বা মাদকাসক্তির পরিণাম ও প্রতিকার
ভূমিকা: মাদক নামক সর্বনাশা নেশাদ্রব্যের করালগ্রাসে পৃথিবীর যুবসমাজ আজ ধ্বংসের মুখােমুখি। পৃথিবীর এমন কোনাে দেশ নেই যেখানে মাদক তার হিংস্র থাবা বসায়নি। আধুনিক বিজ্ঞান মাদকের উত্তরােত্তর উন্নতি ঘটিয়ে যুবসমাজের সামনে বিছিয়ে দিয়েছে মায়াজাল । মানবসমাজ আজ এমনই এক রূঢ়, নিষ্ঠুর সময়ের মুখােমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। যুদ্ধের বিজ্ঞান আজ জটিল থেকে জটিলতর। জীবাণু-যুদ্ধ, রাসায়নিক যুদ্ধের পরে এবার নেশাযুদ্ধ। এ নেশাযুদ্ধ মাদকের। এ নেশাযুদ্ধের কবলে পড়েছে হাজার হাজার তরুণ, এমনি করেই চলেছে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের মৃতকল্প, অসার, করে দেওয়ার এক বৃহৎ পরিকল্পনা। যুবশক্তিই দেশের প্রাণ। কিন্তু তারা নেশার ঘােরে ঢলে পড়ছে মৃত্যুর কোলে। দাবানলের মতাে তা ছড়িয়ে পড়ছে বাংলাদেশের বিভিন্ন শহরে, শহরতলীতে, গ্রাম-গ্রামান্তরে।
মাদকাসক্তির কারণ: মাদকদ্রব্যের প্রতি মানুষের আসক্তি জন্মায় ধীরে ধীরে। একদিনে হঠাৎ করে এর প্রতি কেউ আসক্ত হয় না। মাদকাসক্তির পেছনে কতগুলাে কারণ রয়েছে। যেমন:
ক. হতাশা: ব্যক্তিজীবনে হতাশা মাদকাসক্তির অন্যতম কারণ। মানুষের জীবনে অনেক আশা থাকে। যখন এ আশা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় তখন সে নেশাজাতীয় দ্রব্যে আসক্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে যুবসমাজ মাদকাসক্ত বেশি হয়। কারণ তারা শিক্ষিত হওয়ার পর কর্মসংস্থানের অভাবে বেকার হয়ে পড়ে। ফলে তারা হতাশ হয় এবং নেশা করে হতাশা ভুলে থাকতে চায়।
খ. পারিপার্শ্বিক অবস্থার প্রভাব: মাদকাসক্তির জন্যে পারিপার্শ্বিক পরিবেশ অনেকখানি দায়ী। যুবকেরা খারাপ সঙ্গে অর্থাৎ যারা মাদ্রকদ্রব্য সেবন করে তাদের সঙ্গে মিশে মাদকাসক্ত হয়।
গ. চিরন্তন নতুনত্বের নেশা বা কৌতূহল: তরুণ সমাজ অনেক সময় কৌতূহলবশত নতুন জিনিসের স্বাদ গ্রহণ করার জন্যে On Test হিসেবে এর সঙ্গে পরিচিত হয়, পরে আর এ থেকে বেরিয়ে আসতে পারে না।
ঘ. মাদকদ্রব্যের প্রকারভেদ: বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের মাদকদ্রব্য ব্যবহৃত হয়। প্রাচীন কালের মাদকদ্রব্যের ভেতর রয়েছে মদ, ভাং, গাজা, আফিম ইত্যাদি। বর্তমানে নিত্যনতুন মাদকদ্রব্য আবিষ্কৃত হয়েছে। যেমন: হরােইন, প্যাথেড্রিন, মারিজুয়ানা, কোকেন, হাসিস, মরফিন, পপি ইত্যাদি। হেরােইন, কোকেন এবং পপি বেশি মূল্যাবান মাদকদ্রব্য। আমাদের দেশের যুবসমাজ সামান্য কারণেই যেসব ড্রাগ মাদকদ্রব্য হিসেবে ব্যবহার করে সেসব হলাে- সিডাকসিন, মরফিন, ইনকডিন, প্যাথেড্রিন, ফেনসিডিল ইত্যাদি। সম্প্রতি পূর্ব এশীয় দেশগুলাে থেকে আসা ইয়াবা (ট্যাবলেট) নামক মাদকদ্রব্য আমাদের উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তানদের মাঝে ব্যাপক হারে বিস্তৃতি লাভ করেছে।
বাংলাদেশে মাদকদ্রব্যের ব্যবহার আশংকাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। আমাদের যুবসমাজ আজ ভয়াবহভাবে মাদকদ্রব্যের শিকার। অবৈধ পথে আসা এসব মাদকদ্রব্য এদেশে বিক্রি হয় এবং ব্যবহৃত হয়। দেশের পরিণতি এজন্যে দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছে। মাদকদ্রব্য সেবনের প্রতিক্রিয়া হিসেবে যুবসমাজ বিভিন্ন সন্ত্রাসী ও বেআইনি কাজে লিপ্ত হচ্ছে। ফলে সমাজ চলে যাচ্ছে ধ্বংসের দিকে। বাংলাদেশে মদ উৎপাদনকারী একমাত্র বৈধলাইসেন্সধারী প্রতিষ্ঠান হলাে দর্শনার কেরু এণ্ড কোম্পানি'। এ ছাড়াও অবৈধভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন মাদকদ্রব্য তৈরি ও বিক্রি হচ্ছে। দেশের এ অবস্থা নিরসনের জন্যে অতি দুত বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়াজন। ইতােমধ্যে সরকার এ ব্যাপারে অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তবে সরকারের একার পক্ষে এ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব নয়- এজন্যে সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে মাদক সেবনের ভয়াবহতা রােধ করার বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়ােজন।
মাদকদ্রব্যের ব্যবহার: প্রাচীন কাল থেকেই মানুষ কৃত্রিমভাবে নিজের প্রকৃতিকে অপ্রকৃতিস্থ করতে শিখেছে। চেয়েছে রুক্ষ বাস্তবতা, দারিদ্র-দহন থেকে পালিয়ে উদ্দ্যম কল্পনা আর ভ্রান্তি বিলাসে বুঁদ হয়ে থাকতে। নেশার জগতেও ঘটেছে নানা রূপান্তর। এসেছে কোকেন, এসএসডি আর হেরােইন। এদের প্রত্যেকের উপকরণ, ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া পৃথক ও দীর্ঘস্থায়ী প্রভাবের ক্ষমতা আলাদা আলাদা। মাদকের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচীন হলাে আফিম। পােস্ত নির্যাস থেকে কৃষকরা তৈরি করেন কাঁচা আফিম। তা থেকে হয় 'মারফিন বেস'। আফিম থেকেই বিশেষ প্রক্রিয়ায় উৎপন্ন হয়। সর্বনাশা হেরােইন। হেরােইন বিভিন্নভাবে শরীরে প্রবেশ করানাে হয়। তার মধ্যে প্রধান ক. ধূমপানের মাধ্যমে, খ. ইনহেল-এর মাধ্যমে গ. সরাসরি সেবনের মাধ্যমে, ঘ. স্কিন পপিং ও ঙ. মেইন লাইনিং পদ্ধতিতে।
মাদকাসক্তির অপকারিতা: 'হেরােইন আজ সব নেশাকেই ছাড়িয়ে গেছে। হেরােইনের পুরিয়া' আজ নেশাড়ুদের হাতে হাতে ঘুরছে। বাদামি আর সাদা' দুই রূপেই হেরােইন বিরাজ করছে। দুই-ই দেহের পক্ষে ভীষণ রকম ক্ষতিকারক। হেরােইন শরীরের রােগ-প্রতিরােধ ক্ষমতাকে নিঃশেষ করে দেয়। ক্রমশ ভাঁতা, অসাড় হয় মাদকাসক্ত ব্যক্তির মননশক্তি। এদের ক্ষিদে পায় না। ঘুম হয় না। হাসি-কান্নার বােধ থাকে না। ওজন কমে যায়। ধীর ধীরে এক অস্বাভাবিক, জীবন্ত অবস্থায় পৌছে যায়। নিয়মিত নেশাখােরদের হঠাৎ ড্রাগ বন্ধ করে দিলে তার ফল হয় আরও মারাত্মক। শুরু হয় প্রচণ্ড শারীরিক যন্ত্রণা। একে বলা হয় "উইথড্রয়াল সিমটম'। এ অবস্থায় অনেক সময় মানুষটির হৃদযন্ত্র বন্ধ হয়ে যেতে পারে। ঠিক সময়ে 1. নেশার পুরিয়াটি না পেলে শুরু হয় 'টার্কি পিরিয়ড। তখন হাত-পা কাপতে থাকে। পেটে অসহ্য যন্ত্রণা হয়। শরীরে এক অসম্ভব খিচুনি শুরু হয়। চোখ-নাক দিয়ে জল ঝরে। চিকিৎসা না করালে মৃত্যু ঘনিয়ে আসে।
