অধিক সহায়তা দিচ্ছে। প্রচার মাধ্যম সহজতর হয়েছে। মূলত নিম্নলিখিত সুবিধাগুলাে দিচ্ছে বলেই ইন্টারনেটের গুরুত্ব আমাদের কাছে অপরিসীম।
ক. ই-মেইল (E-mail Electronic mail): ই-মেইল-এর কার্যকারিতা অনেকটা ফ্যাক্স-এর মতােই। তবে ফ্যাক্সে কাগজের ব্যবহার হয়। এতে কাগজের প্রয়ােজন হয় না। প্রেরক কম্পিউটারে তার বক্তব্য টাইপ করে সাথে সাথে তা এক বা একাধিক প্রাপক টার্মিনালের কাছে একই সময়ে নেটওয়ার্কিং প্রক্রিয়ায় পাঠিয়ে দিতে পারেন।
খ. ওয়েব (WWW- World Wide Web): ইন্টারনেটের মাধ্যমে সংযুক্ত কম্পিউটারগুলােতে যে তথ্য রাখা হয়েছে, সেগুলাে ব্যবহার করার ব্যবস্থাকে ওয়েব বােঝায়। সাধারণত বড় ধরনের কোম্পানি তাদের নিজস্ব ওয়েব সাইট তৈরি করে নেটওয়ার্কেক রেখে দেয় সাধারণের ব্যবহারের জন্যে। কোম্পানি সম্পর্কে তথ্যাদি ছাড়াও চাকরি বা ডিলারের জন্যে আবেদনপত্র ওয়েবসাইটে থাকে।
গ. চ্যাট (IRC- Internet Relay Chat): এ প্রক্রিয়ায় যে কেউ এক বা একাধিক ব্যক্তির সাথে একই সময়ে কম্পিউটারের মাধ্যমে আভা জমিয়ে তুলতে পারেন। বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বা কোনা প্রতিষ্ঠানের অফিসের কর্মচারীদের মধ্যে মতবিনিময় করার এটি একটি অত্যন্ত সুলভ ও জনপ্রিয় মাধ্যম।
ঘ. নেট নিউজ (Netnews): এ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে যে-কেউ ইন্টারনেট তথ্যভাণ্ডারে যেকোনাে সংবাদ সংরক্ষণ করে তা সবার জন্যে উন্মুক্ত করে দিতে পারে।
ঙ. ইউজনেট (Usenet): ইউজনেট হচ্ছে অনেকগুলাে সার্ভার-এর নিজস্ব সংবাদ নিয়ে গঠিত তথ্যভাণ্ডার যা সকল ব্যবহারকারীর জন্যে উন্মন্ত।
চ. আর্কি (Archie): আর্কি হচ্ছে নেটওয়ার্কে তথ্যসেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে স্থাপিত একটি পদ্ধতি যা তথ্যসমূহকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সুচি আকারে সমন্বয় করে উপস্থাপন করতে সক্ষম।
ছ. গােফার (Gopher): এটিও ইন্টারনেটে তথ্যসেবা প্রদানের উদ্দেশ্যে স্থাপিত একটি পদ্ধতি যা গুরুত্বানুসারে তথ্যের সমন্বয় করে এবং ব্যবহারকারীর প্রয়ােজনানুসারে তথ্য খুঁজে দেয়।
জ. E-Cash Electronic Cash: ইন্টারনেটের মাধ্যমে ইলেকট্রনিক ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে ই-ক্যাশ পদ্ধতি বলে। সাধারণভাবে, বলতে গেলে ই-ক্যাশ হলাে অনেকগুলাে আধুনিক অর্থনৈতিক লেনদেনের সমষ্টি।
এছাড়াও ইন্টারনেটের রয়েছে বহুবিধ ব্যবহার। বলা চলে, বিশ্বের যােগাযােগ ব্যবস্থার সাথে ইন্টারনেট আজ নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে।
ইন্টারনেট বিশ্বের সেতুবন্ধন: তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের অতুলনীয় আবিষ্কার ইন্টারনেট। ইন্টারনেটের মাধ্যমে পৃথিবীর এক প্রান্তের কম্পিউটার থেকে অপর প্রান্তের আর একটি কম্পিউটারের সাহায্যে ছবিসহ তথ্য সরবরাহ করতে পারে। আর এর ফলেই পৃথিবীর কোথায় কী ঘটছে তা আমরা মুহূর্তেই জানতে পারি। তাই ইন্টারনেট যােগাযােগের ক্ষেত্রে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সাথে সেতুবন্ধন সৃষ্টি করেছে।
অপকার: আলাের পাশাপাশি যেমন অন্ধকার থাকে, তেমনি ইন্টারনেট ব্যবহারেও উপকারিতার পাশাপাশি কিছু অপকারিতা রয়েছে। এক শ্রেণির যুবক আছে যারা ভালােটা থেকে মন্দটা গ্রহণ করে বেশি। ইন্টারনেটের মাধ্যমে উঠতি তরুণেরা বিভিন্ন অশ্লীল এবং কুরুচিপূর্ণ দৃশ্যাবলি দেখে থাকে। এই যুবসমাজকে অবক্ষয়ের হাত থেকে রক্ষার জন্যে চাই সুনির্দিষ্ট নীতিমালা।
উপসংহার: বর্তমান বিশ্বে ইন্টারনেট আধুনিক মানুষের অন্যতম অবলম্বন। এর মাধ্যমে মানুষের জীবনযাত্রা হয়ে পড়েছে অনেক সুহজ। বর্তমানে বাংলাদেশ সরকার কম্পিউটারের আমদানি সম্পূর্ণ করমুক্ত করাতে ইন্টারনেটের জনপ্রিয়তা অসম্ভবভাবে বেড়ে যাচ্ছে। ইন্টারনেটকে জনপ্রিয় করে তােলার লক্ষ্যে বাংলাদেশে ইন্টারনেট কমিটি গঠন করা হয়েছে। সচেতন নাগরিকদের সহযােগিতা ও সরকারি সদিচ্ছা তাদের এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করে বাংলাদেশকে বিশ্বের অন্যান্য আধুনিক দেশের সাথে তাল মিলিয়ে উত্তরােত্তর উন্নয়নের সুযােগ করে দিতে পারে।
Post a Comment