বা বাংলাদেশে আর্সেনিক দূষণের ভয়াবহতা
বা আর্সেনিক দূষণ ও বাংলাদেশ
বা আর্সেনিক
বাপানিতে আর্সেনিক
ভূমিকা : সারাদেশে আজ আর্সেনিক জ্বরে আক্রান্ত। সুপেয় এক গ্লাস পানি পাওয়া দুষ্কর। জানতাম, নলকূপের পানি নিরাপদ। কিন্তু আজ ভাল নলকূপের পানি আর্সেনিকযুক্ত। পুকুরের পানিই নিরাপদ। রেডিও টেলিভিশন তাই বলে। বাংলাদেশের উত্তর- পশ্চিমাঞ্চলীয় ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় প্রায় ৩২টি জেলার মাটির নিচের পানিতে বেশি মাত্রায় বিষাক্ত আর্সেনিক পাওয়া গেছে। কিছুদিন আগেও দেশে আর্সেনিক দূষণ সম্পর্কে তেমন কিছু শােনা যায়নি। সবার চোখে এখন একই জিজ্ঞাসা-এ আর্সেনিক কি, কোথা থেকে আসছে, লক্ষণই বা কি, আর এর প্রতিকারই বা কি?
আর্সেনিক কি : আর্সেনিক একটা বিষাক্ত মৌলিক পদার্থ। এর প্রতীক As. পারমাণবিক সংখ্যা ৩৩ এবং পারমাণবিক ভর ৭৪.৯২। বিজ্ঞানীদের দ্বারা এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত বস্তুর সংখ্যা প্রায় সােয়া এক কোটি। তন্মধ্যে মৌলিক পদার্থের সংখ্যা ১০৯টি। আর্সেনিক একটি ত্রিযােজী মৌলিক পদার্থ। ভূগর্ভস্থ পাথরের স্তরে পাইরাইটস্ (FeS2) নামে একটি যৌগ আর্সেনিককে ধরে রাখে। ভূগর্ভ থেকে অতিরিক্ত পানি উত্তোলনের ফলে পানির স্তরে ভারসাম্য নষ্ট হচ্ছে। ফলে আর্সেনিকের ক্ষতিকারক দিকটি একটা নতুন সমস্যার জন্ম দিয়েছে। কারণ, পাইরাইটস জারিত হওয়ার সময় যে এসিড তৈরি হচ্ছে তা খনিজ পদার্থের সাথে বিক্রিয়া করে আর্সেনিককে মুক্ত করছে। তাই মাটির নিচে ভূ-রাসায়নিক বিক্রিয়ায় আর্সেনিক বেরিয়ে এসে পানিতে দ্রবীভূত হচ্ছে এবং আর্সেনিক যুক্ত হচ্ছে নিয়ে আসছে মৃত্যুর পরােয়ানা।
আর্সেনিকের প্রকাশ : আর্সেনিক দূষণের সংবাদ তৈরি হয় প্রথমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যে ১৯৭৮ সালে। উত্তর ও দক্ষিণ পরগণার কোন কোন এলাকায় মানবদেহে আর্সেনিকের প্রকাশ ঘটে। WHO-এর মতে আর্সেনিকের সহনশীল মাত্রা হচ্ছে। ০.০৫ পি, পি, এম, অর্থাৎ প্রতি দশ কোটি ভাগের পাঁচ ভাগ মাত্র। '৮৩-এর দিকে এর প্রভাব বেড়ে যায়। তখন ভারতের একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র ভূ-গর্ভস্থ পানি পরীক্ষা করে দেখতে পায় সহনশীল মাত্রার চাইতে অনেক বেশি আর্সেনিক রয়েছে। এরপর ১৯৮৮ সালে আবার আর্সেনিক দূষণ নিয়ে ভারতে গবেষণা শুরু হয়।
বাংলাদেশের তৎপরতা ও গবেষণা : বাংলাদেশ সরকার ১৯৯০ সালে পশ্চিমবঙ্গ থেকে আর্সেনিক দূষণ সম্পর্কে জানতে পারে। ১৯৯৬ সালের নবেম্বর মাসে ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতালের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশের কয়েকটি জেলার নমুনা পরীক্ষার জন্য কলকাতা যান। বিস্তারিত পরীক্ষার জন্য ১৯ ডিসেম্বর ৯৬ থেকে ৭ জানুয়ারি ৯৭ পর্যন্ত SOES (School of Environment University of Jadabpur India) এবং ঢাকা কমিউনিটি হাসপাতাল বাংলাদেশে ১৫টি জেলায় একটি যৌথ জরিপ করে। এর আগে ৯৬ সালেই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূ-তত্ত্ব ও খনিজবিদ্যা বিভাগ থেকে পশ্চিমবঙ্গের আর্সেনিক কবলিত এলাকার নিকটস্থ বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী জেলাগুলাে থেকে ৬০০টি পানির নমুনা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠায়। পরে SOES S NIPSOM (বাংলাদেশ) যৌথভাবে বাংলাদেশের ১৭টি জেলার উপর পরীক্ষা চালিয়ে আর্সেনিক দূষণ দেখতে পায়।
আর্সেনিকের লক্ষণ : মানবদেহে আর্সেনিক বিষক্রিয়ার লক্ষণ ধরা পড়ে অনেক পরে পানিতে আর্সেনিকের মাত্রা এবং প্রত্যহ কি পরিমাণ পানি পান করা হচ্ছে তার উপর। প্রথমত দেহে কিংবা হাতের তালুতে বাদামী ছােপ (ডিফিউজড মেলানােসিস) দেখা দেয়। তবে সব রােগীর ক্ষেত্রে এ লক্ষণ দেখা নাও যেতে পারে। স্পটেড পিগমেনটেশন সাধারণত বুকে, পিঠে বা হাতে দেখা যায়। বেশির ভাগ রােগীর এ লক্ষণগুলাে ধরা পড়ে। কোন কোন রােগীর হাত পায়ের পেটের চামড়া পুরু হয়, আঙুল বেঁকে যায় এবং অসাড় হয়ে পড়ে। অনেক সময় পায়ের আঙুলের মাথায় পচন ধরে। আর্সেনিকের কারণে রােগীর জিহ্বা, মাড়ি, ঠোটে লালাভাব বেশি থাকে। তাছাড়া ক্ষুধামন্দা, হাত-পা ফোলা এমনকি লিভার আক্রান্ত হয়ে লিভার ক্যান্সারও হতে পারে।
প্রতিকার ও পদক্ষেপ : আর্সেনিক বিষক্রিয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সঠিক চিকিৎসা পদ্ধতি অদ্যাবধি জানা নেই। তবে প্রতিরােধক হিসেবে কিছু কিছু পদক্ষেপের পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।
প্রথমত, বিশেষজ্ঞরা এ সমস্যা সমাধানে ভূ-গর্ভস্থ পানির ব্যবহার হ্রাস করার পরামর্শ দিচ্ছেন। পদক্ষেপ হিসেবে ১৯৯৪ সালে সরকার আর্সেনিক আক্রান্ত রােগীদেরকে পেনিসিলিয়াম ব্যবহার করে সমস্যা সমাধানের জন্য একটি জাতীয় কমিটি গঠন করে। কমিটি ১০০০ নতুন নলকূপ স্থাপন করে এবং ৬০০টি দূষিত নলকূপ বাতিল ঘােষণা করে। বর্তমানে দেশে দুটি যন্ত আর্সেনিক দূষণ পরীক্ষা করে এবং মেহেরপুর পৌর এলাকায় আর্সেনিক দূষণ প্লান্টের কাজ হাতে নেওয়া হয়েছে।
দ্বিতীয়ত, বৃষ্টির পানি এবং পুকুর ও নদীনালার পানি ব্যবহারের জন্য পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। কারণ, বৃষ্টির পানি সম্পূর্ণ আর্সেনিকমুক্ত এবং পুকুর ও নদীনালার পানিতে আর্সেনিক নেই বললেই চলে। তাই আর্সেনিক দূষণ এড়াতে বৃষ্টির পানি সংগ্রহ করে এবং পুকুর ও নদীনালার পানি পরিশ্রত করে পান করা যায়।
তৃতীয়ত, আক্রান্ত ব্যক্তিরা আর্সেনিক মুক্ত পানি পান করে, পুষ্টিকর খাবার খায় এবং হালকা ব্যায়াম করেও স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে পারে।
চতুর্থত, SOES CSIR-এর যৌথ প্রচেষ্টায় উদ্ভাবিত ফ্লাই এ্যাশ দিয়ে তৈরি ফিল্টারের ক্যাল্ডেল ব্যবহার করেও পানিকে আর্সেনিমুক্ত করা যায়। স্বল্প ব্যয়ে প্রতিদিন ২০ লিটার পরিশােধিত পানি পাওয়া সম্ভব।
পঞ্চমত, আর্সেনিক মুক্ত করার জন্য সক্রিয় কাঠ- কয়লার ভিতর দিয়ে আর্সেনিকমুক্ত পানি নিয়ে গেলে বেশখানিকটা পরিশােধিত হয়। এটা বিশেষজ্ঞদের আর একটি উদ্ভাবনী কৌশল। দেখা গেছে ১৮ ঘণ্টা এভাবে পানি ধরে রাখলে ১০০ গ্রাম কাঠ-কয়লা ০.৪৮ মিলিগ্রাম আর্সেনিক শােষণ করতে পারে। আর্সেনিক বিষক্রিয়া নিয়ন্ত্রণে জনসচেতনতার প্রয়ােজন। তারা যাতে আর্সেনিকমুক্ত পানি খাওয়া ও রান্নার কাজে ব্যবহার করতে পারে সে ব্যাপারে সজাগ থাকতে হবে। তাদেরকে বােঝাতে হবে এ রােগ ছোয়াচে নয় এবং এ রােগ হলে গােপন না। করে ডাক্তারের পরামর্শ নিতে হবে।
উপসংহার : বিভিন্ন পরীক্ষায় দেখা গেছে, আমাদের দেশে আর্সেনিকে আক্রান্ত রােগীর সংখ্যা একেবারে কম নয়। দিন দিন এ সংখ্যা বাড়ছে। তাই এ পরিস্থিতির গুরুত্ব সম্যকভাবে উপলব্ধি করতে হবে। তা না হলে অবস্থা আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে। তাই এব্যাপারে এখনই ত্বড়িৎ ব্যবস্থা নিতে হবে। আমাদের নিরাশ হলে চলবে না। কলেরা, যক্ষ্মা এসব রােগ একদিন ভয়াবহ ছিল। এখন আমরা এগুলাে হাতের, নাগালে আনতে সক্ষম হয়েছি। সেদিন আর দূরে নয় যেদিন আর্সেনিক দূষণের মত দুরারােগ্য ব্যাধিকেও আমরা জয় করতে পারবাে।
Post a Comment