SkyIsTheLimit
Bookmark

রচনা জাতীয় জীবনে আকাশ-সংস্কৃতির প্রভাব

ভূমিকা : আধুনিক সময়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভূতপূর্ব উৎকর্ষে বিশাল পৃথিবীর গণ্ডি ছােট হয়ে এসেছে। সেই সঙ্গে পৃথিবীময় ভিন্ন সংস্কৃতির মাঝে আদান-প্রদানের প্রক্রিয়াও হয়েছে অনেক সহজ। ভূ-উপগ্রহ তেমনি এক যুগান্তকারী আবিষ্কার যার মাধ্যমে পৃথিবীব্যাপী বিস্ময়কর যােগাযােগ সাধন সম্ভব হয়েছে। স্যাটেলাইট চ্যানেলের প্রভাবে আমাদের জীবন সংস্কৃতির যে রূপ দাঁড়িয়েছে, তাকেই আমরা বলছি আকাশ সংস্কৃতি। আকাশ সংস্কৃতির কল্যাণে ঘরে বসেই আমরা এখন দেশ-বিদেশের নানা টেলিভিশন অনুষ্ঠান সারাক্ষণ দেখার সুযােগ পাচ্ছি। আন্তর্জাতিক অঙ্গনের নানা খবরাখবরের পাশাপাশি বিভিন্ন রকম বিনােদন ও শিক্ষামূলক অনুষ্ঠানও দেখা সম্ভব হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষামূলক ও মানবসম্পদ অনুষ্ঠানের পাশাপাশি টিভি চ্যানেলগুলােয় প্রচারিত হচ্ছে। অনেক কুরুচিপূর্ণ ও মানহীন অনুষ্ঠানও। তাই আকাশ সংস্কৃতির সুফল কুফল নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
স্যাটেলাইট টিভির ইতিহাস : ১৯৬২ সালে টেলস্টার উপগ্রহের মাধ্যমে ইউরােপ থেকে উত্তর আমেরিকায় সংকেত প্রেরণের মাধ্যমে স্যাটেলাইট সংস্কৃতির যাত্রা শুরু হয়। বাণিজ্যিকভাবে বিশ্বের প্রথম যােগাযােগ উপগ্রহ ইনটেলস্যাট' কক্ষপথে প্রেরণ করা হয় ১৯৬৫ সালে। জাতিভিত্তিক প্রথম স্যাটেলাইট টেলিভিশনের সংযোগ স্থাপনের কৃতিত্ব সােভিয়েত ইউনিয়নের ১৯৬৭ সালে। বিশ্বের প্রথম শিক্ষামূলক, - পরীক্ষামূলক ও সরাসরি সম্প্রচারযােগ্য স্যাটেলাইটের উদ্ভব হয় ১৯৭৪ সালে। বাসা-বাড়িতে সরাসরি টেলিভিশনের মাধ্যমে এই সংস্কৃতির প্রচলন হয় ১৯৭৬ সালে।
বাংলাদেশে আকাশ সংস্কৃতি : বাংলাদেশে আকাশ সংস্কৃতির প্রবর্তন খুব বেশিদিন আগের নয়। ১৯৯২ সালে প্রথম সিএনএন ও পরে বিবিসি। টেলিভিশনের সঙ্গে উপগ্রহ সংযােগ স্থাপনের মাধ্যমে ও ডিশ অ্যান্টেনা ব্যবহার অনুমােদনের মাধ্যমে বাংলাদেশে স্যাটেলাইট সম্প্রচারের সুযােগ সৃষ্টি হয়। ঘরের ছাদে বিশালকার ডিশ অ্যান্টেনা স্থাপন করা প্রথম দিকে ছিল ব্যয়সাধ্য। তাই এর ব্যবহার ছিল প্রধানত বিত্তবানদের মাঝেই সীমিত। পরবর্তীকালে কেবল নেটওয়ার্ক তৈরির মাধ্যমে মাসিক চাঁদা প্রদানের ভিত্তিতে তা ব্যবহারের উপযােগী হয়েছে সব শ্রেণির মানুষের জন্যে। এর ফলে শহর ও মফস্বলের গণ্ডি ছড়িয়ে গ্রামগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ছড়িয়ে গেছে স্যাটেলাইটের ব্যবহার। 
দেশি-বিদেশি নানা চ্যানেল : নানা রকম চ্যানেলে শিক্ষা, সাহিত্য, বিনােদন, খেলাধুলা, প্রাণিজগৎ, প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন রকম বৈচিত্র্যময় অনুষ্ঠান উপভােগ করছে অগণিত মানুষ। দেশি চ্যানেলগুলাের মধ্যে রয়েছে বিটিভি ওয়ার্ল্ড, একুশে টেলিভিশন, চ্যানেল আই, এটিএন বাংলা, এনটিভি, আরটিভি, বৈশাখী, ইনডিপেনডেন্ট ইত্যাদি। বিদেশি চ্যানেলগুলোর মধ্যে রয়েছে নানা রকম বিশেষায়িত চ্যানেল। এগুলোের মধ্যে উল্লেখযোগ্য স্টার মুভিজ, স্টার প্লাস, এএক্সএন, জি সিনেমা, স্টার স্পাের্টস, ইএসপিএন, এমটিভি, কার্টুন নেটওয়ার্ক, সনি, জিটিভি, এইচবিও, জি ক্যাফে, ডিজনি ইত্যাদি। শিক্ষামূলক ও সুস্থ বিনােদনমূলক অনুষ্ঠানের পাশাপাশি এ চ্যানেলগুলোর কোনাে কোনােটিতে প্রচারিত হচ্ছে স্থল ও উত্তেজক অনুষ্ঠানও। 
স্যাটেলাইটের উপযােগিতা : স্যাটেলাইট টিভি বিশ্বের সংস্কৃতির সাথে আমাদের যােগসূত্র ঘটিয়েছে। বিবিসি, সিএনন, এটিএন নিউজ ইত্যাদি সংবাদ ও তথ্যভিত্তিক চ্যানেলগুলাে প্রতিমুহূর্তে আমাদের অবহিত করছে বিশ্বের নানা প্রান্তের তথ্য ও ঘটনা সম্পর্কে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, ডিসকভারি, অ্যানিমেল প্ল্যানেট ইত্যাদি চ্যানেলের অনুষ্ঠানমালা বিশ্ব ও প্রাণিজগতের নানা অজানা তথ্য জানাচ্ছে আমাদের। বিভিন্ন বিনােদনমূলক চ্যানেলে আমরা বিশ্বের হাজারাে সংস্কৃতির শিল্প, সাহিত্যের স্বাদ পাচ্ছি। বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উপভােগ করতে পারছি তথ্যচিত্র, চলচ্চিত্র, নাটক, গানসহ নানামাত্রার বিনােদন অনুষঙ্গ। খেলাধুলার চ্যানেলগুলোর মাধ্যমে ক্রীড়াপ্রেমীরা উপভােগ করতে পারছে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের খেলাধুলা। উন্নত বিশ্বে শিক্ষা ও জীবনযাত্রার বিভিন্ন অনুকরণীয় দিকগুলোে টেলিভিশনের মাধ্যমেই জানা যাচ্ছে। মােটকথা উন্নত মেধা ও মননের চর্চায় স্যাটেলাইট সংস্কৃতির অবদান অনস্বীকার্য। 
স্যাটেলাইটের নেতিবাচক দিক : স্যাটেলাইট টিভি-ভিত্তিক আকাশ সংস্কৃতির ইতিবাচক দিকগুলাের পাশাপাশি নেতিবাচক দিকগুলােও বেশ প্রকট। স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলােতে মূলত প্রাধান্য বিস্তার করে আছে পশ্চিমা সংস্কৃতি। আর এই পশ্চিমা সংস্কৃতির আগ্রাসী ভূমিকায় ক্রমান্বয়ে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে বিভিন্ন দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি। বিদেশি সংস্কৃতি সর্বক্ষেত্রে পরিত্যাজ্য নয়। কিন্তু তা গ্রহণ করা উচিৎ দেশীয় সংস্কৃতির ও মূল্যবােধের কথা বিবেচনা করে। বিদেশি সংস্কৃতির এই আগ্রাসনের কবলে পড়েছে বাংলাদেশের সংস্কৃতিও। সঠিকভাবে এই সংস্কৃতির ব্যবহার না হওয়ায় তরুণ প্রজন্মের ঐতিহ্য ও মূল্যবােধে লক্ষণীয় পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন অনুষ্ঠানে স্থূল যৌনতা, লােমহর্ষক খুন-জখম, হানাহানি, উদ্ভট অতিপ্রাকৃত কাহিনি উপস্থাপিত হয়, যেগুলােতে সহজে আসক্ত হচ্ছে তরুণ সমাজ। পশ্চিমা আগ্রাসনের মতােই ভারতীয় বাণিজ্যিক, অনুষ্ঠানগুলো ক্ষতি করছে বাংলাদেশের সংস্কৃতিকেও। সংস্কৃতির সকল ক্ষেত্রে অতিমাত্রায় বাণিজ্যিকীকরণ জন্ম দিচ্ছে নানারকম অপসংস্কৃতির যা স্যাটেলাইট চ্যানেগুলাের মাধ্যমে এসে কলুষিত করছে আমাদের চেতনা। সংস্কৃতির এই আগ্রাসনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মূলত উন্নয়নশীল দেশগুলাের সংস্কৃতি। তবে উন্নত দেশগুলােতেও এ পরিস্থিতির তেমন ব্যতিক্রম নেই। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে টেলিভিশনে প্রচারিত বিভিন্ন স্নায়ু উত্তেজক অনুষ্ঠানমালার কারণে মূল্যবােধের অবক্ষয় ঘটছে দেশে দেশে। দেশীয় চ্যানেলগুলাে ক্রমশ দেউলিয়া হয়ে পড়ছে। তারা বাধ্য হচ্ছে বিদেশি চ্যানেলগুলাের অনুকরণে অনুষ্ঠানমালা সাজাতে। স্যাটেলাইট চ্যানেলের সর্বগ্রাসী রূপের কারণে আজ উদ্বিগ্ন সচেতন মানুষ। 
আকাশ সংস্কৃতির প্রভাব : দৈনন্দিন জীবনে আকাশ সংস্কৃতির ইতিবাচক ও নেতিবাচক উভয় প্রভাবই লক্ষ করা যায়। স্যাটেলাইট চ্যানেলের কল্যাণে এখন খুব সহজেই মানুষ খবরের শিরােনাম হতে পারছে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের সফলতা, সংকট, সম্ভাবনা ও বঞ্চনার কথা উঠে আসছে খবরের মাধ্যমে বা প্রতিবেদন আকারে। স্যাটেলাইট চ্যানেলের প্রভাবে আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রায় এসেছে পরিবর্তন। চালচলন, পােশাক-পরিচ্ছদ, ভাষাবৈশিষ্ট্য ইত্যাদিতে পরিবর্তন ঘটছে। এর প্রভাবে। ভারতীয় বিভিন্ন মেগা সিরিয়ালে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে থাকছেন। গৃহিণী ও তরুণীরা। বিভিন্ন উৎকৃষ্ট বিনােদন মাধ্যম যেমন- খেলাধুলা, বইপড়া, বাগান করা ইত্যাদির চেয়ে অনেকের কাছে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। টেলিভিশন দেখা। একই সাথে স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলোর মানহীন অনুষ্ঠানের কারণে একটি বিরাট অংশ হচ্ছে টেলিভিশন-বিমুখ। বিভিন্ন প্রতিযােগিতায় ব্যাপকহারে প্রবেশ করেছে বাণিজ্যিকীকরণ। মঞ্চের অনুষ্ঠানগুলাে এখন সরাসরি প্রচারিত হচ্ছে স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলােতে। ফলে একটি বিশাল জনগােষ্ঠী ঘরে বসেই দেখতে পারছে অনুষ্ঠানগুলো। কিন্তু এই অনুষ্ঠানগুলােতেও মুখ্য হয়ে উঠছে বাণিজ্য; তাই প্রাণ হারাচ্ছে মঞ্চের অনুষ্ঠানগুলাে। খেলাধুলাকে কেন্দ্র করে প্রায়ই সারাদেশে সৃষ্টি হচ্ছে উৎসমুখর পরিবেশের। আর তা সম্ভব হয়েছে স্যাটেলাইট চ্যানেলগুলাের সহজলভ্যতার কারণেই। এই সহজলভ্যতা ও ব্যাপকতার কারণে একই সাথে আবার আমরা খবর রাখতে পারছি না সব অনুষ্ঠানের । তাই অনেক মানসম্মত অনুষ্ঠান থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। বিভিন্ন বিশেষায়িত চ্যানেলে প্রচারিত হচ্ছে টক-শাে ও প্রকৃতিকেন্দ্রিক অনুষ্ঠান এ অনুষ্ঠানগুলাে মানুষকে রাজনীতি ও পরিবেশ-সচেতন করে তুলছে এবং এ ব্যাপারগুলােতে মানুষের আগ্রহ বাড়িয়ে তুলছে। 
