বা উপন্যাসে গ্রামীণ জীব
বাংলাদেশের উপন্যাস সাহিত্যের পটভূমি : বাংলাদেশের উপন্যাস সাহিত্যে সমাজ-সমস্যা ও সমাজ বিবর্তনের ধারা এসেছে। মূলত দু’ভাবে (ক) গ্রামীণ জীবনকে কেন্দ্র করে এবং (খ) নগর জীবনের আলেখ্য অঙ্কনের ভেতর দিয়ে। ফলে, বাংলাদেশের উপন্যাসে একদিকে যেমন রূপায়িত হয়ে উঠেছে বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবন, তেমনি অন্যদিকে নগর জীবনভিত্তিক জটিল জনজীবনের চিত্রও ফুটে উঠেছে।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক উপন্যাস : বাংলাদেশের উপন্যাস সাহিত্যের আলােচনায় সর্বাগ্রে প্রবীণ কথা-সাহিত্যিক আবুল ফজলের নাম স্মরণীয়। '৪৭- এর দেশ বিভাগ-পূর্বকাল থেকেই একজন দক্ষ-কথা-সাহিত্যিক হিসেবে তিনি সমাজের মধ্যবিত্ত ও উচ্চ মধ্যবিত্ত মুসলিম সমাজের কথা বলেছেন তার 'চৌচির', 'জীবন পথের যাত্রী ও 'রাজ্গা প্রভাত উপন্যাসে। তাছাড়া, বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের পটভূমিকায় রচিত সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর 'লালসালু, আবু ইসহাকের সূর্ষ দীঘল বাড়ী, মমিন উদ্দিন আহম্মদের 'সুখবর, সরদার জয়েন উদ্দিনের আদিগন্ত', শামসুদ্দিন আবুল কালামের কাশবনের কন্যা, আশরাফুজ্জামানের শায়ের নামা, কাজী আফসার উদ্দিন আহম্মেদের ‘চর ভাঙ্গা চর’, জহির রায়হানের 'হাজার বছর ধরে', আব্দুল গাফফার চৌধুরীর চন্দ্র দ্বীপের উপাখ্যান, আলাউদ্দিন আল আজাদের 'কর্ণফুলি, শওকত ওসমানের 'জননী, মােজাম্মেল হকের জোহরা, আকবর হােসেনের কি পাইনি, অবাঞ্চিত ইত্যাদি। ১৯৪৭ সালে দেশ-বিভাগােত্তর যুগের প্রথম দশকে গ্রামীণ জীবন নিয়ে রচিত উপন্যাসের সংখ্যাই বেশি। এগুলোর অন্যতম হচ্ছে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর লালসালু। এতে ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের চিত্র অতি সুন্দরভাবে অঙ্কিত হয়েছে। ধূর্ত ধর্ম ব্যবসায়ী মৌলভী মজিদ গ্রামবাসীদের অজ্ঞতা, সরলতা ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন অন্ধবিশ্বাসের সুযােগ নিয়ে তাদের প্রতারণা করেছে কোন এক অজ্ঞাতনামা মানুষের পুরানাে কবরে 'লালসালু বিছিয়ে।
আবু ইসহাকের সূর্য দীর্ঘল বাড়ী বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনের এক নিখুঁত চিত্র। এতে আমাদের চারপাশের জীবনের কৃষিজীবী মানুষের অর্থনৈতিক দুর্দশা, ধর্মীয় কুসংস্কার, মৌলভীদের কপট ধর্মাচার, মােড়লদের উৎপীড়ন ইত্যাদি অজস্র চিত্র এ্যালবামের মত বক্ষধারণ করে আছে জয়গুন, হাসু, গেদু, জয়গুনের মা উপন্যাসের জীবন্ত চরিত্র। মমিন উদ্দিন আহম্মদের সুখবর উপন্যাসে যেমন গ্রামীণ জীবনের অন্তর রূপটি ফুটে উঠেছে, তেমনি সরদার জয়েন উদ্দিনের 'আদিগন্ত উপন্যাসেও নিম্ন ও মধ্যবিত্ত মানুষের চিত্র ফুটে উঠেছে। বাংলাদেশের আঞ্চলিক জীবন চিত্রের বস্তির রূপ পাওয়া যায় শামসুদ্দিন আবুল কালামের 'কাশবনের কন্যা, আলাউদ্দিন আল আজাদের 'কর্ণফুলি ও তাসাদ্দুক হােসেনের মহুয়ার দেশে উপন্যাসে। ইতিহাস চেতনায় সমৃদ্ধ অথচ গ্রামীণ জীবনের চেতনায় ভাস্বর আব্দুল গাফফার চৌধুরীর ‘চন্দ্র দ্বীপের উপাখ্যান। শওকত ওসমানের জননী বাংলাদেশের মাটিতে গ্রাম্য জীবন নিয়ে লিখিত এক অনন্য সাধারণ উপন্যাস। এতে পল্লী জীবন, পল্লীর মানুষ এবং পল্লীর পরিবেশকে সামগ্রিকভাবে স্থান দেওয়া হয়েছে। জহির রায়হানের 'হাজার বছর ধরে উপন্যাসে উপেক্ষিত এক পল্লী জীবনের কেন্দ্রে অবস্থিত একটি একান্নবর্তী পরিবারের চিত্র বা আলেখ্য রূপ লাভ করেছে। আঞ্চলিক জীবনের চিত্ররূপ এ উপন্যাসটি ১৯৬৪ সালে আদমজী পুরস্কার লাভ করে। শহীদুল্লাহ কায়সারের সারেং বৌ উপন্যাসটির কাহিনী হচ্ছে সারেং বৌ; এ কাহিনীর সারেং যাকে ফেলে যায় সে বধূ। এর মধ্যেও অংশবিশেষে বাংলাদেশের পল্লীর পটভূমিকা চিত্রিত বলে এতে গ্রামীণ জীবনের কিছু কিছু ছোঁয়া মেলে। এছাড়া দৌলতুন্নেছার পথের পরশ উপন্যাসেও গ্রামীণ জীবনের চিত্র পাওয়া যায়।
উপসংহার : উপসংহারে বলা যায়, গ্রামীণ জীবনের পটভূমিতে রচিত বাংলাদেশের উপন্যাসগুলোর আলােচনায় এটাই সপষ্ট হয় যে, এসব উপন্যাসে ধর্মীয় ও সামাজিক কুসংস্কারের চিত্রই মূলত আলােচিত হয়েছে এবং এসব ক্ষেত্রে প্রাচীন ভাবধারার সঙ্গে আধুনিক জীবন চেতনার দ্বন্দ্ব সংঘাতই বিশেষভাবে প্রমূর্ত হয়ে উঠেছে।
Post a Comment