ছাত্রজীবনের দায়িত্ব ও কর্তব্য: ছাত্রা নং অধ্যয়ন তপঃ- অধ্যয়নই । ছাত্রজীবনের পরম কর্তব্য। ছাত্রজীবনের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে। অধ্যয়ন করা। ছাত্রজীবনের মূল দায়িত্ব অধ্যয়ন হলেও সততা, ত্যাগ, সময়ানুবর্তিতা, আদব-কায়দা ইত্যাদি মানবিক গুণগুলো এই ছাত্রজীবনেই চর্চা করতে হবে। ছাত্রজীবনের সমস্ত সঞ্চয় ব্যক্তিজীবনের পরবর্তী সকল পদক্ষেপে কাজে লাগে। তাই সৎ চরিত্রবান হতে হলে সততার চর্চা করা, সত্যবাদী হওয়া, নিজ কর্তব্য সম্পর্কে সচেতন হওয়া, ত্যাগের মানসিকতা তৈরি করা ইত্যাদি সৎ গুণগুলাে ছাত্রজীবনে অনুশীলন করা ছাত্রদের কর্তব্য।
সততার বৈশিষ্ট্য: সততা বলতে সৎ থাকার গুণকে বােঝানাে হয়। সত্যের অনুসারী মানুষের সৎ থাকার প্রবণতার মধ্য দিয়ে সততার প্রকাশ ঘটে। অন্যায়, অবৈধ কাজ না করে ন্যায় ও সত্যের সপথে জীবন পরিচালনা করাই সততার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। জীবনকে সফল ও সার্থক করে তােলার প্রধান উপায় হলাে সততা। সৎ চিন্তা ও সৎ কাজের মধ্য দিয়েই বিকাশ ঘটে সততার মতাে মহৎ গুণ। তাই আদিকাল থেকে মানুষ সততার চর্চা করে সমাজে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করে আসছে। সততার গুণে সমৃদ্ধ মানুষ সমাজের আদর্শ মানুষ।
সততার সুফল: ছাত্রজীবনে সততার শিক্ষা নিয়ে এবং সত্যবাদিতার ব্যাপক চর্চা বা অনুশীলনের মাধ্যমে নিজেকে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তােলার মাধ্যমে ব্যক্তি নিজে যেমন উপকৃত হয়, তেমনি পরিবার, সমাজ, জাতিও উপকৃত হয়। সততার সুফল শত ধারায় বিকশিত। জীবনকে সুন্দর, সফল ও সার্থক করে তুলতে হলে সৎ থাকার অভ্যাস অর্জন করতে হয়। সৎ গুণসম্পন্ন মানুষ কখনাে অসৎ কিংবা মন্দ কাজে লিপ্ত থাকতে পারে না। সৎ লােক মাত্রই চরিত্রবান ও মহৎ হয়ে থাকে। সৎ লােক সমাজে সবার বিশ্বাসভাজন হয়ে থাকে। সততা মানুষকে নৈতিক শক্তিতে বলীয়ান করে থাকে। সৎ ব্যক্তি কখনাে অন্যায়-অসত্যের কাছে মাথা নত করে না। তাই মানবজীবনে তথা ছাত্রজীবনে সততার অনুশীলনের গুরুত্ব অপরিসীম।
সততা শ্রেষ্ঠ গুণ: প্রবাদ আছে 'Honesty is the best policy' তাই গুণ হিসেবে সততার স্থান সবার ওপরে। যে জীবনে সততার অভাব আছে তাকে যেমন যত্রতত্র নিগৃহীত হতে হয়, তেমনি সততাকে ধারণ করে এমন ব্যক্তি সর্বত্র হয়ে ওঠে পূজনীয়। জগতে কীর্তিমান মহামানবদের জীবনেও সততা চর্চার উদাহরণ লক্ষ করা যায়। পরিবারে অন্তত একজন ব্যক্তিও যদি সততা চর্চা করে তবে দেখা যায় সে পরিবারের সকলের কাছে অনেক বেশি বিশ্বস্ত হয়ে ওঠে। সমাজজীবনেও এবপ উদাহরণ চোখে পড়ে। নিতান্ত দরিদ্র হয়েও অনেক ব্যক্তি সমাজে আস্থাভাজন হয়ে ওঠে। পক্ষান্তরে প্রচুর অর্থ, বিত্ত থাকা সত্ত্বেও সততা নেই বলে অনেকেই সমাজে বিবেচিত হয় নিকৃষ্ট ব্যক্তি হিসেবে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবনে সততার মতাে শ্রেষ্ঠ গুণটি বড়াে ভূমিকা পালন করে। কোনাে সমাজ কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠান বা সমবায় সমিতিতে কোষাধ্যক্ষ পদটিতে সততা আছে, এমন ব্যক্তিকেই নিয়ােগ দেওয়া হয়। কোনাে কোনাে সময় রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশকে বদলে দেয় সততা। কোনাে রাজনৈতিক দলের পরাক্রমশালী নেতা হয়তাে প্রচুর অর্থ ব্যয়ে নির্বাচনে বিজয়ী হবার মারাত্মক প্রচেষ্টা চালায়। পক্ষান্তরে রাজনৈতিক দলগত পরিচয় না থাকা সত্ত্বেও কোনাে ব্যক্তি স্বতন্ত্র হিসেবেই নির্বাচনে বিপুল ভােটে জয়লাভ করে শুধু সততার শক্তিতেই। তাই মানবজীবনে সততাই শ্রেষ্ঠ গুণ হিসেবে বিবেচিত। আর এই জন্যই সততার অনুশীলন ছাত্রজীবন থেকেই শুরু হওয়া উচিত।
সততার প্রয়ােজনীয়তা: ব্যক্তি ও সমাজজীবনে সততার প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য। জীবনের অনিবার্য প্রয়ােজনে মানুষকে কাজ করতে হয়। চাকরিতে যােগদান করতে হয়। কর্মজীবনে সততা না থাকলে সহকর্মীদের শ্রদ্ধা ও আন্তরিকতা লাভ করা যায় না। লোভ-লালসা, প্রলােভন ইত্যাদির উর্ধ্বে থেকে মানুষকে সততা চর্চা করতে হয়। অন্যথা ব্যক্তির নৈতিক চরিত্র কুলষিত হয়। সমাজজীবনে সততার অভাব হলে সমাজে অন্যায়-অবিচার বৃদ্ধি পায়। সমাজ হয়ে পড়ে অস্থিতিশীল। তাই একটি সুন্দর সমাজের আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য চাই সততার চর্চা। রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় জীবনেও রয়েছে সততার অপরিসীম প্রয়ােজনীয়তা। জাতীয় জীবনে সততার অনুশীলন যত বেশি হবে, রাষ্ট্র তত নিরাপদ ও শান্তিময় হয়ে উঠবে। অন্যদিকে সততার অভাব থেকে দুর্নীতি ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়বে। ফলে জাতির জাতীয় উন্নয়ন মারাত্মকভাবে বিঘ্নিত হবে। তাই সততার প্রয়ােজনকে স্বীকার করে এর অনুশীলন ছাত্রজীবন থেকেই বৃদ্ধি করা জরুরি।
সততাহীনতার পরিণাম: সততাহীন যে জীবন সে জীবন জননিন্দিত জীবন। মানুষ এ জীবনকে সমর্থন করে না, এমনকি সম্রাটও সততাবর্জিত মানুষকে অপছন্দ করেন। সততাহীন জীবনের কাছে কোনাে অন্যায়ই অন্যায় বলে বিবেচিত হয় না। ফলে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। পৃথিবীতে এমন রাষ্ট্র চোখে পড়ে, যেখানে শুধু সততার অভাব আছে বলেই তারা পিছিয়ে আছে আর সে কারণেই উন্নয়ন আর গৌরব তাদের কাছে রয়ে যায় অধরা।
সমাজজীবনে সততার প্রভাব: ব্যক্তি ও সমাজজীবনে সততার শক্তিশালী প্রভাব রয়েছে। সৎ ব্যক্তি সমাজের সর্বস্তরের মানুষের পছন্দের ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত হয়। ফলে তার ওপরই ন্যস্ত করতে চায় নেতৃত্ব। তাই সততার বলে। ব্যক্তি সমাজে উচ্চ ও দৃঢ় অবস্থানে আসীন হয়। যুগে যুগে শিক্ষাহীন, ধর্মহীন মানুষকে ধর্মের পথে দীক্ষিত করা সম্ভব হয়েছিল সমাজের সৎ ব্যক্তিদের মাধ্যমেই। ধর্ম প্রচারক, আল্লাহর প্রেরিত প্রিয় বান্দারা সকলেই ছিলেন সত্যবাদী। তাই তাদের আমন্ত্রণে পথহারা মানুষ ধর্মের আওতায় এসে সঠিক পথের সন্ধান লাভ করেছে। ব্যক্তি হজরত মুহম্মদ (সা.) তৎকালীন মূর্খ সমাজের মানুষকে আল্লাহর মনােনীত ধর্মে আকৃষ্ট করতে
পেরেছিলেন তার সততাপূর্ণ সর্বোৎকৃষ্ট চরিত্রগুণেই। এমনকি বিধর্মী ইহুদিরা পর্যন্ত তাকে আল-আমিন বলে ডাকত তার জীবনে সততা ছিল বলেই। ফলে সমাজের লােক তাকে বিশ্বাস করেছে। আর এ বিশ্বাসকে কাজে লাগিয়েই ইসলাম ধর্মের বিস্তৃতি ঘটিয়েছিলেন হজরত মুহম্মদ (সা.)। তাই ব্যক্তিজীবনে ও সমাজজীবনে এ সততার ব্যাপক প্রভাবের কথা অস্বীকার করা যায় না।
