বা একবিংশ শতাব্দী ও বাংলাদেশ
বিশ শতকের বাংলাদেশ : সুদীর্ঘ দুশ বছর ব্রিটিশ শাসনের যাতাকলে নিষ্পেষিত হয়েছে বাঙালি। তাদের সৃষ্টি কালচার হয়েছে ভূলুণ্ঠিত। পদে পদে লাঞ্ছনা বঞ্চনা, শােষণ আর নির্যাতনের বিরুদ্ধে বাঙালি জীবন ধারণ করে আছে কোনমতে। বিশ শতকের মাঝামাঝি বাংলাদেশ পাকিস্তানি ছত্রছায়ায় আংশিক স্বাধীনতা লাভ করে বলে তাতে বাংলাদেশের প্রভু বদল ছাড়া বাস্তব কিছু ঘটেনি। ব্রিটিশ শাসনের অবসানে পাকিস্তানিরা চেপে বসে বাঙালিদের বুকে জগদ্দল পাথরের মত। আঘাত আসে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির উপর। কিন্তু বাঙালি ঐতিহ্য তথা সংগ্রামপ্রিয়তা থেমে থাকে নি। ভাষার জন্য উৎসর্গিত হল তাজা বুকের রক্ত। সে রক্তমাখা পিচ্ছিল পথেই একাত্তরের মহান মুক্তি সংগ্রাম, ত্রিশ লাখের জীবন দান, লক্ষ মা-বােনের ইজ্জত দান আর সহস্র সহস্র কোটি টাকার সম্পদ, ভােট দিয়ে অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর উঠল পূর্ব দিগন্তে স্বাধীনতার লাল সূর্য। বিগত শতক ও সহস্রাব্দে বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পত্তন। এ গর্ব নিয়েই স্বাগত জানাই নতুন শতককে, নতুন সহস্রাব্দকে।
বর্তমানের বাংলাদেশ : আজো বাংলাদেশ তার মনের মতাে সাজে সজ্জিত হতে পারে নি। বহুবিধ সমস্যা আর প্রতিকূলতা ক্রমেই ঘিরে ফেলেছে এ দেশকে। এসব সমস্যার অন্যতম প্রধান হল দারিদ্র্। এ থেকে উত্তরণের সমস্ত পথই যেন রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। ভয়াবহ জনসংখ্যা বিস্ফোরণের মারাত্মক প্রতিক্রিয়ায় দিন দিন বাড়ছে বেকারের সংখ্যা, সে সাথে সৃষ্টি হচ্ছে নানাবিধ সমস্যা। বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা লাভের সুযোগ খুবই সীমিত। জাতীয় প্রবৃদ্ধি নেই বললেই চলে। আন্তর্জাতিক দেনার দায়ে জর্জরিত এ দেশ ।
গ্রাম ও শহরের বৈষম্য : বাংলার পল্লী আজ তার নিজস্ব প্রকৃতি হারিয়েছে। দিন দিন যেন বাংলা নিঃস্ব হয়ে পড়েছে। এক সময় প্রবাদ ছিল "মাছে ভাতে বাঙালি কিংবা "পুকুর ভরা মাছ আর গােয়াল ভরা গরু"-এখন শুষু প্রবাদহ শােনায়। বাস্তর চিত্র ভিন্নরূপ। আজ মানুষ ক্রমেই শহরমুখী। উপার্জনের আশায়, একটু সচ্ছল জীবনের প্রত্যাশায় শহরমুখী মানুষের ভিড উপচে পড়ছে। গ্রামের গাছপালা নিধন হয়ে যাচ্ছে অবিবেচকের মতাে, নদী শুকিয়ে গেছে, বহু সােনালী ধানের জমিত মানুষ নিজ মাথা গোঁজার ঠাই করে নিচ্ছে। শহরে উচু উচু দালানের সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে ঠিকই, আধুনিক সভ্যতার ছিটে ফোটা কোথাও কোথাও পরিলক্ষিত হলেও সমস্যা কম নয়। শহরমুখী মানুষের বাস্তুসংস্থানের জন্য বস্তির ঘিঞ্জি পরিবেশ, যানজট, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে সমস্যা, কর্মক্ষেত্রে প্রতিযােগিতা, স্বজনপ্রীতি, দুর্নীতি মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। বর্তমানে যেন কোথাও বুক ভরে শ্বাস নেবার উপায় নেই। সর্বত্রই শুধু সমস্যা আর সমস্যা। উপরন্তু সন্ত্রাস এখন বাংলাদেশের এক অতি পরিচিত শব্দ। চাঁদাবাজি, রাহাজানি, অপহরণ, নারী ধর্ষণ যে হারে বৃদ্ধি পেয়েছে তাতে মানবতা নিভৃতে কাদা ছাড়া যেন আর কিছুই করার নেই। আইন-শৃঙ্খলার অবনতি, রাজনৈতিক অসহিষ্ণুতা সমস্যা জটকে আরাে বেশি জটিল করে তুলছে।
