বা কলেজে প্রথম দিন
বা ফেলে আসা দিনগুলাে
ভূমিকা : সেদিনের কথা আমার বারবার মনে পড়ে, যেদিন আমি প্রথম কলেজে উপস্থিত হয়েছিলাম। স্মৃতিপটে কে ছবি আঁকে বলতে পারি না। সেদিন আমি আমার কলেজে জীবনে অপরিচিতের আবেষ্টনে নতুনত্বের মাঝখানে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছিলাম। সেদিনের স্মৃতি মনে অক্ষয় হয়েছে। তা আমার জীবনের একটি স্মরণীয় দিন। পল্লীতে আমার জন্ম। পল্লীপ্রকৃতির ছায়াস্নিগ্ধ ক্রোড়ে আমি লালিতপালিত। স্নেহশীল পল্লীমায়ের বুকে ছুটাছুটি করে, অবারিত মাঠে খেলা করে জীবনের স্পন্দন অনুভূত করেছি। শত সহস্র স্মৃতি বিজড়িত গ্রাম্য পাঠশালায় যাবার মেঠো পথখানি আজও মনে পড়ে। মনের পর্দায় ভেসে উঠে খরতপ্ত বৈশাখের ধূলিরুক্ষ গ্রাম্য পথ দিয়ে বই হাতে করে বিদ্যালয়ে যাচ্ছি। তারপর কয়েকটি বছর কিভাবে কেটে গেল বলতে পারি না। আমি প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলাম। স্কুলের প্রধান শিক্ষক মহােদয় আমাকে আশীর্বাদ করলেন। অন্যান্য শিক্ষকগণও আমাকে ভালােবাসতেন। তাদের নিকট হতে একে একে বিদায় নিলাম। তারা সবাই আশীর্বাদ করলেন, আত্মীয়-স্বজন সবাই আমাকে শুভেচ্ছা জানালেন, মা-বাবার অফুরন্ত আশীর্বাদ নিয়ে আমি শহরে এসে কলেজে ভর্তি হলাম। তখন মনে পড়ল, আমার স্কুল জীবনের কথা। সহপাঠী ও সকুলের ছাত্রদেরকে ভালবেসে শিক্ষকগণকে শ্রদ্ধা করে সবারই প্রগাঢ় ভালােবাসা লাভ করেছিলাম। আজ আবার কলেজের জীবনে তা লাভ করা সম্ভবপর হবে কি ? কলেজে প্রথম দিন : সেদিন ৫ই আগস্ট শনিবার। আমি বাড়ি হতে শহরে গিয়ে এক আত্মীয়ের বাসায় অবস্থান করেছিলাম। কারণ, তখন আমার হােস্টেলে সিট হয়নি। সেখান হতে আমি হেঁটে প্রায় এক মাইল দূরে কলেজের দ্বিতল অট্টালিকার প্রাঙ্গণে উপস্থিত হলাম। পিছন হতে একটি ছেলে জিজ্ঞাসা করল, আপনার নাম? "আপনি কোন বিভাগে ভর্তি হয়েছেন? পশ্চাৎ ফিরে দেখলাম রােটনকে। এ ছাত্রটি আমার মামার বাড়িতে জায়গীর থেকে আমাদের প্রতিবেশী এক উচ্চ বিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করত। সেও এবারেই প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছে। বললাম, আমি কামরুল, "বিজ্ঞান বিভাগে”। সে বলল, “আমিও বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়েছি। আসুন “ঐ সামনের বারান্দায় নােটিস বাের্ডে আমাদের রুটিন আছে।” তারপর উপরে একত্রে যেয়ে রুটিন টুকে নিলাম। নতুন পরিবেশে অজানা রহস্যের মধ্যে একটি পরিচিত মানুষকে এমনভাবে বন্ধুরূপে লাভ করে কত যে আনন্দিত হলাম, তা কেবল আমি জানি। এ সুহূদয় ছাত্রটি কলেজ জীবনে বরাবরই আমার সহচর। কবে, কোন সময়ে, কি করে আমরা আপনি স্থলে 'তুমি তুমি স্থলে 'তুই বলে সম্বােধন করতে লাগলাম বলতে পারব না। এর পর কত উপলক্ষে কত রকমের ছাত্রের সাথে পরিচয় ঘটে, কে তার হিসেব রাখে। আমার কলেজ জীবনের সাথীটির স্নেহ প্রীতির বিষয় আমি জীবনে ভুলতে পারব না। অবশ্য বিভিন্ন মনােভাবাপন্ন, বিভিন্ন। কিন্তু। দশনাবলম্বা, বিভিন্ন দেশের অধিবাসী ছাত্রদের সাথে মিলতে পেরে জীবনে অনেক বিষয় সম্পর্কে জেনেছি। তাদের চালচলন, রীতিনীতি এবং মনােভাব দেখে অনেক শিক্ষা লাভ করেছি।
কলেজের প্রথম ঘণ্টা : মনে পড়ে কলেজের প্রথম দিনের ঘণ্টা ও ক্লাস করার বিষয় সম্বন্ধে অধ্যক্ষ সাহেব ক্লাসে আসলেন। স্কুল জীবনের ও কলেজ জীবনের প্রভেদ সম্বন্ধে তিনি আমাদেরকে অনেক উপদেশ দিলেন। তিনি কি কি বলেছেন, আজ হুবহু তা মনে থাকার কথা নয়। তবে তার বক্তব্যের প্রধান বিষয়বস্ত ছিল এ যে, এখন আমরা স্কুল জীবন উত্তীর্ণ হয়ে কলেজ জীবনে পদার্পণ করেছি। এখন আর আমাদের জন্য স্কুলের ন্যায় অধিক অনুশাসন নেই, কারণ আমাদের বয়স ও - জ্ঞান বৃদ্ধির সাথে সাথে আমরা জীবনে দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্বন্ধে যথেষ্ট জ্ঞান লাভ করেছি। আমরা যেন এখন নিজেদের কর্তব্য ও দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন থাকি এবং চরিত্র ও মনুষ্যত্ব বলে জাতির গৌরব বৃদ্ধি করতে পারি। এর পর আরও কয়েক বিষয়ে ক্লাস হল। প্রত্যেক অধ্যাপকই ছাত্র জীবনের আদর্শ, শিক্ষার প্রকৃতি, উদ্দেশ্য, চরিত্র গঠন প্রভৃতি সম্পর্কে উপদেশ প্রদান করলেন। স্কুল জীবনে এরূপ বক্তৃতা খুব কমই শুনেছি। উচ্চ শিক্ষিত অধ্যাপকগণের বিশুদ্ধ ইংরেজি ভাষায় মনােজ্ঞ বক্তৃতা শ্রবণ করে প্রীত হলাম। তারপর ঢং ঢং করে ছুটির ঘণ্টা পড়ল; আমরা ক্লাসের বাইরে আসলাম।
উপসংহার : আমার কলেজ জীবনের প্রথম দিনের স্মৃতি চিরদিন মনের পটে অক্ষয় হয়ে বিরাজ করবে। এ দিনটি আমার জীবনের স্মরণীয় দিনও বটে। স্কুল জীবন পেরিয়ে যদি কলেজ জীবনে পদার্পণ না করতাম তবে অনেক কিছুই অজ্ঞাত থেকে যেত।
Post a Comment