ছাত্রজীবনে ত্যাগের শিক্ষা বা অনুশীলন: ভােগ ও ত্যাগ মানবজীবনের সাথে জড়িত। দুটিই পরস্পরবিরােধী পথ। তবে ভােগ মানুষকে ইন্দ্রিয়পরায়ণ করে আর ত্যাগ মানুষের জীবনকে অর্থবহ করে তােলে। ভােগপ্রবণতা কখনাে মানুষকে সুখী করে না আর মানুষ্যত্বেরও বিকাশ ঘটায় না। ত্যাগের মাধ্যমে পাওয়া যায় প্রকৃত সুখ। ত্যাগের শিক্ষা মানুষ পরিবার ও বিদ্যালয়েই প্রথম গ্রহণ করে থাকে। ছাত্রজীবনে মানুষ ত্যাগের যে শিক্ষা পায় তাই তার ব্যক্তিজীবনে প্রতিফলিত হয়। ভােগবাদিতা মানবজীবনের আদর্শ নয়। পরার্থে আত্মত্যাগই মনুষ্যত্বের আদর্শ। পৃথিবীর মানুষ প্রবৃত্তির দাস। প্রবৃত্তি মানুষকে ভােগপ্রবণ করে। আর প্রবৃত্তির হাত থেকে মুক্তির মাধ্যমে মানুষের আত্মমুক্তি ঘটে। আর এ মুক্তির মাধ্যমে মহৎ জীবনের আস্বাদ পাওয়া যায়। ভােগের কারণে মানুষ সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে ব্যর্থ হয়। ফলে ভােগ করতে হয় সীমাহীন দুঃখ- দুর্দশা। ভােগপ্রবণতা মানুষকে আত্মকেন্দ্রিক ও আত্মস্বার্থপর করে তােলে। ভােগের বশবর্তী মানুষের দ্বারা পৃথিবীতে কোনাে মহৎ কাজ করা সম্ভব হয় না। স্বার্থপরভােগী মানুষকে জগৎ মনে রাখে না। অপরের জন্য নিজের সুখ বিসর্জন দেওয়ার মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি পাওয়া যায়। আর ত্যাগী মানুষ তার মহৎ গুণের জন্য স্বমহিমায় উজ্জ্বল হয়ে থাকে। ত্যাগের মাধ্যমে তারা পৃথিবীতে অমরত্ব লাভ করে। দৈহিকভাবে উপস্থিত না থেকেই তাদের ত্যাগের কারণে মনুষ্যত্বের জন্য সদাই তাদের উপস্থিতি অনুভব করা যায়। যুগে যুগে জ্ঞানী ও পণ্ডিত ব্যক্তিরা তাদের ত্যাগের মাধ্যমেই মানবকল্যাণে ব্রতী হয়েছেন। মাদার তেরেসা, ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল প্রমুখ মানব জাতির কল্যাণের জন্য বহু ত্যাগ স্বীকার করে গেছেন। তাই ত্যাগই আমাদের চরিত্রের আদর্শ হওয়া উচিত। তবে ত্যাগ মানে নিজেকে সর্বস্বান্ত করা নয়, নিজের জীবন ও পরিবারকে বিসর্জন নয়। অন্যের কল্যাণের জন্য ত্যাগই যথার্থ। এর মাধ্যমে প্রকৃত সুখ লাভ করা যায় এবং যথার্থ মনুষ্যত্বের পরিচয় ঘটে। জীবনকে সুন্দর ও স্বার্থক করতে হলে স্বার্থ ত্যাগ করা উচিত। ভােগী মানুষ বাঁচে তার পরিবার-পরিজনের পরিধির মধ্যে আর ত্যাগী মানুষ বাঁচে কালের অনন্ত প্রবাহে। কাজেই ত্যাগের অনুশীলন ছাত্রজীবনের একটি অপরিহার্য দায়িত্ব।
উপসংহার: সততা ও ত্যাগ দুটি মহৎ গুণ। আমাদের চরিত্রকে মহিমান্বিত করার জন্য জীবনকে সফলতায় ভরে দেওয়ার জন্য সততা ও ত্যাগের চর্চা অপরিহার্য। জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আমাদের সততার পরিচয় দেওয়া এবং ত্যাগের দৃষ্টান্ত স্থাপন করা একান্ত জরুরি। আর এ জন্যই ছেলেবেলা, অর্থাৎ ছাত্রজীবন থেকেই আমাদের সৎ থাকার এবং স্বার্থ ত্যাগের অভ্যাস গঠন করতে হবে। সততা ও ত্যাগের অনুশীলন করতে হবে। সততা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কয়েকটি লাইন এক্ষেত্রে উল্লেখ করা যায়-
'মরে না মরে না কভু সত্য যাহা,
শত শতাব্দীর
বিস্মৃতির তলে,
নাহি মরে উপেক্ষায়, অপমানে না
হয় অস্থির
আঘাতে না টলে।'
Post a Comment