তােমার প্রিয় লেখক/ তােমার প্রিয় সাহিত্যিক
ভূমিকা: যে কবির কাব্যে আছে মৃত্যুঞ্জয়ী চিরযৌবনের জয়ধ্বনি, অগ্নিবীণার সুরঝংকার; যিনি ধীরস্থির অচঞ্চল বাংলা কাব্যে বয়ে এনেছিলেন দুর্বার কালবৈশাখীর ঝড়, তিনি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম, তিনি আমার প্রিয় কবি। এ পরাধীন জড়তাগ্রস্ত সমাজের বুকে তিনি সঞ্চারিত করেছিলেন। নবযৌবনের জয়গান। কাজী নজরুল ইসলাম ১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দের ২৫শে মে পশ্চিমবঙ্গে জন্মগ্রহণ করেন এবং ১৯৭৬ সালের ১৯শে আগস্ট ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। বাংলা কাব্যে নজরুল: বিদ্রোহের জয়ধ্বজা উড়িয়ে ধূমকেতুর মতাে কাজী নজরুল ইসলাম আবির্ভূত হয়েছিলেন বাংলা কাব্যে। উদাত্তকণ্ঠে তিন ঘােষণা করলেন -
'বল বীর
বল উন্নত মম শির
শির নেহারি আমারি নত শির ঐ শিখর হিমাদ্রীর।'
কেবল এ 'বিদ্রোহী কবিতাতেই বাংলা কবিতার আসরে তিনি সুপ্রতিষ্ঠিত হলেন। কবি নজরুল হলেন বাংলার বিদ্রোহী কবি'। কবির বিদ্রোহ আত্মার জন্মের মূলে যে অনুপ্রেরণা কাজ করেছিল তা হলাে কবির প্রেম। কবি তার আত্মপ্রকাশে গেয়ে গেছেন-
'মম এক হাতে বাকা বাশের বাশরী
আর হাতে রণতূর্য।'
কবিকণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে, “জগতে আমি প্রেম দিতে এসেছিলাম, যেখানে আমি প্রেম পাই নি, সেখানেই বিদ্রোহ করেছি।" কবি সত্য, সুন্দর ও মানবতার পূজারী। সকল প্রকার অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সােচ্চার।
কৈশাের ও প্রথম যৌবন: কবি নজরুলের জন্ম পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে। ছেলেবেলাতেই পিতৃহারা হয়ে নিদারুণ দারিদ্র আর অভিভাবকহীনতার কারণে চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে পতিত হন। এ সময়ে লেটো গানের দলে গীত রচনা ও সুর সংযােজনা করার প্রয়াসের মধ্যে নজরুলপ্রতিভার বিকাশ পরিলক্ষিত হয়। পরবর্তীকালে তিনি লেখাপড়ার চেয়ে কর্মজীবনের প্রতি বেশি ঝুঁকে পড়েন। প্রথম মহাযুদ্ধের সময়ে তিনি বাঙালি পল্টনে যােগদান করেন এবং সেনাবাহিনীতে যােগ্যতার পরিচয় দিয়ে হাবিলদার পদে উন্নীত হন।
প্রতিভার উৎস: প্রথম মহাযুদ্ধের অবসান হলে ছাঁটাইয়ের খাতায় নাম ওঠে। নজরুলের। মহাযুদ্ধের স্মৃতি ও পরাধীনতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের দাবাগ্নি জ্বালিয়ে দুর্দান্ত আবেগে দেশের মাটিতে ফিরে আসেন বাংলার অখ্যাত। হাবিলদার কবি। যুদ্ধক্ষেত্রে বসে রচিত তার কবিতা মুক্তি এরই মধ্যে একটি পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল। এবার তিনি বিদ্রোহের বহ্নিচ্ছটা নিয়ে বাংলা কবিতার আসরে অবতীর্ণ হলেন। কোরআন, গীতা ও মহাভারতের গভীর জ্ঞান এবং আরবি, ফারসি, সংস্কৃত ও বাংলার শব্দভাণ্ডারের দুর্লভ চাবিকাঠি ছিল তাঁর হাতে। আর ছিল উদাত্তকণ্ঠ ও রাগ-রাগিণীর জ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার কীর্তন বাউল জারি-সারি-ভাটিয়ালির প্রতি প্রাণের টান। সেইসাথে ফারসি গজলের প্রাণমাতানাে সুরবাহারের প্রতিও ছিল তার গভীর অনুরাগ।
বিদ্রোহী-যৌবনের কবি: নজরুল চিরযৌবনের কবি। দুর্বার প্রাণ-প্রাচুর্যই যৌবনের নিশ্চিত প্রাণ-স্পন্দন। সব ধরনের শােষণ-শাসন-শৃঙ্খল আর দুর্জয় সাধনায় কবি ছিলেন ব্রতচারী, প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। যুদ্ধ হতে প্রত্যাবর্তনের পর নজরুল দেখলেন দেশ পরাধীনতার জিঞ্জিরে বন্দি। ধনিক শ্রেণি ও সাম্রাজ্যবাদীদের নির্লজ্জ শােষণে সমগ্র সমাজে রচিত হয়েছে কঙ্কাল পরিকীর্ণ এক বিশাল শ্মশানভূমি। তখন তিনি গাইলেন-
'কারার ঐ লৌহ কপাট
ভেঙে ফেল কর রে লােপাট
রক্তজমাট শিকল-পূজার পাষাণ বেদী।'
সামাজিক জড়তা ও ক্লান্তিকর নৈষ্কর্ম্যের মধ্যে কালবেশাখি ঝড়ের মতাে তিনি আবেগজড়িত কণ্ঠে গাইলেন-
'মেনে শত বাধা টিকি হাঁচি
টিকে দাড়ি নিয়ে আজো বেঁচে আছি
বাঁচিতে বাঁচিতে প্রায় মরিয়াছি, এবার সব্যসাচী,
যা হােক একটা তুলে দাও হাতে, একবার মরে বাঁচি।'
নজরুলের বিদ্রোহ যেমন পরাধীনতার বিরুদ্ধে, তেমনি তার বিদ্রোহ সামাজিক অসাম্যের বিরুদ্ধেও। তাঁর দৃষ্টিতে সমস্ত সামাজিক ভেদাভেদই কৃত্রিম ও মিথ্যে। তাঁর কথায়-
'ও কি চণ্ডাল ! চমকাও কেন? নহে ও ঘৃণ্যজীব
ও হতে পারে হরিশ্চন্দ্র, ওই শ্মশানের শিব !'
তার অগ্নিবীণা', বিষের বাঁশী', 'সর্বহারা', ফনি-মনসা' প্রভৃতি কাব্যগুলােতে মূলত বিদ্রোহেরই সােচ্চার জয়ধ্বনি প্রতিফলিত হয়েছে।
হিন্দু-ধুসলমানের মিলনতীর্থ: ভারতবর্ষে যখন একদিকে স্বাধীনতার আন্দোলন প্রবল হয়ে উঠেছে, অন্যদিকে তেমনি হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে। নজরুল তখন ডাক দিলেন -
'হিন্দু না ওরা মুসলিম? -ওই জিজ্ঞাসে কোন জন !
কাণ্ডারী, বল, ডুবিছে মানুষ, সন্তান মাের মার।
এভাবে তিনি হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে সম্প্রীতির মিলনমন্ত্র রচনা করে গেছেন। নজরুলের কাব্য তাই হিন্দু-মুসলমানের মিলনতীর্থ ।
উপসংহার: নজরুল বিদ্রোহী কবি, ব্যথিত মানবাত্মার কবি। আমার প্রিয় কবি। তিনি বিদ্রোহী যৌবনের কপালে জয়তিলক এঁকে দিয়ে তাকে 'দুর্গম | গিরি কান্তার মরু দুস্তর পারাবার উত্তরণের মন্ত্রে দীক্ষিত করেছেন। নজরুলের সৃজনশীল সৃষ্টি আজও আমাদের প্রাণে শক্তি জোগায়। আমাদের অনুপ্রাণিত করে। তাই তাে নজরুল গণজাগরণের কবি, নিপীড়িত মানুষের কবি এবং আমার প্রিয় কবি।
Post a Comment