মানবকল্যাণে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি
বা, মানবকল্যাণে বিজ্ঞানের অবদান
বা, বিজ্ঞান ও আধুনিক সভ্যতা
বা, সাম্প্রতিক বিজ্ঞান
বা, বিজ্ঞানের জয়যাত্রা
বা, বিজ্ঞান ও তথ্যপ্রযুক্তি
ভূমিকা : বর্তমান যুগ বিজ্ঞানের যুগ। বিজ্ঞান ছাড়া এ যুগের সভ্যতা অচল। এ যুগের প্রতি মুহূর্তে ও প্রতি পদক্ষেপে বিজ্ঞানের কাছ থেকে রসদ আহরণ করে জীবনধারণ করছে। বিজ্ঞানকে বাদ দিয়ে তার অস্তিত্বই যেন কল্পনা করা যায় না। তাই দৈনন্দিন জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে দেখা দিয়েছে স্বাচ্ছন্দ্য। বিজ্ঞান দিয়েছে মানুষকে বিশ্লেষণী বুদ্ধি পর্যবেক্ষণ করার প্রবৃত্তি।
প্রতি পদক্ষেপে বিজ্ঞান- শক্তির উপর নির্ভরশীল : প্রাত্যহিক জীবনে প্রায় প্রতি পদক্ষেপেই বিজ্ঞান শক্তির উপর আমরা নির্ভরশীল। ঘুম থেকে উঠা অবধি এ নির্ভরশীলতার সূত্রপাত। টুথপেস্ট বা টুথ পাউডার না হলে দাঁত পরিষ্কার করা চলে না। এরপর আসে সংবাদপত্রের কথা। শিক্ষিত মানুষের যত কমই আর্থিক সঙ্গতি থাক না কেন, দিনে একবার সংবাদপত্রের উপর ঝুঁকে পড়েন নিশ্চয়। মােট কথা প্রভাতী চা পান থেকে অফিস গমন ও অফিস হতে প্রত্যাবর্তন এবং রাত্রির নিদ্রাগমনের পূর্ব পর্যন্ত সব বিষয়ে স্বাচ্ছন্দ্য দান করে এ বিজ্ঞান। সকালে স্টোভের শব্দে ঘুম ভাঙ্গা, রাতে রেডিও টিভির বিদায়ী সঙ্গীতে ঘুমিয়ে পড়া, এ সব কিছুই বিজ্ঞানের দান। চিত্তবিনােদনের উপকরণ, যানবাহনের আরাম ও স্বাচ্ছন্দ্য বন্ধনের সু-সহায়ক উপকরণ, বিভিন্ন নিত্য প্রয়ােজনীয় বিলাসদ্রব্য প্রভৃতি দৈনন্দিন জীবনের পক্ষে যা কিছু প্রয়োজনীয়, তার উপরই বিজ্ঞানের বিপুল হাত প্রসারিত। বিজলী পাখা, বিজলী বাতি, ট্রাম,কার, মােটরগাড়ী, রেলগাড়ি, স্টীমার, উড়ােজাহাজ, কমপিউটার, রােবট, রকেট, অফিসের লিফট, গৃহের স্টোভ, গ্যাস ও হিটার চুল্লী, ইস্রি, রেফ্রিজারেটর, কুকিং রেঞ্জ, প্রেসার কুকার, ফাউন্টেনপেন, টর্চ, রাসায়নিক সার ও কীটনাশক প্রভৃতি সবকিছুই বিজ্ঞানের দান।
দৈনন্দিন যােগাযােগ রক্ষায় বিজ্ঞানের দান : যাত্রী ও সংবাদ বহন করে বিমান উড়ে যায় শূন্যমার্গে, সমুদ্র পাড়ি দেয় জলযান, শত শত মাইল দূরদূরান্ত হতে প্রিয়জনের সংবাদ বহন করে আনে টেলিগ্রাম, টেলিফোন, বেতার ও টেলিভিশন। অনেক মনীষির শিক্ষা, উপদেশ ও বাণী রােটারী মেশিনে মুদ্রিত হয়ে প্রাত্যহিক সংবাদ বহন করে দৈনিক সংবাদপত্র।
কৃষি উন্নয়নে বিজ্ঞানের দান : বিজ্ঞান কৃষি উন্নয়নে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে চাষাবাদ, চাষাবাদে সহায়ক রাসায়নিক সার, কীটনাশক ওষুধ, বিদ্যুৎচালিত পাম্প, ডিপ টিউবওয়েল, ট্রাক্টর, সিড্রিল, থ্রেচার, ধানমাড়াই প্রভৃতি সব কিছুই বিজ্ঞানের অবদান। শুধু তাই নয় বিজ্ঞান শক্তির ফলে দূরের খাদ্য সম্ভারও আজ তড়িৎ গতিতে আসে বন্যার্ত ও দুর্ভিক্ষক্লিষ্ট মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে ।
চিকিৎসা শাস্ত্রে বিজ্ঞানের দান : আজ বিজ্ঞানের আশীর্বাদে দুরারোগ্য ব্যাধিও সম্পূর্ণ রূপে নিরাময়িত। আশ্চর্য সব ওষুধ আবিষ্কারের ফলে সমাজের লক্ষ লক্ষ রুগ্ন মানুষ আজ নতুন আশার আলােকে সঞ্জীবিত। স্ট্রেপ্টোমাইসিন, পেনিসিলিন , এন্টিবায়ােটিক, অ্যালট্রাভাইওলেট রে, এক্স-রে রেডিয়াম, থেরাপি, আর্থোপেডিক্স প্রভৃতি আজ চিকিৎসা জগতে এক যুগান্তর সৃষ্টি করেছে।
সার্বিক জীবন ব্যবস্থায় বিজ্ঞানের দান : বিজ্ঞান মৃত্যু পথযাত্রীকে দান করেছে নিশ্চিত বিশ্বাস; চিত্তে তার জাগিয়েছে অফুরন্ত আশ্বাস। লেখার লেখনী ও কাগজ, জ্ঞান আহরণের সংবাদপত্র ও পুস্তকরাজী এ বিজ্ঞানেরই অবদান। নির্জন পল্লীর বুকে নির্ভয়ে অন্ধকার পথ চলতে টর্চলাইট হতে শুরু করে সভ্য জগতের আরামময় জীবনযাত্রার পক্ষে যা কিছু প্রয়ােজন, সে সমস্ত কিছুই আজ বিজ্ঞানের প্রভূত উন্নতির ফল। নগরের জল সরবরাহের টেপ, রান্নাবান্নার গ্যাস লাইন, গ্যাস পাইপ, বৈদ্যুতিক বাতি, হিটার, ফ্যান, চুল্লী এ সবকিছুই বিজ্ঞানের আলােক মালায় উদ্ভাসিত, সম্প্রসারিত। বিজ্ঞান শুধু দৈহিক স্বাচ্ছন্দ্য আনে নি, মানসিক উৎকর্ষও এনেছে। বিজ্ঞান শুধু যে মানুষের প্রাত্যহিক জীবনধারাকে সুন্দর ও মইীয়ান করে ধ্যও নৈকট্য সাধন করে তুলেছে তা নয়, সে আবার বিশ্ব মানবের মধ্যেও নৈকট্য সাধন করে সকলকে আপন করে নিচ্ছে।
বিজ্ঞানের অভিশাপ : দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের প্রভাব মানুষের শুধু যে কল্যাণ করছে তা নয়, অনেক ক্ষেত্রে তা অকল্যাণকেও ডেকে এনেছে। যন্ত্রের উপর অতিরিক্ত নির্ভর করতে গিয়ে মানুষ ক্রমশ হয়ে উঠেছে পরিশ্রমবিমুখ। সে মানসিক পরিশ্রম যে পরিমাণে করছে শারীরিক পরিশ্রম করছে সে তুলনায় অনেক কম। ফলে, জীবনে নতুন কিছু রােগ ও উপসর্গ দেখা দিচ্ছে, তার জীবনে কৃত্রিমতা ঘনীভূত হচ্ছে। সমাজের বাইরের জৌলুস বাড়ছে ক্রমশ; কিন্তু সে অনুপাতে স্নেহ প্রেম মায়া মমতা ইত্যাদি মানুষের সদগুণগুলাের বিকাশ ঘটছে না। মানুষে মানুষে প্রকৃতিতে বিভেদ বাড়ছে এবং বিজ্ঞানের উপর নির্ভর করতে গিয়ে মানুষ যান্ত্রিক হয়ে উঠেছে। বিজ্ঞান সভ্যতার এ আগ্রাসী প্রভাব থেকে মানুষকে মুক্ত করতে না পারলে অদূর ভবিষ্যতে তার সুখ শান্তির আশা অতি সামান্যই। গভীরভাবে চিন্তা করলে দেখা যায় যে, মানুষের অন্তরস্থিত, বুভূক্ষিত হৃদয়হীন দানবই এ নিদারুণ অভিশাপের কারণ।
উপসংহার : দৈনন্দিন জীবনে বিজ্ঞানের প্রভাবকে বিশ্বময় সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে না পারলে আমাদের মুক্তি নেই। কেননা, বিজ্ঞানের ধর্ম নিষ্কাম ধর্ম, উচুনিচু নির্বিশেষে সকল শ্রেণী মানুষের কল্যাণ ধর্ম। বিজ্ঞানের শক্তিকে আমরা যদি সুপথে পরিচালিত করি অর্থাৎ, মরণাস্ত্র না গণে পারমাণবিক শক্তিকে যদি গঠনমূলক কাজে প্রয়ােগ করি তবে পৃথিবীর অশেষ কল্যাণ হতে পারে।
Post a Comment