বা শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস ও রাজনীতি
ভূমিকা : শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। শিক্ষাঙ্গন পবিত্রতম স্থান। এখান থেকে উপযুক্ত শিক্ষা গ্রহণ করে স্বাধীন দেশের ভবিষ্যৎ নাগরিকেরা সুযােগ্য হয়ে বেরিয়ে আমাদের আশান্বিত করে তুলবে। কিন্তু বর্তমানে আমাদের ভবিষ্যৎ আশার স্থলে শিক্ষার্থীদের এক নৈরাজ্যের মধ্যে অথিবাহিত করতে হচ্ছে। তারা আজ ভয়াবহ সন্ত্রাসের অসহায় শিকার হয়ে পড়েছে। বর্তমান অবস্থা : দেশের শিক্ষাজ্ঞনগুলাের দিকে তাকালে একটি বেদনাদায়ক চিত্র সহজেই চোখে পড়ে। একটা চরম অশান্ত পরিবেশ প্রায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে বিরাজ করছে। প্রকাশ্যে অস্ত্রের ঝঙ্কারে নিরীহ ছাত্রসমাজ, আতজ্কিত। অস্ত্রের খেলা শুরু হয় প্রতিদ্বন্দ্বী ছাত্রদলের মধ্যে। মাঝে মাঝে ছাত্রাবাসগুলাে বােমা তৈরির কারখানায় রূপান্তরিত হয়। যেন সামান্য বিরোধিতায় শুরু হয় অস্ত্রের নির্মম ব্যবহার। পরিণামে অকালে ঝরে যায় সম্ভাবনাময় অনেক তরুণ জীবন। আইন প্রয়ােগকারী সংস্থা কোন নিরাপত্তার সম্ভাবনা দিতে পারে না। শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত ক্লাস হয় না। পরীক্ষার তারিখ পিছিয়ে দেওয়াই এখন নিয়মে দাঁড়িয়ে গেছে।
ক্ষতি : এ অরাজক অবস্থায় চরম ক্ষতি হচ্ছে শিক্ষার্থীদের। মুষ্টিমেয় বিপথগামীর জন্য বিনষ্ট হচ্ছে শিক্ষাঙ্গনের লেখাপড়ার পরিবেশ। নিরীহ ছাত্র নীরবে সহ্য করে নিচ্ছে সকল ক্ষতি। অভিভাবকরা উদ্বিগ্ন হচ্ছেন তাঁদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ ভেবে। কবে শিক্ষাবর্ষ শেষ হবে সে সম্পর্কে নিশ্চিত ধারণা লাভ করার উপায় নেই। এ অবস্থায় ছাত্রসমাজের যে ক্ষতি সাধিত হচ্ছে তা জাতীয় জীবনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। শিক্ষার্থীদের অনেকের জীবনে দেখা দিয়েছে নৈরাশ্য। তারা কিভাবে এ সংকট থেকে উদ্ধার পাবে জানে না। অনেকে নানা প্রলােভনে বিপথগামী হয়ে উচ্ছঙ্খলতার পরিচয় দিচ্ছে। এভাবে জাতির ভবিষ্যৎ হয়ে উঠেছে অন্ধকারাচ্ছন্ন ।
কারণ : শিক্ষাঙ্গনে সুষ্ঠু শিক্ষায় বিঘ্ন সৃষ্টি করে অরাজক অবস্থায় সৃষ্টি করেছে যে সন্ত্রাস, তার কারণ খুঁজে দেখার প্রয়ােজন রয়েছে। দেখা যাচ্ছে যে, এদেশের শিক্ষার্থীরা রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হয়ে পড়েছে। দেশের রাজনৈতিক সংগঠনগুলাের লেজুড় হিসেবে এক একটি ছাত্র সংগঠন রয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলােতে ছাত্ররা শিক্ষিত শ্রেণীর অংশ বলে তারা নানা বিষয়ে সচেতন এবং এ জন্য তারা রাজনীতির সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হয়ে পড়েছে। তারা নিজস্ব সত্তা হারিয়ে রাজনৈতিক সংগঠনের ক্রীড়নক হিসেবে কাজ করে। ফলে শিক্ষার্থীরা রাজনৈতিক পরিস্থিতির শিকারে পরিণত হয়। তারা সন্ত্রাসের মধ্যে পড়ে অদৃশ্য হাতের ইঙ্গিতে। এতে লেখাপড়া হয়ে যায় গৌণ, বাহুশক্তির প্রয়ােগ হয়ে উঠে মুখ্য। তখন প্রকৃত লেখাপড়া থেকে তারা দূরে সরে যায়।
কতিপয় দৃষ্টান্ত : আজকাল শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস একটি বহুল আলােচিত বিষয়। পত্রিকা খুললেই দেখা যায় অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরস্পর বিরােধী দুটো ছাত্র সংগঠনের মধ্যে ভয়ানক গােলাগুলির ফলে এতজন নিহত হয়েছে, এতজন আহত হয়েছে। পাঠকরা এখন আর অতটা উৎসাহ নিয়ে এসব খবর পড়ে না। এতজন ছাত্র মারা গেছে কিংবা এতজনের রগ কেটে দেয়া হয়েছে এসব শুনেও পাঠক নির্বিকার। কারণ, এটা নতুন কোন বিষয় নয়, একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। দেশের শীর্ষস্থানীয় বিদ্যাপীঠগুলােতে সারা বছরই চলছে অস্ত্রের মহড়া। যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে তখন সেই দলের নেতারাই শক্তির উৎস হিসেবে শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানগুলােকে ব্যবহার করে। দলীয় নেতা, কর্মী এবং তাদের পােষা মাস্তান বাহিনীর হাতে নিরীহ ছাত্র- ছাত্রী এবং শিক্ষক-শিক্ষিকা আজ জিম্মি। ব্যাপক অর্থে বলা যায়, শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানসহ আমাদের গােটা শিক্ষা ব্যবস্থাই আজ সামাজিক অবক্ষয়ের শিকার। আমাদের মেকি সমাজে চলছে দুষ্টলােকের শাসন। আমাদের রাজনীতিতে বাড়ছে অবিশ্বাস, বাড়ছে সন্দেহ। আমাদের তরুণ ছাত্রসমাজ তাই বিভ্রান্ত ও লােভাতুর। আমাদের তথাকথিত রাজনৈতিক নেতারা দেশকে ভালাে না বেসে দলকে বেশি ভালােবাসছেন। বেউ কেউ দলকেও ভালাে না বেসে নিজেকেই বেশি ভালােবাসছেন। আজ দেশে চলছে ক্ষমতায় টিকে থাকা আর ক্ষমতাসীনকে টেনে হিচড়ে নামিয়ে ক্ষমতায় যাওয়ার রাজনীতি। হরতাল, ধর্মঘট আজ নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। দেশ চুলােয় যাক, তাতে ক্ষতি নেই, যেমন করেই হােক ক্ষমতার স্বাদ পেতে হবে এ হচ্ছে আমাদের রাজনীতি। আর এ ঘৃণ্য নীতিবর্জিত রাজনীতির শিকার আমাদের কোমলমতি ছাত্রসমাজ।
সন্ত্রাস রােধের উপায় : আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, শিক্ষাঙ্গনে সন্তাস কোন বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর সাথে ছাত্র সমাজ সরাসরি যেমন জড়িত তেমনি পরােক্ষভাবে, শিক্ষক সমাজ এবং অভিভাবকবৃন্দও সম্পর্কিত। সর্বোপরি, এর সাথে জড়িত দেশের রাজনৈতিক দলগুলাে।
শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস রােধের জন্য প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে যা করণীয় তা হল:
১। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়মিত পড়ালেখার পরিবেশ নিশ্চিত করা।
২। ছাত্রদের শিক্ষা সংক্রান্ত দাবিদাওয়াগুলাে চিহ্নিত করে তা সমাধানের জন্যে কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
৩।আমাদের ঘুণে ধরা শিক্ষা প্রশাসনকে ঢেলে সাজানাে এবং শিক্ষা প্রশাসনকে অনিয়ম ও অব্যবস্থার হাত থেকে উদ্ধার করে একে সচল রাখা।
৪। ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে সুষ্ঠু ও সুন্দর রাজনৈতিক সচেতনতা গড়ে তােলা, যার ভিত্তিতে পরমত সহিষ্ণুনতার মতে গুণ অর্জন সম্ভব।
৫। অছাত্রদেরকে শিক্ষাঙ্গন থেকে বহিষ্কার করা।
৬। সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয় আইন মােতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
৭। শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস দূর করার জন্য দেশের রাজনৈতিক দলগুলাের সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ।
উপসংহার : একটি দেশকে আধুনিক কল্যাণকামী রাষ্ট্রে পরিণত করতে হলে শিক্ষার গুরুত্ব সর্বাধিক। উপযুক্ত শিক্ষায় জাতিকে শিক্ষিত করতে না পারলে, জাতীয় অগ্রগতি সম্ভব নয়। আর এ উপযুক্ত শিক্ষা লাভের আবস্থা আর কিছুতেই চলতে দেয়া ৭। যায় না। শিক্ষার সাথে সংশ্লিষ্ট সকল মহলকে তাই এ ব্যাপারে এগিয়ে আসতে হবে। এখনই নিতে হবে কার্যকরী ভূমিকা।
1 comment