মােবাইল ব্যাংকিং: মােবাইল ব্যাংকিং হচ্ছে শাখাবিহীন এমন একটি ব্যাংকিং ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে স্বল্প খরচে সহজে ও দুত আর্থিক সেবা ব্যাংকিং সুবিধাবঞ্চিত জনগােষ্ঠীর কাছে পৌছে যাবে।
২০০৯ সালে ৯টি বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংককে মােবাইল ফোননির্ভর ব্যাংকিং সেবা চালুর অনুমতি দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। গত বছর ব্র্যাক ব্যাংকও এ তালিকায় যুক্ত হয়। ইতােমধ্যে ব্যাংকগুলাে সীমিত আকারে মােবাইল ব্যাংকিং চালু করেছে। তবে ডাচু-বাংলা ব্যাংকই সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ মােবাইল ব্যাংকিং চালু করল। ৩১-এ মার্চ সেবাটির উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান। ইউটিলিটি বিল পরিশােধ এবং কেনাকাটা যদি মােবাইল ফোন থেকে করা যায়, তবে কিছুটা হলেও সময় বাঁচবে। আর যেসব প্রত্যন্ত এলাকায় ব্যাংকিং সেবা নেই, সেসব এলাকার মানুষও তখন মােবাইলের মাধ্যমে সহজেই ব্যাংকিং সেবার আওতায় আসতে পারবে।
মােবাইল ব্যাংকিংয়ের সুবিধাসমূহ: মােবাইল ব্যাংকিং মূলত শাখাবিহীন এবং মােবাইল ফোননির্ভর ব্যাংকিং ব্যবস্থা। এর মাধ্যমে নির্দিষ্ট স্থান থেকে নগদ টাকা যেমন ইলেকট্রনিক মাধ্যমে রূপান্তর করে নেওয়া যাবে, তেমনই ইলেকট্রনিক মাধ্যম থেকেও নগদ টাকা তােলা যাবে মােবাইল ব্যাংকিয়ের মাধ্যমে অর্থকে ইলেকট্রনিক অর্থে রূপান্তর এবং সর্বোপরি দারিদ্র্য দূরীকরণ সম্ভব। এটিই প্রকৃত অনলাইন সেবা। যেখানেই মােবাইল নেটওয়ার্ক থাকবে, সেখানেই এই সেবা পাওয়া যাবে। এটি সহজলভ্য, সুবিধাজনক ও নিরাপদ। এ সেবার আওতায় কেউ অ্যাকাউন্ট খুললে দেশের যেকোনাে স্থান থেকেই ব্যাংকিং সুবিধাগুলোে পাবে। এর মাধ্যমে ব্যাংকে টাকা জমাদান, উত্তোলন, কেনাকাটার বিল পরিশােধ, উইটিলিটি বিল পরিশােধ, বেতন-ভাতা উত্তোলন, রেমিট্যান্স বিতরণ, সরকারি অনুদান প্রাপ্তি, তহবিল স্থানান্তর এবং মােবাইলে তাৎক্ষণিক ব্যালেন্স রিচার্জ ইত্যাদি সেবা গ্রহণ করা সম্ভব।
যেভাবে শুরু করতে হবে: মােবাইল ফোনের মাধ্যমে ব্যাংকিং সেবা শুরু করতে হলে প্রথমে এ সেবার অধীনে নিবন্ধন করতে হবে। ডাচ-বাংলা ব্যাংকের অনুমােদিত বাংলালিংক এবং সিটিসেলের গ্রাহক সেবাকেন্দ্র থেকে নিবন্ধন ফরম পাওয়া যাবে। যেকোনাে অপারেটরের মােবাইল সংযােগ ব্যবহারকারীই এ ব্যাংকিং সেবার জন্যে নিবন্ধন করতে পারবে। মােবাইল ব্যাংকিং সেবা পরিচালনা করার জন্যে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বাংলালিংক এবং সিটিসেলের বেশ কিছু গ্রাহক সেবাকেন্দ্র অনুমােদন দিয়েছে। এসব অনুমােদিত স্থান থেকে গ্রাহকেরা নিবন্ধন ফরম সংগ্রহ ও জমা দিতে পারবেন। ফরমের সঙ্গে গ্রাহকের ছবি এবং জাতীয় পরিচয়পত্র বা ছবিযুক্ত অন্য কোনাে পরিচয়পত্র সরবরাহ করতে হবে। গ্রাহকের মােবাইল নম্বরের শেষে একটি চেক ডিজিট' যুক্ত করে ঐ গ্রাহকের অ্যাকাউন্ট নম্বর সরবরাহ করা হবে। উদাহরণস্বরূপ কোনাে গ্রাহকের মােবাইল নম্বর যদি ১২৩৪৫৬ হয় এবং তার একটি গােপন 'চেক ডিজিট' ৯ হয়, তবে ওই গ্রাহকর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট নম্বর হবে ১২৩৪৫৬৯। টাকা জমা ও তােলার সময় এ হিসাব নম্বরটি প্রয়ােজন হবে। হিসাব তৈরির পর গ্রাহকের মােবাইল ফোনে ডাচ-বাংলা ব্যাংকের সিস্টেম থেকে ইন্টার অ্যাকটিভ ভয়েস রেসপন্স বা আইভিআর কল যাবে। কল করে ব্যবহারকারীকে একটি চার ডিজিটের গােপন সংখ্যা প্রবেশ করতে বলা হবে। গ্রাহক যে ডিজিটগুলাে প্রবেশ করবে সেটিই হবে তার ব্যাংক হিসাবের গােপন পিন নম্বর। অটোমেটেড টেলার মেশিন বা এটিএম এবং এজেন্টের কাছ থেকে টাকা তােলার জন্যে এ পিন নম্বরটি প্রয়ােজন হয়। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খােলার সঙ্গে সঙ্গেই টাকা জমা দেওয়া যাবে। তবে হিসাব খােলার পুরাে প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন হতে এক থেকে দু দিন পর্যন্ত সময় লাগবে। পুরাে প্রক্রিয়া শেষ হলে গ্রাহকের মােবাইল ফোন নম্বরে একটি এসএমএস পাঠিয়ে বিস্তারিত জানিয়ে দেওয়া হবে।
দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ব্যাংকিং: দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর শাখা এখনও বিস্তৃত হয়নি। গ্রামের মানুষজন তাই আধুনিক ব্যাংকিং সুবিধা থেকে বঞিত হচ্ছে। মােবাইল ব্যাংকিং সেবার আওতায় ব্যাংকের শাখা ছাড়াও টাকা উত্তোলন ও জমা দেওয়া যাবে। এতে প্রত্যন্ত এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত হবে মােবাইল ব্যাংকিং সেবা। উন্নয়নশীল দেশগুলােতেই এ ব্যাংকিং সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। আমাদের দেশেও এটি জনপ্রিয়তা পাবে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আতিউর রহমান বলেন, কোনাে ধরনের ঝুঁকি ছাড়াই গােপন পিনকোড ব্যবহার করে মােবাইলে টাকা লেনদেন করা যাবে। এ ছাড়া গ্রাহকরা মােবাইল অ্যাকাউন্টে টাকা জমা দেওয়া বা উত্তোলন করতে পারবেন। মােবাইল ব্যাংকিং প্রচলিত শাখা ব্যাংকিংয়ের একটি বিকল্প ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে কম খরচে দ্রুততার সজ্গে আর্থিক সেবা পৌছে যাবে ব্যাংকিং সুবিধাবঞ্চিত মানুষের দোরগােড়ায়। এটি একটি প্রকৃত অনলাইন ব্যাংকিং সেবা। এর জনপ্রিয়তাও অন্যান্য সব সেবার চেয়ে অনেক দুত বাড়বে।
মােবাইলে বেতন-ভাতা বিতরণ: মােবাইল ব্যাংকিং পদ্ধতিতে বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ঝামেলাহীনভাবে তাদের বেতন তুলতে পারবে। একই সঙ্গে মুক্তিযােদ্ধা ভাতা, বিধবা ভাতা এবং বয়স্ক ভাতাসহ অন্যান্য ভাতাও সহজে এ ব্যাংকিং সেবার মাধ্যমে পরিশােধ করা সম্ভব হবে। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান অথবা সরকারি অফিস কর্মকর্তাদের মাসিক বেতন অথবা ভাতার পরিমাণ উল্লেখসহ মােবাইল ব্যাংক অ্যাকাউন্ট তালিকাসহ ব্যাংকে পাঠালে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ স্বয়ংক্রিয় পদ্ধতিতে ওই প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্টে বেতন বা ভাতার টাকা জমা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার মােবাইল ফোনে একটি এসএমএসের মাধ্যমে বিস্তারিত জানিয়ে দেবে। এরপর সুবিধাজনক সময়ে গ্রাহক কোনাে এজেন্ট অথবা এটিএম বুথ থেকে অর্থ উত্তোলন করতে পারবে। তবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, বিষয়টি যেহেতু কেবল চালু হলাে, তাই এখনই এর সুযােগ-সুবিধা সাধারণ মানুষ পাবে না। সাধারণ মানুষকে এ সুযােগের আওতায় আনার জন্যে প্রতিষ্ঠানগুলােকেই সবার আগে এগিয়ে আসতে হবে
মােবাইল ব্যাংকিং কতটুকু নিরাপদ: মােবাইল ব্যাংকিং সম্পূর্ণ নিরাপদ। কারণ এতে যােগাযােগের মাধ্যম হিসেবে USSD অথবা SMS+IVR প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয় । USSD প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নির্দেশনা পিন ও USSD-এর মাধ্যমে এবং SMS + IVR প্রযুক্তির ক্ষেত্রে নির্দেশনা SMS-এর মাধ্যমে, কিন্তু পিন IVR-এর মাধ্যমে প্রেরণ করা হয়। PIN লেনদেনের ক্ষেত্রে USSD এবং IVR উভয়ই নিরাপদ। যেহেতু মােবাইল সেট, PIN এবং check digit আয়ত্বে নেওয়া ছাড়া অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা উত্তোলন করা যাবে না, তাই গ্রাহকের টাকা সম্পূর্ণ নিরাপদ। তা ছাড়া check digit থাকায় যে কেউ মােবাইল অ্যাকাউন্টে অনাকাঙ্ক্ষিত টাকা জমা করতে পারবে না।
খরচাপাতি: যেকোনাে মডেলের মােবাইল ফোন ব্যবহারকারীই ব্যাংকিং সেবাটি পাবেন। ডাচ্-বাংলা ব্যাংকে হিসাব খােলার জন্যে মাত্র ১০ টাকা চার্জ দিতে হবে। একই সঙ্গে এজেন্টের কাছে টাকা জমা দিতে হলে ন্যূনতম পাঁচ টাকা ও মােট টাকার ১ শতাংশ এবং টাকা তুলতে হলে ন্যূনতম ১০ টাকা ও মােট টাকার ১ শতাংশ সার্ভিস চার্জ দিতে হবে। এর সঙ্গে অন্য কোনো চার্জ যুক্ত হবে না।
উপসংহার: সভ্যতার ক্রমবিকাশের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ তাদের মেধাকে কাজে লাগিয়ে আবিষ্কার করছে নতুন নতুন প্রযুক্তি। আর সেই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানুষ পৃথিবীকে করেছে গতিশীল। আমাদের সরকার ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশ রূপে গড়ার লক্ষ্যে ঘােষণা করেছেন। আর এই ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার পেছনে মােবাইল ব্যাংকিং অন্যতম ভূমিকা রাখতে পারবে এ আশা আমাদের সকলের। প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে মােবাইল ব্যাংকিংকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের দরিদ্র জনগােষ্ঠী তাদের জীবনযাত্রায় পরিবর্তন আনতে পারবে, দিতে পারবে জীবনযাত্রায় প্রযুক্তির ছোঁয়া— এ প্রত্যাশা বাংলাদেশের সব মানুষের
Post a Comment