SkyIsTheLimit
Bookmark

রচনা বই পড়ার আনন্দ

ভূমিকা:
বই মানুষের চিরন্তন বিশ্বস্ত সঙ্গী। জন্মগতভাবেই মানুষ অন্যের সাহচর্য প্রত্যাশা করে। মানুষের পাশপাশি একসময় এ সাহচর্যের অংশদার হয়েছে বই। মানবজীবন প্রবাহের যাবতীয় ভাব-অনুভূতি জানার প্রবল আগ্রহ মানষকে বইমুখী করেছে। কেননা বই মানুষের সুখ-দুঃখ, আনন্দ বেদনা, হাসি-কান্নার অনুভূতি বুকে ধারণ করে আছে অনাগতকালের জন্যে। অতীত-বর্তমান আর ভবিষ্যতের যােগসূত্র রচনা করে বই। তাই বই পড়ে মানব-মন লাভ করে অনাবিল শান্তি ।
বইয়ের বিকাশ: বই মূলত জ্ঞানীর জ্ঞানসাধনার ফসল। লেখক তার অভিজ্ঞতালব্ধ ভাব-অনুভূতি ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানানাের জন্যে বই লেখেন। তারপর ছাপাখানার আবিষ্কার বইয়ের প্রচারকে বিস্তৃত করেছে। ফলে ঘরে বসেই মানুষ যাবতীয় বিষয়ে জ্ঞান লাভ করা শুরু করল। শুধুমাত্র অতীতের ঘটনাবলি নয়, বর্তমানের বিশ্বব্যাপী জ্ঞান আহরণের দ্বার হলাে উন্মুক্ত। এ যেন ক্ষুদ্র আসনে বসে বিশ্বমানবের সাহচর্য লাভ করা। জ্ঞানের মহাসমুদ্রের কল্লোল শােনা যায় বইয়ের পাতায়। যে মহাসমুদ্র যুগ থেকে যুগান্তরে জ্ঞান বিতরণের মহান ব্রত নিয়ে সদাই প্রবহমান।
বই পড়ার প্রয়ােজনীয়তা: বই বিপুল জ্ঞানের ভাণ্ডার, প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের সাধনার ফল লিপিবদ্ধ আছে বইয়ে। নানান কালের মানুষ তাদের বিচিত্র অভিজ্ঞতা ও জ্ঞানােপলব্দি অনাগত কালের মানুষের আনন্দ জোগানাের জন্যে লিপিবদ্ধ করে যায় বইয়ে। ফলে বর্তমানের মানুষ নিজের জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা কাটিয়ে ওঠার জন্যে বইয়ের দ্বারস্ত হয়। স্বল্পায়ু জীবনে মানুষের পক্ষে বিস্তৃত পৃথিবীর বহুবিধ জ্ঞানলাভ করা সম্ভব হয় না। এক্ষেত্রে বই- ই পারে তার জ্ঞানভাণ্ডারকে পরিপূর্ণ করতে। বিশ্বের মহামূল্য গ্রন্থগুলাে মানুষের জ্ঞান-বিজ্ঞান, শিল্প-সাহিত্য সাধনার প্রমাণ স্বরূপ এগুলাের মধ্য দিয়েই মানুষ লাভ করেছে তার আপন সত্তার পরিচয়। বই হলাে মানুষের সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন, তাই যুগে যুগে বই মানুষের জ্ঞানের ভাণ্ডার পরিপূর্ণ করেছে।
