নারী বৈষম্যের কারণ: পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার চক্রজালে নিরঙ্কুশ ক্ষমতার অধিকারী পুরুষ কর্তৃক আবহমানকাল থেকেই বঞ্চনার শিকার হতে হচ্ছে নারীকে। বঞ্চিত নারীর পক্ষে ন্যায্য অধিকার আদায়ের জন্য খুব বেশি সােচ্চার হয়ে উঠতে সবসময় সম্ভবপর হয়ে ওঠে না। নারীও যে মানুষ, এই বিষয়টি অনেকের চিন্তাতেই নেই। ফলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই নারীর যুক্তিসঙ্গত ইচ্ছা, স্বপ্ন ও মত প্রকাশের স্বীকৃতি পদদলিত হয়। সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি ও বিধিনিষেধ নারী পুরুষের গভীর ব্যবধান তৈরি করেছে, তৈরি করেছে বৈষম্য। নারীর প্রতি বৈষম্য বলতে নারী পুরুষ নির্বিশেষে যে কোনাে পার্থক্য, বঞ্চনা অথবা বিধিনিষেধকে বােঝায়। এর ফলে নারীকে পুরুষের তুলনায় ছােট করে দেখা হয়। সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, নাগরিক, পারিবারিক সব ক্ষেত্রে নারীর মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হয়। অথচ মানব সভ্যতার বিকাশ ও উন্নয়নে যুগে যুগে নারী যে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করে আসছে, তার যথাযথ স্বীকৃতি দিতেও নারাজ আমাদের পরুষতান্ত্রিক সমাজ।
দৃষ্টিভঙ্গির বৈষম্য: বাংলাদেশের নারীরা এগিয়ে গেছে অনেক ক্ষেত্রে। কিন্তু নারীরা সম্মানের প্রশ্নে, মর্যাদার প্রশ্নে, সমতার প্রশ্নে আজও অনেক পিছিয়ে। যার প্রতিফলন আমরা প্রতিনিয়তই দেখতে পাই পত্রিকার পাতায় সহিংসতার খবরের মাধ্যমে। বর্তমান সমাজে নারীদের কিছু ভাসা ভাসা অধিকার আইনগত ভাবে স্বীকৃত হলেও এ অধিকারগুলাের শক্ত কোন সামাজিক ভিত্তি নেই এবং তাদেরকে আজও অবলা, ললনা, রমনী, কামিনী, মহিলা ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের দুর্বলতা ও নিগ্রহ জ্ঞাপক বিভিন্ন ধরনের শব্দে ডাকা হয় ও সমাজে তাদের প্রতি আচরণ ও রকমই-শব্দ ব্যবহারের সাথে অনেকটাই মিলে যায়। কিন্তু পুরুষকে ঠিকই সম্বােধন করা হয় বিভিন্ন ধরনের শক্তিব্যঞ্জক শব্দে এবং বড় বড় পদবাচক শব্দগুলাে এখনাে পুরুষবাচক। ইংরেজি ভাষায় পুরুষ পদবাচক শব্দগুলাে পরিবর্তন করে নৈব্ব্যক্তিক শব্দ প্রবর্তিত হচ্ছে। যেমন চেয়ারম্যান এর বদলে চেয়ারপারসন, ফোরম্যান এর জায়গায় সুপারভাইজার ইত্যাদি। কিন্তু বাংলা ভাষায় এরকম কোন লক্ষণ এখনাে দেখা যাচ্ছেনা। বাংলা ভাষায় আজো মানুষ বলতে পুরুষকে বােঝানাে হয়, মেয়ে বােঝাতে হলে মানুষ শব্দটির পূর্বে মেয়ে শব্দটি জুড়ে দিতে হয়।
সামাজিক বৈষম্যে নারী: সমাজ পূর্বে নারীদেরকে শুধুমাত্র ঘরের কাজের দায়িত্ব দিত, বাহিরের কাজে হাত দিতে দিত না। এখন কিন্তু ধীরে ধীরে বাহিরের কাজে অংশগ্রহনের সুযােগ তারাও পাচ্ছে। কিন্তু পুরুষ সেই আদিকাল থেকেই বাহিরের কাজ নিয়েই ব্যস্ত হয়ে আছে, ঘরের কাজের সে আজ অব্দি করে না। আবার কোন পুরুষ যদি ঘরের কাজের দায়িত্ব নেয় বা নিতে চায়, তাহলে সমাজে তাকে ঘিরে নিন্দার ঝড় ওঠে। সে পরিণত হয় সমাজের সবচেয়ে ব্যক্তিত্বহীন চরিত্রে। যে দম্পত্তির স্বামী-স্ত্রী দুজনেই চাকরী, ব্যবসা বা বাহিরের অন্য কোন কাজের সাথে জড়িত; সেখানে সাধারনত দেখা যায়, শুধুমাত্র স্ত্রীকেই বাহিরের কাজ থেকে ক্লান্ত শরীরে ফিরে এসে ঘরের সকল কাজ সম্পন্ন করতে হয়। আবার যে দম্পতিকে স্বামী সারাদিন বেকার বসে থাকে সেখানেও ঐ স্ত্রীকেই ঘর- বাহির একাই সামলাতে হয়। তারপরেও ঐ বেকার স্বামীটিই গৃহস্বামীর মর্যাদা লাভ করে। এভাবেই সমাজ তৈরীকৃত অসম শ্রম-বণ্টন, নারী পুরুষের মধ্যে নিদারুণ বৈষম্য তৈরী করছে; ফলে সমাজের ভারসাম্য বিঘ্নিত হচ্ছে।
কম মজুরি প্রদান: ২০১৫ সালে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরাে পরিচালিত সমীক্ষায় দেখা গেছে, কৃষি কাজে দৈনিক মজুরি হিসেবে একজন পুরুষ শ্রমিক পান ২৯৯ টাকা আর একজন নারী পান ২২৬ টাকা। ওয়ার্ল্ড ভিশন বাংলাদেশ ও স্টেপস টুয়ার্ডস ডেভেলপমেন্টের যৌথ গবেষণাপত্র অনুযায়ী শতকরা ৫৬ ভাগ পুরুষ শ্রমিক যেখানে দিনে গড়ে ২০০ থেকে ৪০০ টাকা মজুরি পান, সেখানে শতকরা ৬১ ভাগ নারী পান ১০০ থেকে ২০০ টাকা। একই পরিস্থিতি ইটভাটায়, পােশাকশিল্প, নির্মাণকাজসহ বিভিন্ন ধরনের শ্রমিক পর্যায়ে।
কর্মক্ষেত্রে নারীদের প্রতি বৈষম্য: বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত নারীরাও, হচ্ছেন বেতনবৈষম্যের শিকার। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস)প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়, দেশের ৫৭ শতাংশ কর্মজীবী নারীর মাসিক বেতন একই পদে ও সমান মর্যাদায় কর্মরত একজন পুরুষ কর্মীর বেতনের ৫২ শতাংশ। বিআইডিএসের ক্যারিয়ার টু ফিমেল এমপ্লয়মেন্ট শীর্ষক অপর এক জরিপে উল্লেখ করা হয় ৩৩ শতাংশ নারী চাকরি ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় শুধু কম বেতনের কারণে। শ্রম আইনে নারী-পুরুষের সমান মজুরির কথা থাকলেও তা মানে না মালিকপক্ষ। শুধু তাই নয়, হয়রানি, নির্যাতনসহ কর্মক্ষেত্রে নারীদের বঞ্চিত করা হয় বিভিন্নভাবে। নারীদের উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে এমন মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বেতনবৈষম্যই নয়, পদোন্নতির ক্ষেত্রেও নারীরা বৈষম্যের শিকার। যােগ্যতায় এগিয়ে থাকা সত্ত্বেও শুধু নারী। হওয়ার কারণে অনেক ক্ষেত্রে নারীদের পদোন্নতি দেয়া হয় না। মাতৃত্বকালীন ছুটি ভােগ করার কারণেও অনেক নারী কর্মীকে পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হতে হচ্ছে।
নারীর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণে সিডও সনদ: নারীর অধিকার সম্পর্কে সচেতন করার মাধ্যমে নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ রােধ একই সাথে নারী অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বর্তমানে বিভিন্ন দেশে এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বেশ কিছু প্রচেষ্টা ও উদ্যেগ নেওয়া হয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম হচ্ছে সিডও সনদ। সিডও হল জাতিসংঘের নারীর প্রতি সকল প্রকার বৈষম্য বিলােপ’ সনদ। এই সনদকে নারীর অধিকার আদায়ের একটি কার্যকরি হাতিয়ার বলা হয়ে থাকে। নারীর জন্যে ইন্টারন্যাশনাল বিল অব রাইটস' হিসেবে স্বীকৃত এই দলিল সিডও, নারীর প্রতি সকল ধরনের বৈষম্য বিলােপ সনদ, যা নারী অধিকার সংরক্ষণের একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ মানদন্ড। রাষ্ট্র, অর্থনীতি, পরিবার ও সমাজ জীবনের সকল পর্যায়ে নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূর করার লক্ষ্যে ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭৯ সালে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে গৃহীত হয় নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য বিলােপ এই সনদ-সিডও। ১৯৮১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ২০টি রাষ্ট্রের অনুমােদন লাভের পর এই সনদটি কার্যকর বলে ঘােষিত হয়। এটি জাতিসংঘের ৬টি মৌলিক অধিকার সনদের মধ্যে অন্যতম। জাতিসংঘের পরিভাষায় একে উইমেনস কনভেনশন' বলা হয়। সিডও সনদের মূল লক্ষ্য হলাে, মানুসের মৌলিক অধিকার, মর্যাদা ও মূল্যবােধের ক্ষেত্রে নারী পুরুষের সমতার নিশ্চয়তা বিধানের আবশ্যকীয়তা তুলে ধরা এবং নারীর অধিকারকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া। এই সনদ অনুমােদনকারী রাষ্ট্রসমূহ এই প্রথম কোনাে সনদে জনজীবন ও মনক্তজীবনে নারীর প্রতি বৈষম্য নিরসনের ওপর সমান গুরুত্ব আরােপ করেছে।
বৈষম্য দূরীকরণে প্রয়ােজন দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন: নারীর প্রতি সব ধরনের বৈষম্য দূর করতে সর্বাগ্রে প্রয়ােজন আমাদের ব্যক্তিকেন্দ্রিক সামাজিক দৃষ্টিভজ্গির পরিবর্তন। গৃহস্থালি ও সেবা কাজের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির পাশাপাশি প্রয়ােজন নারীর কাজের বােঝা কমিয়ে আনা, যেখানে অত্যন্ত জরুরীভাবে প্রয়ােজন গৃহস্থালি ও সেবা কাজ ভাগ করে পরিবারের পুরুষ সদস্যদেরও করা। ফলে অনেক নারীর মানবাধিকার ও অধিকার সুরক্ষার পথ প্রশস্ত হবে। নারী তার ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় ও সিদ্ধান্তে বেছে নিতে পারবে সামাজিক বা অর্থনৈতিক কাজে তার অংশগ্রহণ।
নারীর ক্ষমতায়ন: নারীর প্রতি বৈষম্য দূরীকরণে নারীর ক্ষমতায়ন বাড়ানাের কোন বিকল্প নেই। সময় এসেছে নারীকে আরও এগিয়ে নেওয়ার। এ বিষয়টা মাথায় রেখেই আমাদের এগােতে হবে। কেউ যদি মনে করেন নারীকে অবহেলিত রেখেই সমাজের ও দেশের উন্নয়ন সম্ভব- সেটা কখনও চিন্তা করাও উচিত হবে না। কারণ পুরুষের সাফল্যের পেছনেও রয়েছে নারীর অবদান। তাই এই নারীসমাজকে এখন আর পেছনে থেকে সহায়ক শক্তি হিসাবে কাজে না লাগিয়ে তাদেরকেও সামনের দিকে নিয়ে এসে সরাসরি কাজে লাগাতে হবে। সম্মানের আসনে জায়গা করে নেওয়ার সুযােগ করে দিতে হবে। কোনাে নারী যাতে নির্যাতিত না হয় সেটা দেখতে হবে। নারীর সহযােগিতা ছাড়া কোনাে জাতি যােগ্য নাগরিক পায় না। তাই নারীর ক্ষমতায়ন মানেই জাতির ক্ষমতায়ন। পবিত্র কোরাআনে আল্লাহ বলেছেন : নারীদের রয়েছে বিধি মােতাবেক অধিকার। যেমন আছে তাদের ওপর (পুরুষদের) অধিকার। (সূরা আল-বাকারা-২২৮]
নারীর কাজের স্বীকৃতি প্রদান: শ্রম বাজারে ৩৩ থেকে ৩৬ শতাংশ নারীর উপস্থিতি ও অবদান স্বীকার করা হলেও বেশিরভাগই পরিবার ও সমাজে অসম্মান এবং অমর্যাদাকর জীবনযাপন করছে। সুতরাং কিছু কিছু ক্ষেত্রে নারীর অবদান স্বীকার করা হলেও নারীর সম্মান ও মর্যাদার প্রশ্নে দ্বিধান্বিত। ফলে বৈষম্য, অন্যায্যতা, অসম্মান ও অমর্যাদা অব্যাহত থাকছে। লিঙ্গভিত্তিক শ্রম বিভাজন ও ভূমিকা যেখানে নারী-পুরুষের মধ্যে মর্যাদার প্রশ্নে বিভক্তি সৃষ্টি করে রেখেছে এবং শ্রম বিভাজনই নারীর প্রতি বৈষম্যমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ও অমর্যাদারকর অবস্থানকে দৃঢ় করে রেখেছে। যেখান থেকে মুক্তি পেতে হলে প্রয়ােজন পরিবারের গৃহস্থালি, সেবা কাজের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি, আর্থিক-সামাজিক মূল্য এর গুরুত্ব তুলে ধরে দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে দেশব্যাপী ব্যাপক প্রচারাভিযান পরিচালনা। সবক্ষেত্রেই তারা এগােচ্ছেন কিন্তু সে তুলনায় সমাজে স্বীকৃতি মিলছে না।
উপসংহার: নারী পুরুষ মিলেই গঠিত হয় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র। তাই নারীকে অবজ্ঞা করে সমাজ বা রাষ্ট্রের উন্নতি হওয়া অসম্ভব। সমাজে তাদের যথাযথ অধিকার প্রতিষ্ঠিত করতে হলে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা পরিহার করা অত্যাবশ্যক। নারীর প্রতি সব বৈষম্যের অবসান, নারীর অবদান ও অর্জনের স্বীকৃতি এবং মূল্যায়ন সমগ্র মানব জাতির শক্তি- সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দেবে কয়েক গুণ। নারীর মর্যাদাপূর্ণ ভয়হীন জীবনযাপনই নিশ্চিত করতে পারে, সুরক্ষা দিতে পারে নারীর সব অধিকার ও মানবাধিকারকে। তাদের প্রতি বিভিন্ন বৈষম্যের কারণেই কর্মক্ষেত্রে তারা পিছিয়ে যাচ্ছে। সুস্থ কর্মপরিবেশই পারে নারীদের কর্মক্ষেত্রে এগিয়ে নিতে।
Post a Comment