বা দেশ প্রেমিক ও উন্নয়ন
বা দেশ প্রেম ও বাংলাদেশ
ভূমিকা : স্বদেশ মানুষের নিকট পরম সাধনার ধন, কামনার অক্ষয় স্বর্গ। ষদেশের মানুষ, স্বদেশের রূপ প্রকৃতি, তার পশু পাখি, এমনকি তার প্রতিটি ধূলিকণা তার কাছে প্রিয় ও পবিত্র। যে দেশ আলাে দিল, বাতাস দিল, মুখে দিল অন্ন জল, দিল পরণের বস্ত্র, তার প্রতি যদি সে শ্যামল স্নেহে প্রতিপালিত সন্তানদের মমতা মণ্ডিত আনুগত্যবােধ না থাকে, তবে তারা কেবল অকৃতজ্ঞ নয়, অধন্য অধমও বটে। স্বদেশের কাছে মানুষ সকল দিক দিয়ে ঋণী। স্বদেশ প্রীতি সে ঋণ স্বীকার ও ঋণ শােধের উপায় মাত্র। রাসুলুল্লাহ (স) বলেছেন, স্বদেশ প্রেম ঈমানের অংশবিশেষ। স্বদেশ প্রেম কি : যে ভৌগােলিক ও সামাজিক পরিবেশের মধ্যে মানুষ জন্ম গ্রহণ করে ও বড় হয়ে উঠে, সে পরিবেশের প্রতি, সেখানকার মানুষের প্রতি, তার একটি স্বাভাবিক অন্তর আকর্ষণ গড়ে উঠে। তাই আবেগ বিহ্বল কণ্ঠে সে গাইতে ভালােবাসে সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি। স্বদেশের পশুপাখি, তরুলতা হতে আরম্ভ করে ধূলিকণা পর্যন্ত তার কাছে পরম পবিত্র। স্বদেশ প্রেমিক কবি গেয়েছেন- 'আমার এ দেশেতেই জন্ম, যেন এ দেশেতেই মরি।' দেশের প্রতি এ আজনম আকর্ষণ হতেই স্বদেশ প্রেমের উন্মেষ।
স্বদেশ প্রেমের বহিঃপ্রকাশ : স্বদেশ প্রেম সকলের অন্তরেই থাকে। কখনও তা সুপ্ত অবস্থায়, কখনও থাকে জাগ্রত। ঐক্যবদ্ধভাবে যখন দেশের সকল মানুষ একই প্রকার জীবন ধারায়, একই ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির ধারায় পুষ্ট হয়ে একই আদর্শের অনুপ্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠে, তখনই মৃন্ময়ী দেশ চিন্ময়ী হয়ে উঠে। ফুল ও ফসলের কাদামাটি জলে দেশ তখন মাতৃভূমি হয়ে উঠে। সকলে জননী জন্মভূমিকে ‘স্বর্গাদপি গরীয়সি’ মনে করে পূজা করে; সুজলা, সুফলা, শীতলা, শস্য শ্যামলা দেশ তখন মাতৃরূপে স্বদেশ প্রেমিকের মনশ্চক্ষে আবির্ভূত হন। সুখের দিনে স্বদেশপ্রেম থাকে সুপ্তি মগ্ন। কিন্তু দুঃখের দিনে আঘাতে আঘাতে জর্জরিত হয়ে স্বদেশ প্রেম উদ্দীপিত হয়ে উঠে। পরাধীনতার দুঃখ বেদনায়, পরদেশীর অকথ্য নির্যাতনে সুপ্ত স্বদেশ প্রেমের ঘুম ভাঙ্গে। কিংবা দেশ যখন বিদেশী শত্রুর আক্রমণে পর্যুদস্ত হয়,তখন সমগ্র জাতি স্বদেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বদেশের ও স্বজাতির মানমর্যাদা রক্ষা কল্পে রণক্ষেত্রে প্রাণ বিসর্জন দেবার জন্যে দলে দলে ছুটে যায়। তখন মনে হয়, নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান, ক্ষয় নাই, তার ক্ষয় নাই। '
স্বদেশ প্রেমের প্রকৃত স্বরূপ : প্রকৃতপক্ষে, দেশপ্রেমের উদ্ভব আত্মসম্মানবােধ হতে। যে জাতির আত্মসম্মান বােধ যত প্রখর সে জাতির স্বদেশ প্রেম তত প্রবল। স্বদেশ প্রেম এক প্রকার পরিশুদ্ধ ভাবাবেগ। নিঃস্বার্থ হিংসাবিহীন দেশপ্রেমই প্রকৃত স্বদেশ প্রেম। ব্যক্তিগত ক্ষুদ্র স্বার্থের গণ্ডী অতিক্রম করে বৃহত্তম স্বার্থের দিকে তখন মন পরিচালিত হয় যখন আত্মকল্যাণ হতে বৃহত্তর কল্যাণবােধ সক্রিয় হয়ে উঠে, তখন জ্বলে উঠে স্বদেশ প্রেমের নিষ্কলুষ প্রদীপ শিখা। স্বদেশের মানমর্যাদা, তার গৌরব, খ্যাতি, রক্ষা কল্পে কত অমর প্রাণ শহীদ হয়েছে। স্বদেশ প্রেমিকের দেশ সেবার পথে বাধা অনেক, অত্যাচার সীমাহীন। কিন্তু পথের ঝড়ঝঞা, বজ্রপাত তাদের দৃঢ় বলিষ্ঠ পদক্ষেপের কাছে মিথ্যা প্রমাণিত হয়ে যায়। পরদেশী শাসকের রক্ত চক্ষু কিংবা উদ্যত অস্ত্র তাদের নিবৃত্ত করতে পারে না।
স্বদেশ ও বিশ্ব প্রেমের সম্পর্ক : জাতীয়তা যখন সংকীর্ণতার অন্ধ কূপে বন্দী হয়ে উগ্র ছিন্নমস্তা রূপ ধারণ করে, তখন প্রেম পদদলিত হয়। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে উগ্র জাতীয়তাবাদে কল্যাণ নেই। তাই রবীন্দ্রনাথ গাইলেন-
" ও আমার দেশের মাটি, 'তােমার পরে ঠেকাই মাথা'
তােমাতে বিশ্বময়ীর- তােমাতে বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা।"
দেশ জননী, বিশ্ব জননী এক এবং অভিন্ন। কারণ, দেশ জননীর বক্ষের উপর বিশ্ব জননীরও আর্চল পাতা। ষদেশ ও বিশ্ব আমাদের ঐক্য চেতনার এপিঠ আর ওপিঠ।
দেশপ্রেম ও বাংলাদেশ : বাংলাদেশ আজ একটি স্বাধীন দেশ। তাই, এদেশকে বিশ্ব সভায় মাথা তুলে দাড়াতে হলে দেশ গঠনের কাজে সকলকে উদ্বুদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। নব নব জাগরণের মাধ্যমে দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক অগ্রগতির ধারা বজায় রাখতে হবে। শুভ চিন্তা ও আদর্শ ত্যাগের মাধ্যমেই কেবল আমরা স্বদেশপ্রেমের দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারি।
উপসংহার : স্বদেশপ্রেম মানবজীবনের অন্যতম মহৎ চেতনা। এ চেতনায় মানুষকে স্বার্থপরতা, সম্প্রদায় ও জাতিগােষ্ঠীগত সংকীর্ণতা, রাজনৈতক মতাদর্শগত ভেদাভেদ হতে উর্ধ্বে উঠতে সাহায্য করে। উদ্বুদ্ধ করে দেশের কল্যাণে ষবার্থ ত্যাগে আত্মনিবেদন। তাই ক্ষমতার লােভ ও দলীয় স্বার্থচিন্তাবাদী কখনও সত্যিকারের দেশপ্রেমিক হতে পারে না।
Post a Comment