বই মানুষের বিশ্বস্ত সঙ্গী: মানুষের নিঃসঙ্গতা ঘুচানাের অনুপম সঙ্গী বই। মানবজীবন নানান ঘাত-প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হয়। দুর্বিষহ জীবনে বই পারে সকল ক্লান্তি মুছে দিয়ে প্রশান্তির পরশ বুলিয়ে দিতে। মানুষের অকৃত্রিম বন্ধু হিসেবে কাজ করে বই। বাইরের যান্ত্রিকতায় আমরা যখন মনের গহীনে নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ি তখন গ্রন্থপাঠেই পাওয়া যায় পরম বন্ধুর সাক্ষাৎ। বইয়ের সঙ্গের উপযােগিতা সম্বন্ধে চার্লস ল্যাম্ব বলেছেন, বই পড়তে যে ভালােবাসে তার শত্রু কম'। বই মানুষের আত্মাকে শুদ্ধ করে। আর আত্মার শুদ্ধতা মানুষকে দান করে পরিপূর্ণতা। গ্রন্থপাঠেই খুঁজে পাওয়া যায় সামনে চলার আলাের পথ। তাই বইয়ের চেয়ে বিশ্বস্ত বন্ধু অকল্পনীয়। 
বই পড়া এবং আনন্দলাভ: উৎকৃষ্ট বই মানব হৃদয়ের অনাবিল আনন্দের অযফুরন্ত উৎস। কর্মব্যস্ত মানুষ হাজার ব্যস্ততার মাঝে একটু সময় করে নিয়ে বইয়ের মাধ্যমে পেতে চায় অনাবিল আনন্দ। জাগতিক জীবনের নানাবিধ সংঘাত এবং সমস্যার উর্ধ্ব বই মানুষকে আনন্দ দান করে। জীবনসংগ্রামের মানুষ নিজের ভেতর সৃষ্টি করে একান্ত নিজস্ব একটি ভুবন। সে ভুবনে সবচেয়ে বেশি সাহচর্য দান করে গ্রন্থপাঠ, মানুষকে দেয় নতুন প্রেরণা, উৎসাহ ও মানসিক প্রশান্তি। সত্য, সুন্দর এবং জ্ঞানের আলােয় গ্রন্থপাঠ মনের বিকাশ ঘটায়। সকল অকল্যাণ, অসত্য, সংকীর্ণতা থেকে মানবমনকে মুক্তি দেয় বই। হেনরি ভনডিকের মতে, হৃদয়ের স্পর্শ যেখানে আছে, সেটাই গ্রন্থ। আমরা এক যুগে বসে আরেক যুগের প্রাজ্ঞ ব্যক্তিদের-হৃদয়ানুভূতির সাথে মিলিত হওয়ার সৌভাগ্য অর্জন করি গ্রন্থপাঠে। এভাবেই দুঃখ-বেদনার মুহূর্তে, মানসিক অশান্তিতে, হতােশাগ্রস্ত মনে বই নানানভাবে আনন্দের সঞ্চার করে। 
সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশে বই: বই সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশে রাখে অসাধারণ ভূমিকা। গ্রন্থের সাহচর্যেই মানুষ অগ্রসর হয়ে চলে সভ্যতা ও সংস্কৃতির ক্রম-অগ্রযাত্রার পথে। অতীত-বর্তমান ও ভবিষ্যতের জ্ঞান-বিজ্ঞানের মধ্যে সেতুবন্ধন রচিত হয়েছে উৎকৃষ্ট বইগুলোর মাধ্যমে। প্রাচীনকাল থেকে আজ পর্যন্ত সভ্যতা-সংস্কৃতি যে ধারায় বিকশিত হয়েছে তা লিপিবদ্ধ হয়েছে গ্রন্থে। যা পাঠ করে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্ম পুরাতন ও নতুনের তুলনা করে পাবে সৃজনের অনুপ্রেরণা। এ সৃজনশীল অনুপ্রেরণাই সভ্যতা বিকাশের মূল নিয়ামক। যুগে যুগে যেসকল মনীষী সভ্যতা ও সংস্কৃতির বিকাশে অবদান রেখেছেন তাদের সাথে আমরা পরিচিত হতে পারি গ্রন্থপাঠের মাধ্যমে। হােমার, দান্তে, ভার্জিল, মাদাম কুরি, জগদীশচন্দ্র বসু, প্লেটো, এরিস্টটল কিংবা মার্কসকে তাঁদের লেখা বইয়ের মাধ্যমেই আমরা তাঁদের কর্মপ্রেরণায় উদ্দীপ্ত হয়ে সভ্যতা সংস্কৃতিকে সমৃদ্ধ করার মানসিক জোর পাব। 