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশ: সহস্র সমস্যার মাঝেও বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অবদান রেখে চলেছে। বিশ্ব ভ্রাতৃত্বের চেতনাধারী বাংলাদেশ বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে সবসময়। আন্তর্জাতিক ফোরামে বাংলাদেশের ভূমিকা প্রশংসিত হয়েছে এবং হচ্ছে। বহুজাতিক বাহিনীতে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ, সাইপাস-নামিবিয়া, সিয়েরা লিওনে সৈন্য ফিলিস্তিন সমস্যার জোরালাে বক্তব্য প্রদান বাংলাদেশের মর্যাদা বাড়িয়েছে বহুগুণে। বর্তমানে বাংলাদেশ নিরাপত্তা পরিষদের অস্থায়ী সদস্য নির্বাচিত হয়েছে, সে সাথে বাঙালির গর্ব, বাঙালির অহজ্কার ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান একটি অনন্যসাধারণ ঘটনা। বিশ্বময় বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে পারা আমাদের এক গৌরবের ব্যাপার। ক্রীড়াঙ্গনে বিগত শতকে বাংলাদেশ আরেকটি মাইলস্টোন স্থাপন করেছে। সারা বিশ্ব চমৎকৃত হয়েছে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে সােনার ছেলেদের হুজ্কারে। আই. সি. সি. চ্যাম্পিয়ন হওয়া, বিশ্বকাপে পাকিস্তানকে পরাজিত করতে পারা-সবই এক একটা ইতিহাস। এই সােনালি ইতিহাসের মণিকোঠায় পা রেখেই একবিংশ শতকে বাংলাদেশের পদচারণা আরাে তাৎপর্যময় হবে, বাঙালি জাতি সদর্পে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে এটিই সবার প্রত্যাশা।
বিগত শতকের শ্রেষ্ঠ বাঙালি: বিগত শতাব্দীতে বাঙালি গর্ব করার মতাে দুই সন্তান রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ও অমর্ত্য সেনের ননাবেল পুরস্কার লাভ বাঙালি জাতির শিরকে সমুন্নত করেছে। সে সাথে গত শতকে বাঙালি পেয়েছে শরৎচন্দ্র, ৪৮৫ নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাস, বুদ্ধদেব বসু, জসীমউদ্দিনের মতাে কালজয়ী লেখককে; পেয়েছে জয়নুল আবেদীন, কামরুল হাসান, এস. এম. সুলতান প্রমুখ প্রখ্যাত চিত্রশিল্পীকে। সঙ্গীতের ক্ষেত্রে আলাউদ্দিন খাঁ, গােলাম আলী খাঁ, রবি শংকর, বেলায়েত খাঁ প্রমুখ বিশ্বসভায় নিজ নামে পরিচিত। রাজনীতির ক্ষেত্রে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস, সুভাষ বােস, মাওলানা ভাষানী, এ. কে. ফজলুল হক, সােহরাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজ মহিমায় সমুজ্জল। এদের স্মৃতির সারণি ধরেই বাংলাদেশ একবিংশ শতাব্দীতে নিজেদের মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে এটিই প্রত্যাশা সকলের।
উপসংহার: বাংলাদেশের সর্বত্র আজ বিচারের বাণী নিভৃতে কাদছে। মাদকসক্তি আমাদের সমাজকে পঙ্গু করে দিয়েছে। মরণ নেশায় মেতেছে যুব সম্প্রদায়। এ থেকে উত্তরণের পথ খুঁজে নিতে হবে। নতুন শতকের কাছে প্রত্যাশা এদেশের আর কোন নারী নির্যাতিত হবে না, অসহায়ত্বের শিকার হবে না। এদেশের প্রতিটি শিশুই প্রকৃত মানব সন্তানের মতাে বেড়ে উঠবে অনাহারে, বিনা চিকিৎসায় মারা যাবে না একজন মানুষও। প্রত্যাশা করি নতুন শতকে এদেশ হবে দুর্নীতিমুক্ত দেশ। ফুটপাতে পড়ে থাকবে না একজন ভিখেরী। রাজনীতির অসহিষ্ণুতা বিদূরিত হবে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যারা থাকবেন তারা হবেন আকাশের মতােই উদার। লােভলালসা, হানাহানি কিছুই স্পর্শ করতে পারে না তাদের। তবেই বাংলাদেশ সােনার বাংলা হয়ে বিশ্বসভায় মজবুত করতে পারবে নিজ আসন।
Post a Comment