বাংলাদেশে আকাশ সংস্কৃতির সম্ভাবনা : আকাশ সংস্কৃতির ইতিবাচক দিকগুলাে সঠিকভাবে গ্রহণ করে বাংলাদেশে তৈরি করা সম্ভব নানা সম্ভাবনার ক্ষেত্র। দেশি চ্যানেলগুলাের মান নিম্নমুখী হওয়ায় দিন দিন মানুষ ঝুঁকছে বিদেশি চ্যানেলগুলাের দিকে। তবে এই বিশ্বায়নের যুগে দেশি চ্যানেল, বিদেশি চ্যানেল ভেদাভেদ করে খুব বেশি লাভবান হওয়া যাবে না। বিদেশি চ্যানেলগুলােতে প্রচুর শিক্ষামূলক ও উন্নতমানের অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়ে থাকে। তাই যে অনুষ্ঠানগুলো আমাদের সুস্থ ও সুন্দর বিনােদন প্রদানে সক্ষম ও আমাদের মানবিক মূল্যবােধের উৎকর্ষে সাহায্য করে, সর্বোপরি দেশ, সমাজ ও জাতি গঠনে সহায়ক সে অনুষ্ঠানগুলােকেই বেছে নিতে হবে। দেশি চ্যানেলগুলাের উৎকর্ষের জন্য প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকেই। সেই সঙ্গে বিদেশি সংস্কৃতির অপ্রয়ােজনীয় অংশ যেন আমাদের সংস্কৃতির ক্ষতি না করতে পারে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। আমাদের দেশে এখন পর্যন্ত বিশেষায়িত চ্যানেলের সংখ্যা হাতে গােনা। শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন মাধ্যমকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন বিশেষায়িত চ্যানেল গড়ে তােলা উচিত। এছাড়াও খেলাধুলা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিশুতােষ, পরিবেশ ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে টেলিভিশন চ্যানেলের প্রয়ােজনীয়তা বিশেষভাবে অনুভব করা যাচ্ছে। আকাশ সংস্কৃতির ছোঁয়ায় নিজেদের সংস্কৃতির মাননান্নয়নের জন্য এই সম্ভাবনাগুলাের দিকে যত দ্রুত সম্ভব দৃষ্টি দিতে হবে।
উপসংহার : আধুনিক সময়ে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় স্যাটেলাইট সংস্কৃতির বিকল্প নেই। কিন্তু এ থেকে উদ্ভাবিত অপসংস্কৃতির আগ্রাসনে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে দেশজ সংস্কৃতি। ক্ষয় হচ্ছে মানবিক মূল্যবােধের।। দুর্বল হয়ে পড়ছে সামাজিক বন্ধন। বিশ্বের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্য বিনােদনের জন্য আমাদের অবশ্যই দরজা-জানালা খােলা রাখতে হবে। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে আমরা যেন আমাদের স্বকীয়তা না হারিয়ে বসি। তাই এখন থেকে সচেতন হতে হবে যেন অপসংস্কৃতির আগ্রাসনে অসুস্থ হয়ে না পড়ে গােটা সমাজ। সুস্থ সংস্কৃতিক চর্চার জন্য মানসম্মত অনুষ্ঠান নির্বাচনে চাই সঠিক শিক্ষা ও সচেতন মানসিকতা।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment