বৈচিত্র্যময় প্রকৃতি : টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া পর্যন্ত ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলােমিটার আয়তনের ছােট্ট এ দেশটি বিশ্বের দরবারে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপূর্ব লীলাভূমি হিসেবে পরিচিত। এ সৌন্দর্য যেমন দেশের ভূ-প্রাকৃতিক গঠনের দিক থেকে তেমনি ঋতুবৈচিত্র্যের দিক থেকে। দেশের দক্ষিণে বিশাল বঙ্গোপসাগরের উত্তাল প্রতিধ্বনি নিয়তই এক অলৌকিক সুরের মায়াজাল সৃষ্টি করে চলেছে। হাজার হাজার মানুষ সেই সুরের মােহে ছুটে যায় সমুদ্রসৈকতে। উত্তরের ধূসর প্রকৃতির উদাসীনতার বাণী পাগলা বাউলের মতাে মানুষকে ঘর ছাড়া করে। অসংখ্য নদ-নদী জালের মতাে সারা দেশে ছেয়ে রয়েছে। কল কল রবে এসব নদ-নদী সাগরের পানে ছুটে চলেছে প্রতিনিয়ত। এদেশের অনুচ্চ পাহাড়, বন-বনানী যেন ঘােমটা মাথায় দিয়ে ধ্যানে বসেছে। আর এটাই আমাদের মাতৃভূমি বাংলাদেশ। এ নিয়েই বাংলাদেশের প্রাকৃতিক গঠন। এভাবে আমাদের দেশের ছােট পরিধিতে প্রকাশ পেয়েছে প্রাকৃতিক রূপের লীলাখেলা। এদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কবি গেয়েছেন- 'কোন গগনে উঠেরে চাঁদ এমন হাসি হেসে
আঁখি মেলে তােমার আলাে
দেখে আমার চোখ জুড়ালাে
ঐ আলােকেই নয়ন রেখে মুদবাে নয়ন শেষে।'
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বনাঞ্চল ও পাহাড় : প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি এ বাংলাদেশ। অপূর্ব সৌন্দর্যে বিভূষিত এদেশের প্রকৃতি। বৈচিত্র্যময় গায়ে অববাহিকার সাগর তীরে জেগে ওঠা উর্বর পলিমাটি সমৃদ্ধ এদেশের মাটিতে জন্ম নিয়েছে অসংখ্য বনাঞ্চল। বিশ্বজুড়ে পরিচিত এদেশের সুন্দরবনের নাম, সেখানকার বিশাল বনানীতে সৃষ্টি হয়েছে এক স্বতন্ত্র জীবনধারা। এ বনের বিচিত্র জীব-জন্তু মানুষকে যেমন আকৃষ্ট করে তেমনি মনে ভীতিরও সার করে। বিশ্ববিখ্যাত রয়েল বেঙ্গল টাইগার ও চিত্রল হরিণ ছাড়াও সুন্দরবনে রয়েছে অসংখ্য জীবজন্তু। নদ-নদীতে যেমন রয়েছে। নানা প্রজাতির মাছ তেমনি রয়েছে রাক্ষুসে কুমির। সুন্দরবন ছাড়াও স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যে আকর্ষণীয় হয়ে রয়েছে ভাওয়াল ও মধুপুরের গড় বনাঞ্চল। পার্বত্য চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, সিলেট, বান্দরবানের বনাঞ্চলের সাথে পাহাড় এবং পাহাড় ঘেঁষে বয়ে যাওয়া নদীগুলাে এক অপূর্ব সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। বনাঞ্চল ও পাহাড়ের আঁকাবাঁকা, উঁচুনিচু পথে চলার সময় যে মনােমুগ্ধকর দৃশ্য চোখে পড়ে তা বিস্মৃত হবার নয়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাক্ষেত্র হিসেবে তা সহজেই মানুষের মনকে আকৃষ্ট করতে পারে। | রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানের পাহাড়গুলাে এক অফুরন্ত সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছে। এখনও দুর্গম চিম্বুক আর সাজেক উপত্যকার অপূর্ব সৌন্দর্য দেশবাসীর অজানা। ফয়েজ লেক ও রাঙামাটির কাপ্তাই লেক পাহাড়ের বুকে সৃষ্টি করেছে এক অনাবিল সৌন্দর্যের মায়াজাল।
নদ-নদীর সৌন্দর্য : বাংলাদেশে নদ-নদীর সংখ্যা বেশি হওয়ায় এদেশের নাম হয়েছে নদীমাতৃক দেশ। অসংখ্য নদীর জন্যে বাংলাদেশের প্রকৃতি সৌন্দর্যমণ্ডিত হয়ে উঠেছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, শীতলক্ষ্যা, কর্ণফুলী, সুরমা প্রভৃতি নদী জালের মতাে ছড়িয়ে রয়েছে। এদেশের বুকের ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে এসব নদী মাটিকে উর্বর করে| শস্য-শ্যামলা করে তুলেছে, প্রকৃতিকে করেছে বৈচিত্র্যময়। নদীর জলধারার প্রভাবে প্রকৃতিতে সবুজের সমারােহ এসেছে। নদীর বুকে বয়ে চলা নৌকা, লঞ্চ, স্টিমারগুলাে এক অপূর্ব সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। বর্ষার সময় এসব নদী দুকূল প্লাবিত করে বয়ে চলে। এসব নদ-নদী ছাড়াও অসংখ্য খাল-বিল, হাওড়, দ্বীপ এদেশের প্রকৃতিকে আরও বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে। হাতিয়া, সেন্টমার্টিন, কুতুবদিয়া, সন্দ্বীপ ইত্যাদি দ্বীপ। এদেশের প্রকৃতিকে সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তুলেছে।
