SkyIsTheLimit
Bookmark

একটি পূর্ণিমার রাত রচনা

একটি চাঁদনী রাত
বা জ্যোৎস্না রাত

ভূমিকা : বাংলার আবহমান প্রাকৃতিক ও নৈসর্গিক দৃশ্য চিরকালই সাহিত্য-সংস্কৃতির খােরাক যুগিয়েছে। প্রকৃতিপ্রেমী মানুষের মনে অফুরন্ত ভাব ও আনন্দের সঞ্চার করেছে। চাঁদনী রাতের নৈসর্গিক রূপ যেমনি অভূতপূর্ব তেমনি উপভােগ্য। এ রাতে প্রকৃতি রূপ মাধুর্যে ভরে উঠে। স্নিগ্ধ আলােময় সে রূপের সাথে যার পরিচয় আছে সে সৌন্দর্য যে হৃদয় দিয়ে অনুভব করতে পারে সেই প্রকৃতির মধুর রূপটি হৃদয়ঙ্গম করতে পারে। কর্মমুখরতায় বিধৃত জীবনে মানুষ চারদিকে তাকানাের সুযােগ পায় না। আকাশের চাঁদ-তারা কিংবা চাঁদনী রাত দেখে সময় কাটানাের ফুরসত কারােরই হয়ে উঠে না। তবু নিয়মিত আকাশে চাঁদ উঠে, জ্যোৎস্নায় আলােকিত হয়ে উঠে পৃথিবী। কবিতার ভাষায়,
"ফুল বাগানের বেড়া হতে
হেনার গন্ধ ভাসে
কদম শাখার আড়াল থেকে
চাঁদটি উঠে আসে।"

চাঁদনী রাতের আবির্ভাব : পূর্ণিমার চাঁদনী রাতের মােহনীয় রূপের কথা এতদিন লাক মুখে শুনেছি, পড়েছি বইয়ের পাতায়। একদা ঘটনাচক্রে সে রাতের রূপ মাধুরী নিজ চোখে অবলােকন করার সৌভাগ্য হল। ঈদের ছুটি উপলক্ষে কলেজ ছিল বন্ধ।শান্ত এক রকম জোর করে ধরে নিয়ে গেল ওদের গ্রামের বাড়িতে। বিশাল একটি ঝিলের প্ড়ে ওদের সাজানাে গােছানাে বাড়ি। গ্রামের অপূর্ব দৃশ্য দেখার তীব্র আকাঙ্ক্ষা আমার আগে থেকেই ছিল। আজ সে আশা পূর্ণ হল প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায়। তখন ছিল পূর্ণিমার রাত। আমার কৌতূহলী মন চাদনী রাত দেখার জন্য ব্যাকুল হয়ে উঠল। সন্ধ্যার একটু পূর্বেই আমি আর শান্ত ঝিলের পাড়ে গিয়ে বসলাম। সন্ধ্যার ঘাের কাটতে না কাটতেই দেখতে পাই পূর্বাকাশে রূপার থালার মত চাদ কৃষ্ণচূড়ার মাথার উপর দিয়ে উকি দিচ্ছে। মনে হল আলাে-আঁধারের খেলায় মেতে উঠেছে প্রকৃতি এবং চাদের রূপসা আলাের কোমল পরশে ধন্য হতে চলেছে পৃথিবী। হয়ত এমনি অপূর্ব দৃশ্য অবলােকন করেই কবি লিখেছেন,
"বাঁশ বাগানের মাথার উপর চাঁদ উঠেছে ঐ
মাগাে আমার শােলক বলা কাজলা দিদি কৈ?"

শতাব্দীর সাড়া জাগানাে চাঁদনী রাত : গত ২২শে ডিসেম্বর ১৯৯৯ ছিল বিগত শতাব্দীর সবচেয়ে সারা জাগানাে চাঁদনী রাত। এ রাতে পূর্ণিমার চাঁদ পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে অবস্থান করে চারদিকে আলােকচ্ছটায় উদ্ভাসিত করে গােটা পৃথিবীকে উজ্জ্বলময় করে তােলে। ১৩৩ বছর পর চন্দ্র ও সূর্য পৃথিবীর সবচেয়ে কাছে অবস্থান করায় বিশাল আকৃতির চন্দ্র তীব্র আলােয় বিশ্বকে দীপ্তি দান করে। সে বাঁধ ভাঙ্গা চাদের হাসি দেখার জন্য বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীর মানুষের মধ্যে ব্যাপক কৌতূহল ও আলােড়ন পরিলক্ষিত হয়। এ রাতে ঘরে ঘরে ছিল সেই উছলে পড়া চাদের আলাে দেখার আনন্দ। বাড়ির ছাদে, খেলার মাঠে, প্রান্তরে, সাগরকূলে দাঁড়িয়ে লক্ষ থেকে কোটি মানুষ অবলােকন করেছে সেই অতি বিরল ঘটনা। বিস্ফোরিত নেত্রে অবলােকন করেছে মেঘহীন আকাশ, চাদের অভূতপূর্ব হাসি। মােহনীয় আলাের বন্যায় অবগাহন করেছে বিশ্বের উৎসুক জ্যোৎস্না পাগল মানুষ।এ রাতটি বৈজ্ঞানিকরা পর্যবেক্ষণ করেছেন ভিন্ন আঙ্গিকে। ব্যাপক গবেষণা ও তথ্য অনুসন্ধানে ব্যস্ত থাকেন তারা। এ রাতে চাঁদ ও পৃথিবীর দূরত্ব ৩২ মাইল কমে আসে। দিবসটি ছােট দিন থাকায় রাতে স্াভাবিকের তুলনায় চাদকে ১৪ শতাংশ বড় দেখা যায়। আর এ রাতে চাঁদের উপর সূর্যের আলো প্রতিফলিত হয়েছে ৭ শতাংশ বেশি। এসব কারণে গত ২২শে ডিসেম্বর, ১৯৯৯ রাতটি ছিল স্মরণীয়।

চাঁদনী রাতে প্রকৃতি : আলাে-আঁধারের স্নিগ্ধ মিতালীতে ঝলমল করে উঠে চাদনী রাত। এমন রাতে আলাে আঁধার কোনটাই তীব্রভাবে অনুভূত হয় না। এক অস্পষ্ট মায়ালােকে নিরমজ্জিত থাকে প্রকৃতি। প্রকৃতির পরতে পরতে ছড়িয়ে পড়ে এক কোমল পরশ। শরতের নির্মেঘ আকাশে তারার যেন ফুলঝুড়ি ফুটেছে। দক্ষিণা মৃদুমন্দ বাতাসে ঝিলের ঢেউগুলাে পত্ পত্ শব্দে তান ধরেছে। গান-গল্পের মধ্য দিয়ে এমন চন্দ্রালােকিত রাতের শােভা দেখতে দেখতে কখন যে রাত ১২টা বেজে গেছে তা আমরা টেরই পাইনি। মাঝরাতে চাদকে মাথার উপরে দেখে মনে হয়েছে যেন বিশাল আসমানের গায়ে কেউ একটি বড় গােলাকার বৈদ্যুতিক ভাল্ব জ্বালিয়ে রেখেছে। ভাষায় এমন দৃশ্যের বর্ণনা দেয়া প্রায় অসম্ভব। অল্প দূরে নদীর ধারে কাশবন, দূর থেকে মনে হয় সাদা কাশফুলের সাথে চাদের আলাের মিতালী ঘটেছে। কাশফুল দেখে মনে হয় শ্বেত শুভ্র বসন পরিহিত পরীর দল যেন নেচে নেচে চাঁদনী রাতকে স্বাগত জানাচ্ছে।

চাঁদনী রাতে মনের অবস্থা : রাতকে প্রায় সকলেই ভয় পায়। কিন্তু চাদনী রাত রাত হয়েও অনন্য। যখন আকাশে চাদ উঠে, জোছনা ছড়িয়ে পড়ে প্রকৃতিতে, শান্ত স্নিগ্ধ আলােয় ঝলমল করে উঠে সমস্ত আকাশ, মাটি, তখন সে রূপ সৌন্দর্য প্রতিটি মানুষের মনেই রঙ ধরায়। মনকে করে উদাস, হৃদয়ে আনে আকুলতা। সুখ-শয্যায় ঘুম আসে না, অথচ ঘুম না আসার কোন গ্লানিও স্পর্শ করে না শরীর মনকে, বরং মন তখন বলে উঠে,
"এমন চাদের আলাে
মরি যদি সেও ভালাে
সে মরণ স্বর্গ সমান।"

কবিতা আর গানের রাত : চাঁদনী রাতের উপভােগ্য দৃশ্য বাঙালি সংস্কৃতির সাথে একাকার হয়ে আছে। তাই আমাদের গানে কবিতায়-গল্পে চাদের প্রসঙ্গ আসে বার বার। এমনি রাতে কবিরা কবিতার উপকরণ খুঁজে পান। শিল্পীদের মনে ভাবের উদয় হওয়ার জন্য চাঁদনী রাতের তুলনা হয় না। গানের সুর ফুটিয়ে তােলার জন্য এমন রাত কম সহায়ক নয়। এমন চাদনী রাতে সবার মনে গানের সুর বেজে উঠে, "চাঁদ হেরিছে চাদ মুখ তার মরমীর আরশীতে” এমন রাত নিয়ে কবিগণ রচনা করেছেন মনমাতানাে কবিতা, সাহিত্যিক রচনা করেছেন ছােট বড় গল্প ও উপন্যাস। কবি জীবনানন্দ দাশ চাদনী রাতকে স্মরণ করেই লিখেছিলেন, "মহিমের ঘােড়াগুলি ঘাস খায় জ্যোৎস্নার প্রান্তরে।

ভিন দেশে চাঁদনী রাতের মূল্যায়ন : প্রকৃতির স্বর্গ বাংলা ভারতেই শুধু নয় অন্যান্য দেশেও এমন চাদনী রাতের মর্যাদা রয়েছে। ইংরেজ কবি কীটস্ এমনি এক চাদনী রাতে আবেগাপুত হয়ে ভেবেছিলেন মৃত্যুর কথা। 'সেদিনও আকাশে পরিপূর্ণ চাদ ছিল, নাইটিঙ্গেল পাখি গেয়েছিল সুমধুর গান। কবি ভেবেছিলেন এমন রজত প্রসূত চাদের আলােতে তাঁর মৃত্যু হলে সে মৃত্যু তাকে অমরত্ব দেবে। তবে ইংল্যান্ডের চাঁদনী রাত আর বাংলার চাদনী রাতের মধ্যে রয়েছে বিস্তর প্রভেদ। সে দেশে নির্ভেজাল জোছনা নেই; সে দেশের আকাশ থাকে বেশির ভাগ সময় কুয়াশার অন্ধকারে ঢাকা। আরেক ইংরেজ কবি কোলরিজ তার কোন কোন কবিতায় চাদের সাথে কুয়াশার যে খেলা চলে তার মধ্যে ভয়ের আবহ সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু বাংলাদেশের চাদের খেলা চলে মেঘের সাথে, কুয়াশার সাথে নয় এবং সে খেলায় কোন মৃত্যু ভয় কিংবা অন্য কোন ভয়ের আবহ থাকে না। চাঁদনী রাত আমাদের এখানে প্রত্যেক ঋতুতেই আসে। সব ঋতুতেই তা শান্তি ও স্নিগ্ধ দেবতার আশীর্বাদের মত। আজকের জোছনাও তা থেকে এতটুকু ব্যতিক্রম নয়। এমন জোছনাকে লক্ষ্য করেই হয়ত কবিগুরু বলেছিলেন,
"চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে উছলে পড়ে আলাে,
ও রজনীগন্ধা; তােমার গন্ধসুধা ঢালাে।"

উপসংহার : চাদনী রাতের আলাদা একটি রূপ বৈচিত্র্য আছে। এমন রাতের সৌন্দর্য উপভােগ ও অবলােকন করা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। এ সৌন্দর্য সুধা পান করার জন্য চাই আলাদা মন। চাঁদনী রাতের এ মায়াময় সৌন্দর্যের মধ্যে নিজেকে কতক্ষণ হারিয়ে ফেলেছিলাম তার সঠিক হিসাব ছিল না। হঠাৎ মধ্যরাতে মিলের-সাইরেন শুনে টনক নড়ল। অনুভব করলাম গােটা পরিবেশ যেন আমাকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে। আমি মনের অজান্তেই গেয়ে উঠলাম,
"তােমার পদে এ মিনতি করি দয়াময়
আমার মরণ চাঁদনী প্রহর রাইতে যেন হয়।"

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment