SkyIsTheLimit
Bookmark

রচনা গ্রাম্যমেলা

ভূমিকা:
গ্রামবাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অন্যতম প্রধান অনুষঙ্গ হলাে 'মেলা'। মেলার আক্ষরিক অর্থ 'মিলন। গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষ সকল দীনতা, সংকীর্ণতাকে ভুলে মেলার প্রাঙ্গণে মিলিত হয়ে আপন হৃদয়কে আনন্দে ভরপুর করে তােলে। প্রাণের সাথে প্রাণের মিলনই ঘটে মেলায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, 'কোনাে উৎসব প্রাঙ্গণের মুক্ত অঙ্গনে সকল গ্রামবাসীর মনের উচ্ছসিত মিলনস্থল হলাে মেলা।
মেলার উৎপত্তি ও উপলক্ষ: প্রাচীনকাল থেকেই মানুষের জীবনে মেলার প্রচলন দেখা যায়। প্রাচীনকাল থেকেই নানান উপলক্ষকে কেন্দ্র করে গ্রামে মেলার আয়ােজন হতাে। উৎসবের আমেজ নিয়েই এসব মেলা বসত। মেলার উপলক্ষগুলাের একটা স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য হলো ধার্মিকতা ও লৌকিকতা। আবহমান কাল থেকেই এ দুই বৈশিষ্ট্যকে উপলক্ষ করে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে মেলা। তবে উপলক্ষ এক হলেও আবহাওয়া ও অলভেদে বিভিন্ন জনপদে মেলার বৈচিত্র্য দেখা যায়। বাংলার ইতিহাসে বছরের শেষে চৈত্র-সংক্রান্তির মেলার মধ্য দিয়ে পুরনাে বছরকে বিদায় দেওয়া হয়। বৈশাখী মেলার মধ্য দিয়ে উৎসবমুখরতায় স্বাগত জানানাে হয় নববর্ষকে। এভাবেই পৌষের বিদায় লগ্নে পৌষ-সংক্রান্তির মেলা, হেমন্তে বসে পিঠা-পার্বণের মেলা। এ ছাড়াও হিন্দু ও মুসলমানদের ধর্মীয় উৎসবকে কেন্দ্র করে বসে মেলা। নানা উপলক্ষকে সামনে রেখে মেলা বসলেও মেলার অন্তর্নিহিত কথা হলাে অবাধ মিলন ও পারস্পরিক ভাব বিনিময়। জীবনাচারের সংকীর্ণ সীমা থেকে মুক্তির লক্ষ্যে বিস্তৃত প্রাঙ্গণে এসে শত-সহস্র প্রাণের অবাধ মিলনের আকাঙ্ক্ষা থেকেই মেলার সৃষ্ট।
গ্রাম্যমেলার বৈশিষ্ট্য: পরিকল্পনা এবং সাজসজ্জার দিক থেকে গ্রামবাংলার সমস্ত মেলার বৈশিষ্ট্য প্রায় এক। প্রাচীনকাল থেকেই মেলা বসে নদীর তীরে, খােলা মাঠে কিংবা গ্রামের নির্দিষ্ট কোনাে স্থানে। মেলা উপলক্ষে অগণিত মানুষের পদচারণায় এসব স্থান হয়ে ওঠে কোলাহলমুখর। সাজ বৈশিষ্ট্যের দিক থেকে দেখা যায়, কোথাও মনিহারি দোকান, কোথাও মাটির তৈরি খেলনা ও পুতুলের দোকান, কোথাও নিত্যব্যবহার্য জিনিসের দোকান, কোথাও মিষ্টান্নের দোকান অবস্থান করে। এ ছাড়াও দেখা যায় গ্রামবাংলার সাধারণ মানুষের নিপুণ হাতের ছোঁয়ায় তৈরি কুটির শিল্পজাত দ্রব্যসামগ্রীর দোকান, নাগরদোলা, লটারির খেলা এবং সার্কাস। সবকিছুর মধ্যেই আবহমান বাংলার সৌন্দর্য খুঁজে পাওয়া যায়। নানা ধরনের পিঠে- পুলি, নাড়, বিন্নি ধানের খই, বাতাসা, শীতল পাটি, নকশী কাথা, তাল পাতার পাখার বিচিত্র সমাবেশে মেলা যেন সেজে ওঠে অপরূপ নান্দনিকতায়। এ ছাড়াও থাকে দেশীয় বিভিন্ন খেলার প্রতিযােগিতা।