গ্রামের দৃশ্য : বাংলাদেশ ৮৫ হাজার গ্রামের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে সমৃদ্ধ। এদেশের এক একটি গ্রাম যেন প্রকৃতির এক একটি লীলানিকেতন। গ্রামের যে দিকেই তাকানাে হয় সেদিকেই দেখা যায় শস্য-শ্যামলা ক্ষেত, ফুলে-ফলে ভরা গাছপালা, আর সবুজের সমারােহ। প্রকৃতির সবুজ অবগুষ্ঠনের মধ্য হতে পাকা শস্যের মুখখানি যেন স্বর্ণবিন্দুর মতাে উকি দেয়। কুটিরঘেরা পল্লীগ্রাম, সবুজ-শ্যামল মাঠ, দীঘির জলে খেলা করা হাঁস-সব মিলিয়ে পল্লীতে প্রকৃতির এক অপূর্ব সৌন্দর্য বিরাজ করে। কবিগুরু এ সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে বলেন -
'অবারিত মাঠ, গগন ললাট চুমে তব পদধূলি
ছায়া-সুনিবিড় শান্তির নীড় ছােট ছােট গ্রামগুলি।'
ঋতুবৈচিত্র্যে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য : বাংলাদেশের ঋতুবৈচিত্র্য এক অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রকৃত বৈশিষ্ট্য। যেন নিহিত রয়েছে এদেশের ঋতুবৈচিত্রের মধ্যে। ছয়টি ঋতু নানা বৈচিত্র্য ও সৌন্দর্য নিয়ে হাজির হয় । গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত চক্রাকারে আবর্তিত হয়ে পরিবর্তন ঘটায় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের রূপের। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহে প্রকৃতি অতিষ্ঠ হয়ে এক রুদ্রমূর্তি ধারণ করে। এ সময়ের কালবৈশাখী ঝড় গাছপালা ভেঙেচুরে প্রকৃতিকে যেন দুমড়ে-মুচড়ে দিয়ে যায়। এ সময় আম, কাঁঠাল, লিচু সহ বিভিন্ন ফল পাকতে শুরু করে। বর্ষা আসে পরিপূর্ণ রূপ নিয়ে। চারদিকে পানি থৈ থৈ করে। সারাদিন ঝর ঝর বৃষ্টি পড়তে থাকে। সূর্যের মুখ দেখা যায় না বললেই চলে। নদী-নালার পানি দু কূল ছাপিয়ে যেন পূর্ণ যৌবনার রূপধারণ করে। প্রচুর বৃষ্টিপাতে প্রকৃতি নতুনবূপ ধরে আবির্ভূত হয়। প্রকৃতির বুকে তখন সবুজের সমারােহ ও অপূর্ব শােভার সৃষ্ট হয়। চারদিকে কুহু-কেকার আনন্দ-ধ্বনি জাগে। ফুলে ফুলে সুশােভিত হয়ে ওঠে বর্ষার প্রকৃতি। কেয়া, কদম, জুঁই ইত্যাদি ফুলের সৌরভে চারদিক ম-ম করে। ঘন বর্ষার এ প্রকৃতিতে আকুল মন তাই বলে ওঠে-
'এমন দিনে তারে বলা যায়
এমন ঘনঘাের বরিষায়।'
শরতে প্রকৃতি ভিন্নরূপ ধারণ করে। জলহারা সাদা মেঘের শরতের আকাশ আর রাতের জ্যোৎস্না এক অপরূপ সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে। কামিনী, শেফালী, হাসনাহেনার গন্ধে ভরে ওঠে প্রকৃতি। সবুজের বিপুল সমাবেশে প্রকৃতি শান্তরূপ ধারণ করে। যে সৌন্দর্য অনুভব করে কবি বলেছেন 'আজিকে তােমার মধুর মূরতি হেরিনু শারদ প্রাতে। হেমন্তের রূপ ভিন্ন বৈশিষ্ট্যে দেখা দেয়। শস্যক্ষেতের পাকা ফসলে প্রকৃতি এক অপরূপ সৌন্দর্য লাভ করে। চাষি মাথায় করে পাকা ধান ঘরে আনে। নতুন ধানের চালে উদযাপিত হয় নবান্ন উৎসব। শীত ঋতু আসে তার গৈরিক উত্তরীয় নিয়ে। গাছপালা পাতা ঝরে শুষ্ক, বিবর্ণ ও শ্রীহীন হয়। তখন প্রকৃতি নিরাভরণ রূপধারণ করে। শীতের সকালে শিশির বিন্দুর ওপর সূর্যের রশ্মি পড়ে এক অপরূপ সৌন্দর্যের সৃষ্টি করে। শীতের শূন্যতা কাটিয়ে বিপুল সৌন্দর্য নিয়ে প্রকৃতিতে উপস্থিত হয় ঋতুরাজ বসন্ত। এ সময়ে গাছে গাছে নতুন পাতা দেখা দেয়। ফুলের সমারােহে কোকিলের গানে প্রকৃতি নতুন রূপে সজ্জিত হয়। এভাবে ছয়টি ঋতু বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে আরও সৌন্দর্যমণ্ডিত করে তােলে।
উপসংহার : প্রকৃতি ও মানুষের জীবনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের মধ্যেই দেশের প্রকৃত সৌন্দর্য ফুটে ওঠে। আমাদের দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সৌন্দর্যপ্রেমী মানুষকে করেছে ঘরছাড়া। প্রকৃতির বিচিত্র সৌন্দর্য এদেশের মানুষের মনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছে। এদেশের যেদিকে দৃষ্টিপাত করা যায় সেদিকেই দেখা যায় প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য। তাই কবি মুগ্ধচিত্তে বলেন -
'এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।'
Post a Comment