প্রতিকার: মাদকদ্রব্যের ছােবলে গােটা দেশ আজ আক্রান্ত। দুরারােগ্য ব্যাধির মতােই তা তরুণ সমাজকে গ্রাস করছে এর তীব্র দংশনে ছটফট করছে কত ছাত্রযুবক। এর ভয়াবহ পরিণতি দেখে আজ প্রশাসন বিচলিত, অভিভাবকরা আতঙ্কিত, চিকিৎসকেরা দিশেহারা। ড্রাগ আসত্তদের জন্যে খােলা হয়েছে অ্যান্টি ড্রাগ সেল'। ড্রাগের ছােবল থেকে স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রী, যুবসমাজকে বাঁচানাের জন্যে সরকারও এগিয়ে এসেছে। দেশে হেরােইন চোরাচালানীদের বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের মতাে কঠোর আইন হয়েছে। পােস্টারে, বিজ্ঞাপনে, সরকারি প্রচার মাধ্যমে চলছে এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ। ড্রাগ আসক্তদের প্রতি আর কোনাে অবজ্ঞা নয়, সহানুভূতির সঙ্গে তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। ভালােবাসতে হবে সেই পথভ্রান্তদের। আবার তাদের ফিরিয়ে আনতে হবে সুস্থ ও স্বাভাবিক জীবনে। চূড়ান্ত সমাধান ডাক্তার বা প্রশাসনের কারও হাতেই নেই। রয়েছে সম্মিলিতভাবে প্রত্যেকটি মানুষের হাতে। তাই কিশাের-যুব-প্রৌঢ় নির্বিশেষে সকলের ওপরই আজ কঠোর দায়িত্ব। এজন্যে পাড়ায় পাড়ায় গড়ে তুলতে হবে প্রতিরােধ ব্যবস্থা। আজ সবাইকে সামিল হতে হবে এ নেশার বিরুদ্ধে। এ সমস্যার প্রতিকার নিম্নলিখিতভাবে করা যেতে পারে। যেমন:
ক. পরিবারকে অসচেতন, উদাসীন না থেকে তাদের সন্তানদের প্রতি সচেতন হতে হবে।
খ. মাদকদ্রব্য চোরাচালান বিরােধী কর্মসূচিকে জোরদার করতে হবে
গ. বেকার যুবকদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে।
ঘ. মানবিক মূল্যবােধের অবক্ষয় রােধ করতে হবে।
ঙ. ব্যক্তিগত ও সামাজিক দক্ষতা বৃদ্ধির প্রচেষ্টা চালাতে
চ. খারাপ সঙ্গ পরিত্যাগ করতে হবে। হবে।
ছ. মাদকদ্রব্যের কুফল ও মাদকাসক্তদের ভয়াবহ অবস্থার কথা বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে ও সংবাদপত্রে নিয়মিতভাবে প্রচার করতে হবে।
উপসংহার: তরুণ-তরুণীরাই দেশের ভবিষ্যৎ। তারা মাদকাসক্ত হয়ে পঙ্গু হওয়ার অর্থ দেশ পঙ্গু হয়ে যাওয়া। সুস্থ-সবল মানুষই পারে দেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ গড়তে। এ বাস্তব সত্যকে স্বীকার করে নিয়ে নেশার রাহুগ্রাস থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষার দায়িত্ব কেবল সরকারের একার নয়, সকলের।
Post a Comment