গ্রামবাংলার মেলা: মেলা গ্রামবাংলার মানুষের সার্বজনীন উৎসব। যুগ যুগ ধরে মেলাকে কেন্দ্র করে বাংলার গ্রামীণ সংস্কৃতি আত্মপ্রকাশ করেছে। তাই বাঙালির সাংস্কৃতিক বিকাশে প্রাচীনকাল থেকেই মেলার গুরুত্ব অপরিসীম। মুঘল আমলেই নানা উপলক্ষকে কেন্দ্র করে প্রায়ই গ্রাম্যমেলা বসত। সাধারণত গ্রামের সাধারণ মানুষই মেলার প্রধান পৃষ্ঠপােষক। বাংলার গ্রাম্যমেলার অন্যতম আকর্ষণ যাত্রাপালা, কবিগান, নাগরদোলা ইত্যাদি। গ্রামবাংলার মেলাগুলাে আয়ােজিত হয় ঋতু উৎসব, লােকজ সংস্কৃতি, ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান, পালা-পার্বণ ইত্যাদি উপলক্ষকে কেন্দ্র করে। পৌষ- সংক্রান্তির মেলা, চৈত্র-সংক্রান্তির মেলা, বৈশাখী মেলা, কার্তিকের মেলা, আশুরার মেলা, রথের মেলা, রাস পূর্ণিমার মেলা, মাঘী পূর্ণিমা তিথি মেলা, চট্টগ্রামের শিব চতুর্দশী মেলা, জব্বারের বলিখেলার মেলা, কুমিল্লার জগন্নাথ মেলা, খুলনার খান জাহান আলী দরগার মেলা ইত্যাদি মেলা গ্রামবাংলার সংস্কৃতির স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তি নিয়ে আয়াজিত হয়। যদিও কালের আবহে ঐতিহ্যময় এসব মেলায় এখন শহুরে জীবনের আধুনিক ছোঁয়াও লেগেছে। একসময় যেসব মেলা ছিল শুধুমাত্র গ্রামীণ ঐতিহ্যের অংশ, আজ তা পরিণত হয়েছে আধুনিক বাংলাদেশের ঐতিহ্যে। 
গ্রাম্যমেলার তাৎপর্য: পল্লির নিরানন্দ জীবনকে আনন্দে ভরপুর করার জন্যেই মেলা বসে। আনন্দের, পাশাপাশি কিছু লােকের কর্মসংস্থানও হয় এ মেলা উপলক্ষে। কোনােরকমের সংকীর্ণতা নয়, বরং মুক্ত প্রাণের অবারিত কল্লোলেই মেলার বিস্তীর্ণ প্রাক্গণে মানুষ সমবেত হয়। নানা বয়সের মানুষের অবাধ মেলামেশায় বৃদ্ধি পায় মনের প্রসারতা। পারস্পরিক ভাব বিনিময় এবং আত্মিক লেন-দেনের মধ্যে দিয়ে ঘটে এক ও অখণ্ড সামাজিকতার বিকাশ। একদিকে পণ্য বিক্রয়, অন্যদিকে পারস্পরিক ভাব বিনিময়- মেলার এ দ্বৈত ভূমিকা গ্রাম্য জীবনে রচনা করে জীবনের পূর্ণরূপ। তাই গ্রামের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে মেলার গুরুত্ব অনস্বীকার্য। মেলার তাৎপর্যকে দু ভাগে চিহ্নিত করা যায়: প্রথমত, অর্থনৈতিক; দ্বিতীয়ত মনস্তাত্ত্বিক। পণ্য বিক্রয়ের মাধ্যমে একদিকে গ্রামীণ মানুষের জীবনে আসে আর্থিক সচ্ছলতা। অন্যদিকে প্রয়ােজনের নিগড়ে আবদ্ধ কঠোর পরিশ্রমী এসব মানুষের জীবনে আসে আনন্দের ছোঁয়া । অগণিত মানুষের সাথে ভাব-বিনিময়ের মাধ্যমে তারা অহিংস সম্প্রীতির বন্ধনে আবদ্ধ হয়। তা ছাড়া গ্রামবাংলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে থাকা লােকসংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানকে মেলার প্রাঙ্গণেই পাওয়া যায়। আধুনিক যন্ত্রসভ্যতার আঘাতে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যের পুনরুদ্ধারও মেলার মাধ্যমেই সম্ভব। তাই গ্রামবাংলার জীবনে তথা বাংলাদেশের সংস্কৃতিতে গ্রাম্যমেলার গুরুত্ব অপরিসীম। 
উপসংহার: জীবনধারণের প্রয়ােজন মানুষ একসময় আপন অন্তরেই হয়ে ওঠে ক্লান্ত, বিমর্ষ। সে প্রয়ােজন বােধ করে একঘেয়ে জীবনের বেষ্টনী ভেদ করে বিপুল মানুষের সান্নিধ্য পাওয়ার এবং আনন্দে পরিপূর্ণ হওয়ার। মানুষের এ চাহিদা পূরণ করে মেলা। আবহমানকাল ধরে গ্রামবাংলার মেলা গ্রামীণ মানুষের জীবনে আনন্দের বাণী নিয়ে উপস্থিত। এ মেলা আমাদের চিরায়ত ঐতিহ্য। বাঙালি সংস্কৃতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ এসব গ্রাম্যমেলা। মানুষের সাথে মানুষের, শিল্পের সাথে শিল্পীর এক অপূর্ব মিলনক্ষেত্র এ মেলা।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment