ভেজালের প্রেক্ষিত: চিরন্তন অর্থের লালসার কারণেই মানুষ খাদ্যে ভেজাল দেয়। জীবনের সাথে অর্থ ওতপ্রােতভাবে জড়িত; সমাজজীবনে স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে গেলে অর্থের প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য। আর তাই অর্থ উপার্জনের জন্য মানুষের প্রাণান্ত প্রয়াস। কিন্তু প্রয়ােজন আছে বলে যেকোনাে উপায়ে অর্থ উপার্জন আইনসিদ্ধ নয়। অর্থোপার্জনের ক্ষেত্রে ন্যায়-অন্যায়বােধ থাকা দরকার। সৎপথে জীবিকার্জনের কথা অভিপ্রেত হলেও আজ ঘরে-বাইরে সর্বত্রই মনুষ্যত্বের দীনতার চিত্র ফুটে উঠছে বিশেষত খাদ্যদ্রব্যে ভেজাল দেওয়ার মাধ্যমে সেই চিত্র আরও নগ্নভাবে প্রকাশ পেয়েছে। একদিকে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব-কলহ, অন্যদিকে অর্থনৈতিক দুর্দশার ফলে সমাজের সর্বত্রই আজ নানা সমস্যায় ছেয়ে গেছে। আমরা প্রতিদিন অবাক বিস্ময়ে লক্ষ করি, সমাজে, সমাজ-বিরােধীর যে সম্মান, প্রতিপত্তি, সেখানে একজন জ্ঞানী ও সৎ মানুষের মূল্য তুচ্ছ; সততা সেখানে লাঞ্ছিত, অসহায়। বিবেক আজকের সমাজ-জীবনে বিশেষত ব্যবসায়ী মহলের মধ্যে নেই বলেই চলে। পুঁজিবাদী রাষ্ট্রশক্তি বা আজ বেশির ভাগ মানুষ সৎপথের কথা বা সততার কথা চিন্তা করে না। যে কোনাে উপায়ে হােক তার টাকা চাই। এ টাকা কালাে পথে, সাদা পথে কিংবা কারাে রক্ত ঝরিয়ে আসুক- তা যেন এ সমাজের মানুষের ভাবার অবকাশ নেই। ফলে ক্রমেই মানুষগুলােও ভেজালে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছে। এ পরিণতি সমাজের উঁচুস্তর থেকে শুরু করে নিচুস্তর পর্যন্ত সর্বত্রই বিরাজমান। এখন মানুষ তার নিত্য-প্রয়োেজনীয় খাদ্যদ্রব্যকে ভেজালে রূপান্তরের নিন্দনীয়- জঘন্য অপরাধ করতেও দ্বিধা করে না। ভেজাল এখন মানুষের দৈনন্দিন স্বাভাবিকতায় পরিণত হয়েছে। আমাদের নৈমিত্তিক জীবনের প্রতিটি খাদ্যদ্রব্যেই আজ ভেজাল। আর এ ভেজালের পদ্ধতিও বিচিত্র। ভেজাল দেওয়ার প্রক্রিয়ায় খাদ্যশস্য বহির্ভূত পদার্থ সরাসরি যােগ করা হয়। ওজন বৃদ্ধির জন্য বালি বা কাকর, ভালাে শস্যের সঙ্গে কীটপতঙ্গ আক্রান্ত শস্য মেশায় অনেক সময় খাদ্যশস্যের ওজন বাড়ানাের জন্যে কেউ কেউ তাতে পানি ছিটায়। ঘি-এর সঙ্গে পশুচর্বি দিয়ে ঘি-এর পরিমাণ বাড়ানাে হয়। তিল বা নারিকেল তেলের সাথে বাদাম তেল বা তুলাবীজের তেল মেশানাে হয়। সরিষার সঙ্গে প্রায়ই শিয়ালকাঁটার বীজ একত্রে মিশিয়ে তেল বের করা হয়। সয়াবিন তেলের সঙ্গে পামতেলের মিশ্রণ করা হয়। অনেক সময় দুধের মাখন তুলে নিয়ে অথবা দুধে পানি মিশিয়ে দুধ বিক্রি করা হয়। আবার মহিষের দুধ পানি দিয়ে পাতলা করে সহজেই গরুর দুধ বলে চালানাে হয়। গুঁড়ো দুধে ময়দা, সুজি ও অন্যান্য দ্রব্য মিশিয়ে পরিমাণ বাড়ানাে হয়। ব্যবহৃত চা পাতার সাথে কাঠের গুঁড়া মেশানাে হয়। মশলার মধ্যে মরিচ বা হলুদ গুঁড়াতে সীসা জাতীয় রঙাক পদার্থ মিশিয়ে রঙের উজ্জ্বলতা বাড়ানাে হয়। কোমল পানীয় তৈরিতে তরল গ্লুকোজ মেশানাে হয়। বিভিন্ন ফলের রসের নামে কৃত্রিম ও নিষিদ্ধ দ্রব্য ব্যবহার করে নকল রস তৈরি হয়ে থাকে। অধুনা মিনারেল ওয়াটারের নামে বাজারে যে পানি ব্যবসা চলছে তাতে বিশুদ্ধতা ও মানের নিশ্চয়তা অতি সামান্য, কোনাে কোনোে ক্ষেত্রে নেই বললেই চলে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ভেজাল নিরূপণের জন্য যে বিএসটিআই প্রতিষ্ঠান আমাদের দেশে রয়েছে কিংবা দুর্নীতি দমন কমিশন, সেখানেও অনিয়মে পরিপূর্ণ। ফলে খাদ্যদ্রব্যের ভেজাল থেকে সাধারণ মানুষের মুক্তি মিলবে কবে, সেটা আজ এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে।
ভেজালের ফল: আজকাল ব্যবসায় নিজ স্বার্থকে বড় হিসেবে বিবেচিত হয়, নীতিবােধের তােয়াক্কা করে না অধিকাংশ ব্যবসায়ী। শিশুর খাদ্যে ভেজাল মেশাতেও এ ব্যবসায়ী শ্রেণি পিছপা হয় না। রােগীর ওষুধে ভেজাল দিয়ে রােগীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় অবলীলায়। ভেজাল খাদ্য খেয়ে এ দেশের অনেক মানুষ মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে, তা অনেকবারই পত্রিকায় শিরােনাম হয়েছে; তথাপি কর্তৃপক্ষের টনক নড়েনি। ভেজাল খাদ্যের ভয়ানক পরিণাম হিসেবে অনেকেই চিরতরে অসুস্থ হয়ে গেছে। এ দেশে শিশুর দুধে নির্বিকারভাবে ব্যবসায়ী গােয়ালা থেকে বড় পুঁজিপতিরাও ভেজাল মেশাতে পারে। জনস্বাস্থ্যের কথা ভাবলে মুনাফাখখার লােভী এ ব্যবসায়ীদের হাত কাঁপত শিশুর খাদ্যে কিংবা রােগীর খাদ্যে ভেজাল মেশানাের সময়। এ ভেজাল খাদ্যদ্রব্য গ্রহণের ফলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জীবন হুমকির মধ্যে অবস্থান করছে। কাজেই জনস্বাস্থ্যের কথা ভেবে খাদ্যদ্রব্যকে ভেজালের কবল থেকে মুক্ত করতে প্রত্যেক মানুষকে সচেতন ভূমিকা পালন করতে হবে। ভেজাল খাদ্য খাওয়ার ফলে লিভারের সমস্যা, ডাইরিয়া, পেটের সমস্যা ইত্যাদি হয়ে থাকে।
ভেজালের প্রতিকার: ভেজালের কুফল মারাত্মক, এ নিয়ে সন্দেহ নেই। ভেজালের বিষক্রিয়া নানাভাবে আমাদের নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সাধারণ মানুষ নির্বিচারে ভেজাল খাদ্যদ্রব্য খেয়ে দিনাতিপাত করতে বাধ্য হচ্ছে। ভেজালের ফলে যেকোনাে সময় জাতীয় জীবন বিপর্যস্ত হতে বাধ্য। সম্প্রতি ভেজাল প্রতিরােধের লক্ষ্যে সরকার ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বিভিন্ন অভিযান শুরু করেছে। ইতােমধ্যে ঢাকাসহ সারাদেশে ভেজালবিরােধী অভিযানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও খাদ্য বিক্রেতাকে জরিমানা ও শাস্তি প্রদান করা হয়েছে। ভেজালের পরিধি যেভাবে বেড়ে চলেছে একে প্রতিরােধ করা যেন দুঃসাধ্য হয়ে পড়ছে। কিন্তু এ অবস্থায় নিশ্চুপ হয়ে বসে থাকলেও চলবে না। সমাজ তথা জাতিকে বাঁচাতে হলে এর প্রতিকার আবশ্যক। তাই ভেজালের প্রতিকারের লক্ষ্যে আন্দোলন গড়ে তােলা দরকার। প্রশাসনের ওপর এমনভাবে চাপ সৃষ্টি করতে হবে, যাতে প্রশাসক ভেজাল নিরােধক আইন আরও দৃঢ়ভাবে কার্যকর করতে বাধ্য হয়। খাদ্যনমুনা পরীক্ষা করার জন্যে প্রত্যেক জেলায় পরীক্ষাগার স্থাপন করা দরকার। তাছাড়া ভেজালদাতারা ধরা পড়লে তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। সর্বোপরি প্রশাসক এবং ক্রেতা ও বিক্রেতার সবার যৌথ প্রচেষ্টায় এ ভেজাল নিরােধ করা সম্ভব।
উপসংহার: অসাধু ব্যবসায়ীদের ফাঁদে পড়ে কত জীবন শেষ হয়ে যাচ্ছে তার ইয়ত্তা নেই। বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষ খাদ্য-পানীয়- ওষুধে ভেজাল খেয়ে প্রতিদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছে। ভেজালের সর্বনাশা বিভীষিকা থেকে কী মানুষের মুক্তি নেই? মানুষের শুভবুদ্ধি কি, এভাবে অন্ধকারেই আচ্ছন্ন থাকবে? ভেজাল এক ধরনের সামাজিক অপরাধ। অতএব, যেকোনাে মূল্যের জনস্বাস্থ্য সংরক্ষণে ভেজাল খাদ্যদ্রব্যের বিপণন রােধ করতে হবে। মানুষের ভেতরে শুভবােধের জাগরণ ভিন্ন সেটি সম্ভব নয়। সরকারী ও বেসরকারীভাবে খাদ্যে ভেজাল এর কুফল সম্পর্কে সমাজের সকল মানুষকে সচেতন করতে হবে।
Post a Comment