জ্বালানির উৎস : শক্তি এমনই একটি জিনিস যার বিনাশ নেই, যা সৃষ্টিও করা যায় না। কেবল ঘটানাে যায় শক্তির রূপান্তর। প্রকৃতপক্ষে জড়ই শক্তি। আজ পর্যন্ত যত প্রকার শক্তি মানুষের করায়ত্ত হয়েছে তা সম্ভব হয়েছে জড় পদার্থকে নির্দিষ্ট শক্তিতে রূপান্তরিত করার কলাকৌশলের মধ্যস্থতায়। শক্তির উৎস বিবিধ। তাদের মধ্যে আমাদের কাছে অতি পরিচিত হচ্ছে। কয়লা, পেট্রোলিয়াম, প্রাকৃতিক গ্যাস প্রভৃতি। এগুলো আমাদের কাছে জ্বালানি বলেও গণ্য। তাছাড়া জল, সূর্য-রশ্মি, জ্বালানি কাঠ, প্রাণী-বিষ্ঠা, পাওয়ার অ্যালকোহল , বাতাস, সমুদ্রের জল প্রভৃতিও অন্যান্য শক্তির উৎস।
জ্বালানি সংকটের কারণ : কেন এ জ্বালানি সংকট। আমরা জানি, কয়লা ও গ্যাস অন্যতম জ্বালানি-উৎস। শিল্পে, পরিবহনে, রান্নার কাজে প্রচুর পরিমাণে কয়লা ও গ্যাস ব্যবহৃত হয়। এছাড়া বিভিন্ন গ্যাস অপচয় হয় প্রচুর পরিমাণে। সামান্য এক একটা দেয়াশলাইর কাঠি বাঁচাতে অপরিণামদর্শী জনগণ গ্যাসের চুলা জ্বালিয়ে রাখে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। এতে বিপুল পরিমাণ গ্যাসের অপচয় হয়। এভাবে ব্যয়ের হার অব্যাহত থাকলে এবং অপচয় রােধ করা সম্ভব না হলে কয়েক দশক পরেই কয়লা ও গ্যাস হবে অতীত ইতিহাসের বস্তু। কারণ, ব্যয়ের সাথে পাল্লা দিয়ে সৃষ্টির ক্ষমতা মানুষের আদৌ নেই, তাই ক্রমশ ঘনীভূত হচ্ছে জ্বালানি-সংকট। প্রকৃতির সীমিত সঞ্চয়ের ব্যয়জনিত ঘাটতি পূরণের অক্ষমতাই মানুষকে শক্তি-উৎস সম্পর্কে চিন্তান্বিত করছে সর্বাধিক।
বিবিধ বিকল্প শক্তির উৎস : জ্বালানি-সংকটের ভয়াবহতা থেকে পরিত্রাণের উদ্দেশ্য বিশ্বজুড়ে চলছে বিকল্প শক্তি উৎসের সন্ধান। এ নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক শক্তি সম্মেলনে বিশ্বের বিজ্ঞানীরা সংকট সমাধানের উদ্দেশ্যে পারস্পরিক সহযােগিতার উপর গুরুত্ব দিয়ে চৌদ্দটি বিকল্প শক্তি উৎসের কথা বলেছেন। সেগুলাের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল সৌরশক্তি , বায়ুশক্তি, পরমাণুশক্তি, জোয়ার-ভাটা থেকে প্রাপ্ত শক্তি, ভূ-তাপীয় শক্তি, সাগরের তাপীয়শক্তি, গােবর গ্যাস প্রভৃতি। আমাদের মত গরিব দেশের পক্ষে ভূ-তাপীয়শক্তি, পরমাণু শক্তি, তরঙ্গ শক্তি, জোয়ার-ভাটা থেকে প্রাপ্ত শক্তির উৎসগুলাে থেকে শক্তি সৃষ্টি সভবপর নয়, কারণ তা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সৌরশক্তি, বায়ুশক্তি, জ্বালানি কোষ, স্বল্প উচ্চতার হেড, গােবর গ্যাস প্রভৃতি শক্তি-উৎসগুলাে অপেক্ষাকৃত কম ব্যয়সাধ্য এবং এগুলোর উপর দৃষ্টিনিবদ্ধ করলে দেশ উপকৃত হবে।
সৌরশক্তি : প্রথমেই উল্লেখ করতে হয় সৌরশক্তির। মৌসুমী বায়ুর প্রবাহে জুনের মাঝামাঝি সময় থেকে সেপ্টেম্বর-এর মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বর্ষণের প্রকোপ থাকলেও বছরের অবশিষ্ট দিনগুলাে প্রায়ই মেঘমুক্ত রৌদ্রজ্জ্বল থাকে। সুতরাং সূর্যরশ্মি অফুরন্ত এবং জ্বালানির অভাব ঘােচাতে সূর্যরশ্মি বিশেষভাবে সাহায্য করতে পারে। সোেলার সেল বা সৌরকোষের মাধ্যমে সূর্যরশ্মি তড়িৎশক্তিতে রূপান্তরিত হয়ে ব্যবহারােপযােগী হতে পারে। তাছাড়া সূর্যের আলাে সােলার কুকারের মাধ্যমে রান্নার কাজে সাহায্য করে জ্বালানি সরবরাহে সহায়ক হতে পারে।
বায়ুশক্তি : আদিম মানুষ যে বাতাসকে ভয় পেত, সভ্যতার বিকাশের সাথে সে বাতাসকে শক্তি হিসেবে ব্যবহার করে মানুষ R কাজে লাগাতে শিখল। চার-পাঁচটা পাখার সাহায্যে তৈরি চক্রকে প্রবাহিত বাতাসের মুখােমুখি ধরে ঘূর্ণায়মান চক্রের দণ্ডের সঙ্গে বিশেষ কৌশলে দড়ি বেঁধে কুয়ো থেকে জল তুলে চাষ-আবাদ করতে লাগল। পরে আখ মাড়াই, গম ভাঙানাে, ধান কাটা নানান কাজে বায়ুশক্তির ব্যবহার ব্যাপকতা পেল। এ হাওয়া কল বা বায়ু-যন্ত্র, যার ইংরেজি নাম উইন্ড মিল পৃথিবীর বহুদেশেই, বিশেষ করে যারা সারা বছর একই দিক থেকে প্রবাহিত বায়ু-স্রোতের ভিতর বাস করে, তারা বৃহত্তর কাজে লাগিয়ে শক্তির বিকল্প হিসেবে ব্যবহার করছে।
অন্যান্য শক্তি-উৎস : ভূ-তাপীয় শক্তিও জ্বালানির বিকল্প উৎসরূপে ব্যবহার্য। পৃথিবীর অভ্যন্তরভাগ খুবই উত্তপ্ত। অনেক সময় প্রস্রবণের জলের সাথে বেরিয়ে আসে উত্তপ্ত ম্যাগমা। ফলে এ জল থেকে পাওয়া যায় প্রচুর তাপশক্তি। এরই নাম ভূ- তাপীয় শক্তি। ভূ-তাপীয় শক্তিকে সরাসরি রূপান্তরিত করে পাওয়া যায় বিদ্যুৎশক্তি। এদেশে গােবর গ্যাস প্রকল্প খুবই জনপ্রিয়। গােবরের যােগান এ প্রকল্পের কাঁচামাল। ঘরে আলাে জ্বালাতে ও রান্নার জ্বালানি হিসেবে গােবর গ্যাস খুবই উপযােগী। জলবিদ্যুৎ শক্তি ও পরমাণুশক্তির ব্যবহারও আধুনিক মানুষের কাছে সুপরিচিত।
উপসংহার : প্রচলিত শক্তি উৎসগুলাের ক্ষীয়মাণ সংকোচন নতুন নতুন উৎস সন্ধানে প্রয়াসী মানুষকে দুশ্চর গবেষণায় করেছে ধ্যানস্থ। কথায় বলে প্রয়ােজনের তাগিদই আবিষ্ক্রিয়ার দ্বার দেয় খুলে। নিরন্তর শ্রম, সাধনা ও নিরলস গবেষণা ভবিষ্যতে এমন কোন অফুরান শক্তি-উৎসের সিংহদ্বার হয় তাে মানুষের কাছে উদ্ঘাটিত করবে যখন জ্বালানি-সংকটের দুশ্চিন্তা তাকে আর এমন করে ভ্রান্ত ও বিব্রত করবে না।
Post a Comment