বা মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিসেনা
বা মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা
ভূমিকা ঃ বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হয় ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর লাখাে শহীদের রক্তে রঞ্জিত বাংলার স্বাধীনতা সূর্য উদিত হয়। দীর্ঘ ৯ মাসের সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা লাভ করেছি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। এ দিন বিশ্ব মানচিত্রে আরেকটি স্বাধীন দেশের নাম সংযােজন হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যেমন হৃদয় বিদারক, শােকাবহ, লােমহর্ষক, তেমনি ত্যাগের মহিমায় ভাস্কর। মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি : মানুষ স্বাধীনতাপ্রিয়। স্বাধীনভাবে বসবাস করার জন্য আদিকাল থেকে মানুষ বিভিন্নভাবে সংগ্রাম করে এসেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পেছনে রয়েছে একটি ঐতিহাসিক পটভূমি। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন ইংরেজরা এদেশের শাসন ক্ষমতা দখল করে। তারপর বিভিন্ন কারণে বিভিন্ন সময়ে এ দেশের মানুষের মনে জন্ম নিয়েছে বিক্ষোভ, আন্দোলন আর সংগ্রামের। ফলে ১৯৪৭ সালে জন্ম নিয়েছে ভারতের পশ্চিমে ও পূর্বে মিলে পাকিস্তান নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। কিন্তু পাকিস্তান শাসকগােষ্ঠী বৈষম্যের পাহাড় সৃষ্টি করেছিল সর্বক্ষেত্রে ফলে স্বাধীন হলেও আমরা স্বাধীনতার সুফল ভােগ করতে পারেনি পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর কারণে। তারা নানাভাবে শােষণ শাসন নির্যাতন চালিয়ে, নিষ্পেষিত করেছে আমাদেরকে। সর্বক্ষেত্রে ন্যায্য অধিকার হারিয়ে জনমনে যে পুঞ্জিভূত বিক্ষোভ জমা হয়েছিল তাই অধিকার আদায়ের আন্দোলনের মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা আন্দোলন বাঙ্গালির ইতিহাসে এক মাইলফলক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক নির্বাচনে ক্ষমতাসীন শাসকগােষ্ঠীর চরম পরাজয়ের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির স্বাধিকার আন্দোলনও জাতীয় চেতনায় বিজয় ঘােষিত হয়। ফলে শুরু হয় দমননীতি। ১৯৭০ সালের জাতীয় পরিষদের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু কুচক্রী ইয়াহিয়া সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে ছলচাতুরীর আশ্রয় নেয়। ফলে জনসাধারণের মনে অসন্তোষের আগুন দানা বেঁধে স্বাধিকার আন্দোলনে রূপ নেয়। আন্দোলন দমন করতে ১৯৭১ এর ২৫ মার্চ রাতে ইয়াহিয়া সরকার পৃথিবীর ইতিহাসে ঘৃণ্য ও জঘন্যতম গণহত্যা সংঘটিত করে। স্বাধীনতা ঘােষণার অব্যবহিত পরে আন্দোলনের নেতা শেখ মুজিবকে বন্দী করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন কালুর ঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বজ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। স্বাধীনতার ঘােষণা শােনার পর থেকেই সারা দেশে মুক্তিপাগল ছাত্র জনতা স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ে। শুরু হয় প্রতিরােধ আর স্বাধীনতা যুদ্ধ।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনা : লাখাে শহীদের জীবনের বিনিময়ে অর্জিত আমাদের এ স্বাধীনতা। রক্তে কেনা এ সবাধীনতা বাঙালির জ্ঞানের যে উন্মেষ ঘটিয়েছেন তা সভ্যতার ইতিহসাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা হয়ে আছে। লেখা হয়ে আছে চৈনিক সভ্যতার কথা। স্পেনের মুসলমানরা জ্ঞানবিদ্যার যে উৎকর্ষ ঘটিয়েছিল তা এখনাে পৃথিবীর মানুষ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করে। কোন জাতিকে উন্নতির দিকে এগিয়ে নিতে হলে সে জাতিকে শিক্ষিত করে গড়ে তােলা দরকার। অন্ধকারে আচ্ছন্ন জাতি সহজে মুক্তির পথ খুঁজে পায় না। আর সে মুক্তির পথ হচ্ছে শিক্ষা। এ উপমহাদেশের বেশির ভাগ মানুষ অশিক্ষিত ছিল বলেই চতুর ইংরেজরা এখানে প্রায় দুশাে বছর রাজত্ব করতে পেরেছে। এ সত্যটি যখন এখানকার মানুষ অনুভব করলাে, তখন তারা শিক্ষার দিকে মনােযােগী হলাে। অবশেষে ইংরেজদের ক্ষমতার ভিত কেঁপে উঠলাে এবং তাড়াতাড়ি গুড়িয়ে চলে যেতে বাধ্য হলাে।
শিক্ষার অবদান : শিক্ষার অবদান বর্ণনা করে শেষ করা যাবে না। শিক্ষা দ্বারাই মানুষ গড়ে তুলছে নতুন নতুন সভ্যতা। শিক্ষার আশ্চর্য সাফল্য দ্বারা মানুষ মিটাচ্ছে তার দৈনন্দিন অভাব। বিংশ শতাব্দীর এ যে নানান অত্যাশ্চর্য আবিষ্কার, এতাে শিক্ষারই দান। শিক্ষার সাহায্যে মানুষ পরকে করেছে আপন, দূরকে করেছে কাছে। এখন ছােট হয়ে এসেছে পৃথিবী। এখন আমরা মুহূর্তের মধ্যে অনেক দূরত্ব পাড়ি দিতে পারি, ঘরে বসেই জানতে পারি পৃথিবীর সব খবরাখবর। শিক্ষা যেমন চিন্তায় মুক্তি আনয়ন করে, তেমনি শিক্ষালব্ধ জ্ঞান দিয়ে আমরা আমাদের ব্যক্তিগত, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সমস্যার সমাধান করে থাকি। এমনকি অবসরেও শিক্ষা থেকে গ্রহণ করি আমরা বিনােদনের বিচিত্র উপাদান। বলা যেতে পারে শিক্ষা ছাড়া সমাজ, জাতি অচল। প্রাগ্রসর চিন্তা-চেতনায় শিক্ষাই আমাদেরকে দেয় নতুন পথের সন্ধান।
শিক্ষাহীনতার কুফল : প্রকৃত শিক্ষার মাধ্যমে সমাজ জীবনে সমাজ প্রতিষ্ঠা লাভ করা যায়। কোন অশিক্ষিত মানুষ অর্থজোরে সমাজে প্রভাব বিস্তার করতে পারে সত্য, কিন্তু প্রকৃত সম্মান তিনি কখনাে লাভ করতে পারে না। শিক্ষাই সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠার যথার্থ মাপকাঠি। যে ব্যক্তি শিক্ষিত নয়, তারা কাছ থেকে সমাজ তেমন কিছু আশা করতে পারে না। দেশ ও বিদেশের সম্যক পরিস্থিতি সম্বন্ধে সে থাকে অজ্ঞ। অশিক্ষিত ব্যক্তি নিজের সম্পর্কে যেমন সচেতন নয় অন্যের সম্পর্কেও তেমনি অসচেতন। সে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ধর্মীয়, অর্থনীতি, সমাজনীতি সব ক্ষেত্রেই থাকে অজ্ঞ। আমাদের দেশের অধিকাংশ লােকই অশিক্ষিত বলে তারা স্বাস্থ্যহীনতায় ভােগে, এ কারণেই বৃদ্ধি পায় জনসংখ্যা, সমাজ হয় কুসংস্কারাচ্ছন্ন। বিজ্ঞানের ব্যবহার সম্পর্কে তারা থাকে অজ্ঞ, আর এ কারণেই তাদের জীবনে আসে না তেমন পরিবর্তন। সভ্যতার সাথে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে এরা থাকে পেছনের সারিতে।
বৈজ্ঞানিক শিক্ষা সফলতা : শিক্ষার চরম পরিণতি বিজ্ঞানে। বিজ্ঞান শিক্ষার ক্ষেত্রে যে জাতি যত বেশি অগ্রসর সভ্যতা ও সফলতার ক্ষেত্রে সে জাতি তত বেশি সমৃদ্ধ। জাতির উন্নতির মূলে রয়েছে শিক্ষা, তথা বৈজ্ঞানিক শিক্ষা কার্যকরণের জ্ঞানই জীবের জীবন রক্ষার সহজ সুযােগ সৃষ্টি করে। শিক্ষা ঐ কার্যকরণের তথ্যের সাথে মানুষকে সুপরিচিত ও অভ্যস্থ করাতে পারে। মানুষের বাঁচার আদিম ও প্রধান উপকরণ খাদ্য। বৈজ্ঞানিক শিক্ষায় শিক্ষিত জাতিরা আজ খাদ্যের প্রাচুর্যে অধিক অগ্রসর। কৃষি গবেষণা আজ প্রতিটি জাতির জন্য অপরিহার্য।
সুপ্তগুনের বিকাশে শিক্ষা : বিশাল প্রকৃতির রাজ্যে মানুষের জন্ম। এখানেই সে আস্তে আস্তে বেড়ে ওঠে। তার এ গড়ে উঠার পেছনে সাহায্য করে শিক্ষা। শিক্ষার সাহায্যেই সে তার সুপ্তগুণের বিকাশ ঘটায় এবং প্রকৃতির সব কিছুকে আস্তে আস্তে জেনে নেয়। প্রকৃতির অনেক কিছুই রহস্যাবৃত থাকে, মানুষ শিক্ষার সাহায্যে সে বেড়াজাল ছিন্ন করে। এবং নতুন জিনিস আবিষ্কার করে। এ আবিস্কারই জাতির সম্পদ, জাতির শক্তি, জাতির কল্যাণের আঁধারে। আর এসব কিছুর মূলেই রয়েছে শিক্ষা।
উপসংহার : যুগে যুগে জাতির জীবনে নেমে আসে ক্রান্তিলগ্ন। এ ক্রান্তিলগ্ন থেকে উত্তরণের সঠিক পথ নির্দেশ করে শিক্ষিত ব্যক্তিরা। শিক্ষিত ব্যক্তি এবং তার শিক্ষা কোন জাতির জন্য নির্দিষ্ট থাকে না। সমগ্র পৃথিবীর সব জাতির জন্য তা অমূল্য সম্পদ। তাই যে জাতি যত বেশি শিক্ষিত সে জাতি তত বেশি উন্নত। নিঃসন্দেহে তাই বলা যায়, শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড।
Post a Comment