ব্যক্তিত্ব বিকাশে বই: বই মানুষকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের নানা শাখার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। ফলে মনের অজানা হয় উন্মোচিত ও প্রসারিত। কবি শেলীর মতে, 'যতই আমরা অধ্যয়ন করি, ততই আমাদের অজ্ঞতাকে আবিষ্কার করি।' যতই মানুষ তার নিজের অজ্ঞতাকে চিহ্নিত করতে পারে ততই তার মন মহৎ সাধনায় ব্যাপ্ত হতে শেখে। উৎকৃষ্ট বই কুসংস্কারাচ্ছন্ন মনকে শুদ্ধ করে, মানুষ খুঁজে পায় যথার্থ মানুষ হয়ে ওঠার পথের সন্ধান। বই হলাে মানুষের সম্পূর্ণ ব্যক্তিত্বের প্রতিফলন। তাই গ্রন্থ পাঠে আমরা বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তিত্বের সাথে পরিচিত হয়ে নিজ ব্যক্তিত্বের বিকাশের পথ খুঁজে পাই। আত্মার পরিশুদ্ধি ঘটিয়ে পরিপূর্ণতা অর্জনের অনুপ্রেরণা জোগায় বই। বিদ্যাসাগর, রাজা রামমােহন রায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দস্তয়ভস্কি, মাক্সিম গাের্কি প্রমুখ মনীষীর মহৎ চিন্তা-চেতনা, মহৎ কর্মকাণ্ডের সাথে আমরা পরিচিত হতে পারি গ্রন্থপাঠে। গ্রন্থপাঠে জ্ঞান বাড়ে এবং মুক্ত চিন্তার সাহায্যে মূল্যবােধ বৃদ্ধি পায়। 
বই নির্বাচনে সতর্কতা: যুগ যুগ ধরে মানুষ জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে যে বিচিত্র অভিজ্ঞতা লাভ করেছে তার সবই বিধৃত হয়েছে বইয়ের পাতায়। ফলে মানুষ প্রয়ােজনীয় দিকনির্দেশনা পেতে পারে বইয়ের সাহায্যে। উৎকৃষ্ট বই মানুষের আত্মার পরিশােধন করে তাকে আনন্দ ও প্রকৃত সুখ দান করে। অন্যদিকে সাহিত্যিক মানসিকতা নিয়ে নয় বরং ব্যবসায়ী মানসিকতা নিয়ে কিছু বই ছাপা হয়, যা মানুষকে ধ্বংসের পথে টেনে নিয়ে যায়। এসব বই মনকে পরিশুদ্ধ না করে বিষাক্ত করে। যা ব্যক্তিগত ও সমষ্টিগত জীবন উভয় ক্ষেত্রেই ক্ষতিকর। তাই গ্রন্থপাঠের ক্ষেত্রে গ্রন্থ নির্বাচনে দিতে হবে সতর্ক দৃষ্টি। মনের বিকাশে যে বই সহায়ক তাকেই পাঠের জন্যে নির্বাচিত করতে হবে। 
উপসংহার: বিখ্যাত ঔপন্যাসিক তলস্তয় বলেছেন, জীবনে তিনটি বস্তুই বিশেষভাবে প্রয়ােজন, তা হচ্ছে ' বই, বই এবং বই '। বই মানুষের আনন্দের সঙ্গী। মানুষের মনকে জাগিয়ে তােলে বই। গ্রন্থপাঠে আনন্দলাভ এবং আনন্দোপলব্ধির জন্যে মানুষকে হতে হবে অধ্যবসায়ী। ভালােবাসতে হবে বইকে। অন্যথায় গ্রন্থের জগৎ থেকে আনন্দ আহরণে সে ব্যর্থ হবে।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment