SkyIsTheLimit
Bookmark

রচনা কাজী নজরুল ইসলাম

ভূমিকা :
কাজী নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদা দেয়া হয়েছে। তিনি আমাদের একান্ত প্রিয়, পরম শ্রদ্ধার।
জীবন কথা : কবির জন্ম হয় পশ্চিম বাংলার, বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে ১৮৯৯ সালে। দুঃখের সংসারে জন্ম বলেই সম্ভবত তাঁর নাম রাখা হয় দুখু মিয়া। শৈশবে তাঁর বাবার মৃত্যু ঘটে। মায়ের অন্যত্র বিয়ে হয়ে যায়। ফলে বাঁধনহারা নজরুল ছেলেবেলা থেকেই হয়ে উঠেন দুরন্ত। স্কুলে তার লেখাপড়া খুব নিয়মিত হয় নি। অভাব-অনটনের জন্যই তিনি কৈশােরে লেটোর দলে যােগ দেন। এখানে তিনি গান, নাটক, প্রহসন লিখে বেশ নাম করলেন এবং একটি দলে ওস্তাদের পদও পেলেন। ওস্তাদকে শুধু কবিতা, গান বা নাটক লিখলেই হয় না, তাঁকে সংগীতে সুর সংযােজন, নাটক পরিচালনা ইত্যাদি অনেক কিছু করতে হয়। ফলে কবিতা ও গীত রচনায় এবং সুর সংযােজনায় তিনি পটুত্ব অর্জন করেন।
তিন-চার বছর তিনি লেটোর দলে থাকেন। এরপর কিছুদিন তিনি আসানসােলে রুটির দোকানেও কাজ করেন—পাঁচ টাকা মাস মাইনেতে। এরপর তার আবার লেখাপড়ায় সুমতি হয়। তিনি যখন দশম শ্রেণীর ছাত্র, প্রাক-নির্বাচনী পরীক্ষা দিচ্ছেন, ঠিক সে সময় প্রথম মহাযুদ্ধের দামামা বেজে উঠে। তিনি যুদ্ধে যােগ দিয়ে করাচী গেলেন। সৈনিক জীবনেই তাঁর সাহিত্য- প্রতিভার বিকাশ ঘটে। করাচী থেকে তিনি লেখা পাঠান কলকাতায়। সওগাত '-এ ছাপা হয় তাঁর গল্প। কবিতা যুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে এসে তিনি সরকারি চাকরিতে যোগ দেননি। তিনি কবিতা-গান রচনায়, গল্প-আড্ডায় মেতে উঠেন। করাচী থাকতেই তিনি রুশ বিপ্লবের কথা শােনেন। দেশে এসে কমরেড মুজাফফর আহমদের সাথে পরিচিত থাকে সাম্যবাদী ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ করে। তিনি অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে লেখনী ধারণ করলেন। বিদ্রোহী এই একটি কবিতা লিখেই তিনি বাংলা সাহিত্যে কবিরূপ সুপ্রতিষ্ঠ হলেন। 'ধুমকেতু তে লেখার অপরাধে তিনি রাজদ্রোহের অপরাধে বন্দী হলেন। বাঙালি সাহিত্যকদের মধ্যে তিনি প্রথম রাজদ্রোহের অপরাধে কারাগারে নিক্ষিপ্ত হলেন। অথচ রবীন্দ্রনাথ তাঁকে 'বসন্ত' নাটকটি উৎসর্গ করে সম্মান জানালেন। কারামুক্ত হয়ে তিনি গেলেন কুমিল্লায়। কুমিল্লায় মেয়ে দুলি ওরফে প্রমীলার সাথে ঘটে তাঁর প্রণয়। তিনি লিখলেন প্রেমের কাব্য ‘দোলন চাপা’, ‘ছায়ানট’, ‘সিন্ধু হিল্লোল। নজরুল -কাব্যের দুই রূপ। আবার তিনি বিদ্রোহাত্মক কাব্যও লেখেন—‘অগ্নিবীণা’, ‘বিশের বাঁশী', ভাঙার গান, ফণি- মনসা ইত্যাদি। নজরূল একদিকে বাঁশের বাঁশীর ললিত সুরে চিরসুন্দরের সাধনা, অপরদিকে স্বাধীনতা যুদ্ধের অগ্নি সৈনিক রূপে রণাতুর্য নিনাদ করেছেন। নর-নারীর ভালবাসা তাঁকে যেমন আকুল করেছে, তেমনি মানুষের দারিদ্র্য তাকে বিচলিত করে তুলেছে। 
নজরুলের দুর্ভাগ্যময় জীবন : তিনি ক্রমাগত সংসারের ঘূর্ণিপাকে জড়িয়ে পড়লেন। প্রথমে তিনি হুগলীতে পরে কৃষ্ণনগরে বাসা বাঁধলেন। কৃষ্ণনগরে তার মৃত্যুক্ষুধা' উপন্যাসটি রচিত হয়। এই ক্ষুধা তিনি নিজেই কৃষ্ণনগরে অনুভব করেন। তাকে সাহায্য করার জন্য কলকাতায় বিচিত্রানুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়। কৃষ্ণনগরে তার আর্থিক অবস্থা শােচনীয় হয়ে এলে তাকে কলকাতায় নিয়ে আসা হয় ১৯২৯-এ। 
কলকাতা এসেও তার আর্থিক দুরাবস্থা ঘুচেনি। সংসারের চাহিদা মেটানের জন্য তিনি যোগ দিলেন গ্রামোফোন কোম্পানিতে, কলকাতা বেতার কেন্দ্রে, ছায়াচিত্রে, মঞ্চে। এমনকি একটি গ্রামােফোনের দোকানও খুললেন। তবে দোকানটি অচিরেই বন্ধ হয়ে যায়। দুর্ভাগ্য তাকে রাহুর মতাে তাড়া করতে থাকে। কবিপত্নী পক্ষাগাতে আক্রান্ত হয়ে শয্যাশায়ী হলেন। কবি স্ত্রীকে সামিয়ে তুলবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করতে লাগলেন; কিন্তু কিছুতে কিছু হল না। এরপর ফজলুল হকের নবযুগে যখন সম্পাদনায় রত সে-সময় তিনি মানসিক ভারসাম্য হারালেন (১৯৪১)। দীর্ঘ প্য়ত্রিশ বছর শুদ্ধ থেকে তিনি ঢাকায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ১৯৭৬ সালে। 
নজরুল -কাব্যের মূল সুর: নজরুলের কবিতা আজও আমাদের উদ্দীপনার সঞ্চার করে। 'বিদ্রোহী' কবিতায় তিনি উচ্চারণ করেছেন, 
'মহা- বিদ্রোহী রণ ক্লান্ত 
আমি সেই দিন হব শান্ত   
যাবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রােল আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না, 
অত্যাচারীর খড় কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না- '
সমগ্র নজরুল কাব্যে উৎপীড়িতের ক্রন্দন রােল’ ধ্বনিত হয়ে উঠছে। সাধারণ মানুষের দুঃখ-বেদনা, আঘাত-অবমাননায় তার হৃদয় কাতর হয়ে উঠেছে। তাদের প্রতি সকল অন্যায়-আচরণের কঠোর প্রতিবাদ তিনি জানিয়েছেন এবং তাদের দুঃখ দুর্দশা ঘুচিয়ে মনুষ্যত্ব প্রতিষ্ঠায় উৎকণ্ঠ হয়েছেন। 
মানুষের কবি নজরূল শাস্ত্র অপেক্ষা মানুষের হৃদয়কে বড় বলে জেনেছেন: 
'তােমাতে রয়েছে সকল কেতাব সকল কালের জ্ঞান, 
সকল শাস্র খুঁজে পাবে সখা খুলে দেখ নিজ প্রাণ।' 
ধর্মগ্রন্থ মানুষ সৃষ্টি করে নি, মানুষের জন্যই ধর্মগ্রন্থ রচিত হয়েছে।তাই সকল ধর্মগ্রন্থ অপেক্ষা অনেক মহীয়ান। 
'এই হৃদয়ের চেয়ে বড় কোন মন্দির কাবা নাই।' 
নজরূল মানুষের হৃদয়কে একমাত্র সত্য বলে জেনেছেন। মানববাদী কবি মানুষকে সকল তুচ্ছতা ক্ষুদ্রতা খণ্ডতা হীনতা হেয়তার উর্ধ্বে তুলে মানবিক মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছেন। মানুষ তাঁর নিকট পেয়েছে সীমাহীন মর্যাদা : 
'মানুষের চেয়ে বড় কিছু নাই, নহে কিছু মহীয়ান।' 
উপসংহার : নজরুল আমাদের মধ্যে আত্মশক্তি ও আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তুলেছেন। আমাদের আশা-আকাঙ্্ষা ষপ্ন -সাধ তাঁর কাব্যে রূপায়িত হয়েছে। এজন্য তিনি আমাদের অতি প্রিয় কবি। আবার তার রণ-সংগীত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণা যুগিয়েছে এবং আমরা লাভ করেছি ষাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র যার নাম বাংলাদেশ। তাই তিনি আমাদের জাতীয় কবির মর্যাদায় অধিষ্ঠিত।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment