বা দুর্যোগপূর্ণ বাংলাদেশ
বা প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বাংলাদেশ
ভূমিকা : নানা বিপর্যয় অতিক্রম করে মানবসভ্যতা বর্তমান পর্যায়ে এসে পৌছেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ সভ্যতাকে বাধাগ্রস্ত করে কিন্তু থামিয়ে রাখতে পারে না। প্রকৃতির ভাণ্ডার মানুষের জন্যে উন্মুক্ত। প্রকৃতির উদারতায় মানুষ জীবনধারণের সমস্ত উপাদান লাভ করে থাকে। আবার এ প্রকৃতিই কখনও কখনও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে এবং সভ্যতার চিহ্ন মুছে দেয়, মানুষের জীবনে দুঃখ, কষ্ট ও চরম দুর্দশা ডেকে আনে। দুর্যোগের কারণ : প্রাকৃতিক দুর্যোগের বিচিত্র কারণ রয়েছে। আবহাওয়া, তাপমাত্রার হ্রাস-বৃদ্ধির, ভৌগােলিক অবস্থান প্রভৃতি কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ সৃষ্টি হয়ে থাকে।
বাংলাদেশের প্রকৃতি : বাংলাদেশের প্রকৃতি তুলনামূলকভাবে জীবনধারণের অনুকূল। সবুজ শ্যামল এ দেশকে সােনার দেশ বলা হয়ে থাকে। এ সােনার দেশের উপর দিয়ে কতবার যে কত ধরনের দুর্যোগ বয়ে গেছে তার হিসেব নেই। ঘূর্ণিঝড়, জলােচ্ছ্বাস, ভূমিকম্প, বন্যা, শীত ইত্যাদি অসংখ্যবার জীবনকে করেছে বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত।
প্রাকৃতিক দুর্যোগের প্রকৃতি : পৃথিবীর সব দেশেই প্রাকৃতিক দুযাের্গ আসে। হয়ত একেক অঞ্চলে দুর্যোগের প্রকৃতি একেক ধরনের। যেমন- আফ্রিকার দেশগুলােতে খরা একটা ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। ইউরােপের দেশগুলােতে শীত, কুয়াশা ও তুষারপাত। আমেরিকা মহাদেশেও তুষারপাত হয়, হয় জলােচ্ছ্বাস ও সাইক্লোন। এশিয়ার দেশগুলােতে ঘূর্ণিঝড়, জলােচ্ছাস ও বন্যার প্রকোপই বেশি। মােটকথা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ কমবেশি সব দেশেই আসে।
ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছাস : বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছাস নতুন কিছু নয়। প্রতি বছরই কমবেশি হয়। তবে এর প্রলয়ংকরী রূপ দিন দিন বেড়েই চলেছে। যে কোন সময় সাগরে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়ে ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছাস হতে পারে। এজন্যে বাংলাদেশের মানুষ বিশেষ করে, সমুদ্রোপকূলবর্তী অঞ্চলের মানুষ আতঙ্কের মধ্যে কালযাপন করে। দ্বীপবাসীরা সবসময় অনিশ্চিত জীবনযাপন করে। অতীতে বহুবার এসব দীপের উপর দিয়ে বয়ে গেছে প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছবাসের ছােবল। ভেসে গেছে ধনসম্পদ, পশু এবং মানুষ। তবু মানুষ বেঁচে আছে প্রকৃতির বিরূপ পরিস্থিতির সাথে লড়াই করে।
ঘূর্ণিঝড়ের অতীত ও বর্তমান : অতীতকাল থেকেই বাংলাদেশে ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছ্বাসের ইতিহাস বিদ্যমান। ১৯৭০ সালে বঙ্গোপসাগরে যে প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড়ের সৃষ্টি হয় তা আঘাত হানে সাগর বুকের দ্বীপগুলােতে। দক্ষিণ অঞ্চলের দ্বীপগুলােতে সে বছর প্রায় ছয় লাখ লােকের প্রাণহানি ঘটে। এভাবে প্রায় প্রতি বছরই ঘূর্ণিঝড় ও জলােচ্ছাস মরণ ছােবল হানে। বর্তমানে আধুনিক বিজ্ঞান বিশেষ করে আবহাওয়া বিজ্ঞানের উন্নতির ফলে আগে থেকেই ঘূর্ণিঝড়ের পূর্বাভাস অনুমান করা যায়। ফলে রেডিও, টিভি ও অন্যান্য প্রচার মাধ্যমে তা প্রচার করা হয়। তাতে মানুষ নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে পারে। ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের রাতে বাংলাদেশে এক ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় হয়, যার ইংরেজি প্রতিশব্দ হ্যারিকেন। দুদিন আগে থেকেই আবহাওয়া অফিস ঘূর্ণিঝড়ের রূপ, প্রকৃতি ও প্রচণ্ড গতিবেগের কথা প্রচার করে আসছিল। তাতে অধিকাংশ মানুষ সরে আসতে পেরেছিল নিরাপদ আশ্রয়ে। কিন্তু হ্যারিকেনের করালগ্রাসে সেসব আশ্রয় স্থলও বিপর্যস্ত হয়। ঘণ্টায় প্রায় ১১০ থেকে ২৪০ কিলােমিটার বেগে এ ঝড় প্রবাহিত হয়। তাতে ১৫ থেকে ২৫ ফুট উচু হয়ে জলােচ্ছাস আছড়ে পড়ে জনপদে। জলােচ্ছ্বাসের উত্তাল স্রোত মানুষ, গবাদিপশু, ঘরবাড়ি, ধনসম্পদকে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। অসহায় মানুষের আর্তচিতকারে এক অভাবনীয় পরিস্থিতির সূত্রপাত ঘটে। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড় ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়ংকর প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এত ক্ষয়ক্ষতি এর আগে আর কোনদিন হয় নি। সে ঘূর্ণিঝড়ে প্রায় এক লাখ মানুষ অসহায়ভাবে মারা গিয়েছিল। নষ্ট হয়েছে গাছপালা, ধ্বংস হয়েছে ঘরবাড়ি, গবাদিপশু, ভেসে গেছে জমির ফসল, অর্থসম্পদ ইত্যাদি। এসব রক্ষা করার জন্যে বাংলাদেশ সরকার যথাসাধ্য চেষ্টা করেও সফল হতে পারে নি।
প্রচণ্ড খরা ও শীত : শীত ও প্রচণ্ড শীতও একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। খরায় প্রায় প্রতি বছরই আমাদের উৎপাদন ব্যাহত হয়। ফসলের চারা পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। তবে শীতের প্রকোপ তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশে কম। কিন্তু ১৯৯৭ সালের শেষ ও ১৯৯৮ সালের প্রথম দিকে কয়েকদিন যে পরিমাণ শীত নেমে আসে, তাতে জনজীবন বিপর্যস্ত হয়।
ভূমিকম্প : ভূমিকম্প একটা ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগ। অবশ্য বাংলাদেশে এর প্রকোপ কম। এশিয়ার পূর্বাঞ্চলীয় দেশ জাপানেই সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্প হয়।
বন্যা : বন্যা বাংলাদেশে প্রায় নিয়মিত একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। প্রতি বছর বন্যায় নষ্ট হচ্ছে ফসল, ভেসে যাচ্ছে ঘরবাড়ি, গবাদিপশু ইত্যাদি। বন্যার সময় অসহায় মানুষ রেল সড়কে, বাঁধের উপর, সকুল ঘরে আশ্রয় নিয়ে অনাহারে, অর্ধাহারে মানবেতর জীবনযাপন করে।
প্রাকৃতিক দুর্যোগে বিশ্ব বিবেক : বাংলাদেশের প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রতিবারই বিশ্ব বিবেক সাড়া দিয়েছে। বিদেশী সাহায্য এসেছে উপদ্রুত অঞ্চলের মানুষের জন্যে। মানবতার সেবায় এগিয়ে এসেছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জাপান, আরব বিশ্ব, ভারত এবং আরও অনেক বন্ধু প্রতীম দেশ
উপসংহার : প্রকৃতি তার স্বাভাবিক নিয়মে চলে। তাই প্রকৃতির কাছে মানুষ বড় অসহায়। প্রকৃতি যখন রুদ্ররােযে উন্মও হয়ে উঠে তখন তার ভয়ংকরী ছােবল থেকে রক্ষা পাওয়ার কোন উপায় থাকে না। তবুও মানুষ নিশ্চেষ্ট নয়। সবসময়ই উপায় খুঁজে ফেরে।
Post a Comment