SkyIsTheLimit
Bookmark

ভেজাল রচনা

ভেজাল ও নির্ভেজাল
বা বাংলাদেশে ভেজালের প্রকৃতি
বা ভেজাল ও তার প্রতিকার

ভূমিকা :
মানুষকে আল্লাহ সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে দুনিয়াতে প্রেরণ করেছেন। কাজেই সৃষ্টির সেরা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করে সে তার শ্রেষ্ঠত্ব দাবি করতে পারে। শুধু নিজের কল্যাণ সাধন নয় বরং অপরের কল্যাণে মনােনিবেশ করাই হচ্ছে মানবতার আদর্শ এবং মনুষ্যত্বের দাবি। কেবল নিজের সুখের জন্য অন্যের অধিকার খর্ব করা, হীন স্বার্থপরতা ও আত্মকেন্দ্রিকতায় মানবতা অপমানিত ও কলংকিত হয়। যে কোন পণ্য দ্রব্যে ভেজাল দেওয়াও এ ধরনেরই একটা কলংকিত বিষয়। কাজেই ভেজাল একটা ঘৃণিত সামাজিক অপরাধ।

ভেজাল কি : উৎকৃষ্ট পণ্যের সাথে অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের পণ্যদ্রব্য মিশিয়ে দেওয়াকে ভেজাল বলে। গ্রাহকের সাথে প্রতারণা করা, ভাল দ্রব্যের সাথে খারাপ দ্রব্য মিশিয়ে ক্রেতাকে ঠকানাে।

ভেজাল একটা অপরাধ : ভেজাল একটা গর্হিত সামাজিক অপরাধ। ভেজালের ফলে খাদ্যদ্রব্য দৃষিত হতে পারে। ভেজাল খাদ্যদ্রব্য আহার করে অনেক সময় জীবন বিপন্ন হয়। যে কর্মকাণ্ড সমাজের অধিকাংশ মানুষের জন্যে ক্ষতিকর জনগণ যেটাকে ক্ষতিকর হিসেবে মনে করে, জনগণ যার দ্বারা প্রতিনিয়ত প্রতারিত হচ্ছে এবং যে কর্মপ্রক্রিয়া মানুষের জন্য ক্ষতিকর সেটাই সামাজিক অপরাধ।

পণ্যদ্রব্য ও ভেজাল : বাংলাদেশের পণ্যের সাথে ভেজালের একটা নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। কারণ, আমরা বিবেক বােধের স্বাভাবিক স্তর থেকে অনেক নীচে নেমে এসেছি। তাই ভেজাল ছাড়া বাংলাদেশের মানুষ যেন আর কিছুই বােঝে না। ভেজাল ছাড়া পণ্যদ্রব্য পাওয়াই আজ মুশকিল হয়ে পড়েছে। দি ইন্সস্টিটিউট অব পাবলিক হেলথ -এর খাদ্যদ্রব্য পরীক্ষাগারের এক তথ্য থেকে জানা যায় যে, ১৯৮৩ সাল থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের ২৬,৮৪৩টি খাদ্যদ্রব্যের নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে ৪৩% ই ভেজাল, অর্থাৎ, ১১,৩৯৭টি দ্রব্যই ভেজালপূর্ণ। এসব ভেজালের কারণে বিভিন্ন অর্থকরী পণ্য আন্তর্জাতিক বাজারে দারুণভাবে মার খাচ্ছে এবং দেশের সুনাম নষ্ট হচ্ছে চরমভাবে।

ব্যবসায়ে ভেজালের অনুপ্রবেশ : ব্যবসা একটা পবিত্র পেশা। একসময় এ পবিত্রতা রক্ষা হত পুরােপুরিভাবে। ব্যবসার ক্ষেত্রে সুন্দর নীতি ও আদর্শ ছিল। ব্যবসায় ভেজাল দেয়ার কথা মানুষ কল্পনাই করতে পারত না। ভেজালকে তারা পাপ বলে মনে করত। কিন্তু এ অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে ইংরেজ আমল থেকেই। ইংরেজরা এদেশে আসার পর থেকে সামাজিক জীবনে নানাভাবে মূল্যবােধের অবক্ষয় শুরু হয়। তাদের শােষণনীতির ফলে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে মানুষ দিশেহারা হয়ে নীতি আদর্শ থেকে দূরে সরে পড়ে। ইংরেজরা এদেশে আগমনের পর থেকে মানুষের ধর্মবােধেও ক্রমশ আঘাত আসতে থাকে। ফলে এ দেশের কিছুসংখ্যক লােক তাদের নীতি ও আদর্শ থেকে আরও একধাপ নীচে নেমে আসে। আর এ সুযােগে স্বার্থান্বেষী মহল এবং অসাধু ব্যবসায়ীরা ইংরেজদের সহায়তায় সমাজকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করে। অস্বাভাবিকভাবে সুদখাের, মহাজন ও চোরাকারবারীদের দৌরাত্ম বৃদ্ধি পায়। জীবনধারণের তাগিদে সাধারণ মানুষ জড়িয়ে পড়ে দুর্নীতির সাথে এবং এ দুর্নীতির ধারাবাহিকতায় পণ্যদ্রব্য বা ব্যবসায় ভেজালের অনুপ্রবেশ ঘটে।

ভেজালের প্রভাব : আগেই বলা হয়েছে, ভেজাল একটা সামাজিক অপরাধ। এর প্রভাবে সমাজ জীবন দারুণভাবে অবক্ষয়ের মুখােমুখি হয় এবং মানুষকে চরিত্রভ্রষ্ট করে। টাকার লােভে মানুষ ভুলে যায় মানবতার কথা। তার কাছে সব কিছুই তুচ্ছ মনে হয়, ফলে মানুষ নিষ্ঠুর হয়ে উঠে। জীবনের জন্যে অত্যন্ত জরুরী জিনিসের মধ্যেও তারা ভেজাল দিতে থাকে। খাদ্য ও ঔষুধ জীবনধারণের জন্যে অত্যন্ত প্রয়ােজনীয় উপাদান। অথচ বিবেকবােধহীন মানুষ এসব জীবনরক্ষাকারী জিনিসেও ভেজাল দিতে কুণ্ঠাবােধ করে না। ভেজাল খাদ্যদ্রব্য খেয়ে মানুষ পুষ্টিহীনতায় ভােগে। ভেজাল খাদ্য ও ভেজাল ঔষুধের কারণে মানুষের মৃত্যু পর্যন্ত হয়।

ভেজালের দৃষ্টান্ত : বাংলাদেশসহ ভারতীয় উপমহাদেশেই ভেজালের প্রবণতা বেশি। আমাদের দেশে সিমেন্টের সাথে ঐঁটেল মাটি খুঁড়াে করে মিশানাে হয়ে থাকে। দুধে মেশানাে হয় পানি। সর্ষের তেলে শেয়ালকাটার বীজের রস, সয়াবিন তেলের সাথে পামওয়েল, নারকেল তেলের সাথে সয়াবিন তেল, ময়দার সাথে আটা, খেজুরের গুড়ের সাথে তালের গুড়, চালের সাথে মিহি কাকরদানা ইত্যাদি। এমনিভাবে পণ্যদ্রব্যে নানা ভাবে ভেজাল মেশানাে হয়। আজকাল ইলেকট্রনিক্স যন্ত্রেও ভেজাল পার্টস থাকে। ভেজাল শুধু দেশের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, রফতানি বাণিজ্যের ক্ষেত্রেও এমন দূষ্টান্ত লক্ষ্য করা যায়।

ভেজালের প্রতিকার : ভেজাল প্রবণতা এমন এক মারাত্মক ব্যাধি যা ক্রমে ক্রমে সমাজজীবনকে পজ্গু করে দেয়। তাই ভেজালের প্রতিকারের জন্য সুপরিকল্পিতভাবে এর বিরুদ্ধে পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। সমাজজীবন থেকে অপরাধমূলক ভেজাল প্রবণতা দূর করতে হলে প্রাথমিকভাবে যে সমস্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করা দরকার সেগুলাে হল, (১) সমাজবদ্ধ মানুষের মধ্যে আদর্শবাদিতা, ন্যায়নীতিবােধ এবং মানবতাবােধ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। (২) অপরাধ প্রবণতা বন্ধ করার জন্য সরকারিভাবে কঠোর আইন প্রয়ােগের ব্যবস্থা করতে হবে। (৩) আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থাকে আদর্শ চরিত্র গঠনের শ্রেষ্ঠ উপায় হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। (৪) ধর্মীয় চেতনা সমৃদ্ধ শিক্ষার বিস্তার ঘটিয়ে মানুষের হীনমন্যতার পরিবর্তন সাধন করতে হবে। (৫) রাষ্ট্রের অর্থ ও খাদ্যব্যবস্থাকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হবে। (৬) বাজার ব্যবস্থায় যাতে মজুতদারদের একচেটিয়া প্রাধান্য না থাকে, সে বিষয়ে দেশের সরকারকে সদা সতর্ক থাকতে হবে। (৭) আদর্শ বাজার কমিটির মাধ্যমে সুষ্ঠুভাবে বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। উপরােক্ত ব্যবস্থাবলি গ্রহণ করে যদি তা সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা যায় তবে সমাজ থেকে ভেজাল নামক অপরাধ প্রবণতা হ্রাস পেতে পারে।

উপসংহার : ভেজাল প্রবণতা বৃদ্ধির সাথে সাথে মানুষের মনুষ্যত্ব ও মানবতাবােধ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে তারা নিত্যদিনের কাজকর্মে অপরাধ করে বেড়ায়। এটা জাতির জন্য অত্যন্ত লজ্জাজনক ব্যাপার। তাই ভেজালমুক্ত সমাজ গঠন করে চরম অবক্ষয়ের কবল থেকে জাতিকে রক্ষা করতে হবে।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment