বা রূপসী বাংলাদেশ
ভূমিকা : সুজলা সুফলা, শস্য শ্যামলা আমাদের এ বাংলাদেশ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব লীলাভূমি এদেশকে বিধাতা সমস্ত সৌন্দর্য উজাড় করে দিয়েছেন। ফুলে ফলে, শস্যে ভরা এ দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে কবি গেয়েছেন, "কোন বনেতে জানিনে ফুল,
গন্ধে এমন করে আকুল
কোন্ গগনে উঠবে চাদ এমনি হাসি হেসে
আঁখি মেলে তােমার আলাে
দেশে আমার চোখ জুড়ালাে,
ঐ আলােকেই নয়ন রেখে মুদবাে নয়ন শেষে।”
দেশকে ভালােবাসার এ আবেগােচ্ছাসপূর্ণ কবিবাণী সার্থক। বাংলাদেশের অসাধারণ সৌন্দর্য দেখে মােগল আমলে, এমনকি প্রাচীনকালেও সীজার, ফ্রেডারিক, বার্নিয়ের, ইবনে বতুতা ও টেভানিয়ার প্রমুখ বৈদেশিক পর্যটকগণ মুগ্ধ হয়েছিলেন। বাংলাদেশকে প্রকৃতির সুরম্য লীলা নিকেতন বললে মােটেই অত্যুক্তি হয় না। লীলাময়ী প্রকৃতি এখানে মুক্ত হস্তে সৌন্দর্য বিতরণ করেছে। এ দেশের অনুপম প্রাকৃতিক সৌন্দর্য শাশ্বতকাল ধরে মুগ্ধ কবিচিত্তে সংগীতের উৎসধারা জন্ম দিয়েছে। ভাবুকের হৃদয়ে হিল্লোল তুলেছে।
গ্রাম্য দৃশ্য : বাংলাদেশ গ্রামবহুল দেশ। এর এক একটা গ্রাম যেন প্রকৃতির এক একটা লীলা নিকেতন। যে দিকেই তাকাই না কেন, দেখা যায় সবুজ মাঠ, ফল ফুলময়, বৃক্ষ, তৃণ, গুল্মশােভিত বনানীর মনােরম শােভা আর শস্য-শ্যামল ক্ষেত্র। এ অপূর্ব সৌন্দর্য দেখে কে না মুগ্ধ হয়? কোথাও প্রকৃতির সবুজ অবগুণ্ঠনের মধ্যে হতে পাকা শস্যের স্বর্ণ সুন্দর মুখখানি বের হচ্ছে, কোথাও দীর্ঘ বটবৃক্ষ মৌন প্রান্তরের মাঝে উর্ধ্বাহু বাড়িয়ে নির্বাক দাঁড়িয়ে সুশীতল ছায়া দিয়ে পথিকের প্রাণ শীতল করছে। কুটিরঘেরা পল্লীগ্রাম, মাঠে সবুজের সমরােহ, দীর্ঘির কালাে জলে কেলিরত শুভ্র হংস হংসী সাঁতার কাটছে। সারি সারি তাল, নারকেল বৃক্ষ তার প্রতি প্রতিনিয়ত আকর্ষণ সৃষ্টি করছে। কবিগুরুর ভাষায়,
“অবারিত মাঠ, গগন ললাট চুমে তব পদধূলি,
ছায়া-সুনিবিড় শান্তির নীড় ছােট ছােট গ্রামগুলি।
পল্লবঘন আম্রকানন রাখালের খেলা গেহ,
স্তব্ধ অতল-দীঘি-কালাে-জল নিশীথ স্নেহ।”
নদনদীর দৃশ্য : বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। বাংলাদেশের ন্যায় এত নদনদী পৃথিবীর খুব অল্প দেশেই আছে। পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র, কর্ণফুলী, শীতলক্ষ্যা প্রভৃতি নদী বাংলাদেশের বুকের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তার সমভূমিকে সুজলা সুফলা শস্য শ্যামল করেছে। নদীর বুকে যখন সারি সারি ডিঙ্গি নৌকা, মহাজনী নৌকা পাল তুলে এবং লঞ্চ স্টীমারগুলো ধূম্ উদৃগিরণ করতে করতে ধাবিত হয়, তখন এক অপূর্ব শােভা দর্শনে মন আনন্দিত হয়ে উঠে।
বিভিন্ন ঋতুতে দৃশ্য : বছরের বারটি মাসব্যাপী বাংলাদেশে চলে ষড়ঋতুর বিচিত্র লীলা। গ্রীষ্ম, বর্ষা, শরৎ, হেমন্ত, শীত ও বসন্ত এ ছয়টি ঋতু নিরন্তর চক্রাকারে আবর্তিত হয়ে চলে। গ্রীষ্মের প্রখর সূর্যতাপে তরুলতা, মাঠ, ঘাট প্রভৃতি দগ্থ প্রায় হয়ে উঠে।, এ সময় বাগানে আম, কাঁঠাল, লিচু প্রভৃতি ফল পাকতে শুরু করে। বর্ষার আগমনে খালবিল, নদীনালা পানিতে থৈ থৈ। করে। প্রবল জলােচ্ছাস পাটক্ষেত, মাঠঘাট পূর্ণ করে এক অপূর্ব শােভার সৃষ্টি করে। এ সময়ে আকাশ হতে প্রবল বর্ষণধারা নামে। কুহু কেকার আনন্দধ্বনি জাগে। বনে বনে যুথী, কেয়া ও কদম ফুলের স্নিগ্ধ সুবাস ও সৌরভ ভেসে বেড়ায়। বর্ষার পর শরৎ তার শুভ্র জ্যোৎস্না নিয়ে আগমন করে। সাদা মেঘ আকাশে ঘুরে বেড়ায়। এ সময় কাশ, শেফালি, কামিনী প্রভৃতি হেমন্তের আগমনে শস্যক্ষেত্র ধীরে ধীরে হরিদ্রাবর্ণ ধারণ করলে প্রকৃতি এক অপরূপ শােভায় সজ্জিত হয়। এ সময় রাতে ফুল সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। শিশিরপাত হয়। প্রাতঃকালে শিশিরস্নাত তৃণগুলাের উপর সূর্যরশ্মি পড়লে এক মনােহর দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। শীতে সমস্ত গাছপালা শুষ্ক, বিবর্ণ ও শ্রীহীন হয়ে যায়। শ্যামল প্রকৃতি যেন সহসা রুক্ষমূর্তি ধারণ করে। বসন্তকালে বৃক্ষাদি, তরুলতা প্রভৃতি নব পুষ্প পল্লবে সুশােভিত হয়। এ সময়ে নানা রকম ফুল হতে মধুমক্ষিকা গুন গুন রবে মধু আহরণ করে, কোকিলের সুমিষ্ট কাকলি ও নানাবিধ মুকুলের মধুর সুবাসে মন প্রাণ চঞ্চল হয়ে উঠে। ঋতুরাজ বসন্ত বাংলার প্রকৃতিতে জাগায় নব জীবনের সাড়া। শীতের আড়ষ্টতা কাটিয়ে বসন্তে গাছপালা ও তরুলতা নতুন পল্লব, কুঁড়ি ও ফুলে সুশােভিত হয়ে উঠে। ঋতুরাজ বসন্তের প্রভাবে মানব মনও প্রভাবিত হয় বিশেষভাবে। প্রকৃতির নব উন্মাদনা মানুষের মনকে রঙে রঞ্জিত করে দেয়। প্রেমিকের আত্মা তার কাঙ্ক্ষিতকে পাওয়ার জন্যে ব্যাকুল হয়ে উঠে।
উপসংহার : বাস্তবিকই ষড়ঋতুর লীলা বৈচিত্র্যে বাংলাদেশের প্লাকৃতিক দৃশ্যে মনোহারিত্ব বৃদ্ধি পায়। এ দেশের জল, সথল, অন্তরীক্ষ যেদিকে দৃষ্টিপাত করা যায়, সেদিকই অপরূপ সৌন্দর্যে অতুলনীয়। কবির ভাষায়,
"এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি;
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি।"
বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য দেখে যে কেউ- কবির সাথে একমত হতে বাধ্য।
Post a Comment