SkyIsTheLimit
Bookmark

রচনা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস

আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য 
বা ২১শে ফেব্রুয়ারির নব উন্মােচন
বা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি ও মাতৃভাষা
বা মাতৃভাষা দিবস
ভূমিকা : জাতীয়তার প্রধান উপাদান মাতৃভাষা। জার্মান দার্শনিক ফিকট জাতি গঠনের ক্ষেত্রে ভাষার ভূমিকাকে সর্বাধিক গুরুত্ব প্রদান করেছেন। আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। এ ভাষায় কথা বলার স্বাধীনতার জন্য আমাদের বহু সংগ্রাম এবং জীবন দিতে হয়েছে। ভাষার জন্য আমাদের প্রথম রক্ত দিতে হয়েছে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে। ১৯৯৯ সালের নভেম্বরে ইউনেস্কোর সাধারণ পরিষদে মহান ভাষাদিবস একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস ঘােষণা করায় বাংলা ভাষা আজ মর্যাদার আসনে সুপ্রতিষ্ঠা লাভ করেছে।
পটভূমি : পৃথিবীতে বাংলাদেশই একমাত্র দেশ যে তার মাতৃভাষা রক্ষার জন্য প্রাণ দিয়েছে। তাই আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটকে বেছে নেওয়া যথেষ্ট যুক্তিসঙ্গত। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান স্বাধীনতা লাভ করে। স্বাধীনতার পর পরই পাকিস্তান সরকার উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার উদ্যোগ নেয়। ২৪ জুলাই ১৯৪৭ দৈনিক আজাদ পত্রিকায় ভাষা সমস্যা নিয়ে এক প্রবন্ধে ডঃ মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ লিখেছিলেন যে, বিদেশী ভাষা হিসেবে যদি ইংরেজি ভাষা পরিত্যাজ্য হয় তাহলে বাংলা হতে হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। দ্বিতীয় কোন ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে উর্দুকে বিবেচনা করা যেতে পারে না। ১৯৪৭ সালে এক সম্মেলনে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব গৃহীত হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১১ মার্চ ১৯৪৮ সালে পূর্ব বাংলায় ভাষার দাবিতে প্রথম বিক্ষোভ প্রদর্শিত হয়। এতে শেখ মুজিব গ্রেফতার হয়। ১৯৫২ -এর ২১ ফেব্রুয়ারির পূর্ব পর্যন্ত এই ১১ মার্চকে "ভাষা দিবস হিসেবে পালন করা হতো। ২১শে মার্চ ১৯৪৮ সালে রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানের গভর্ণর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘােষণা করেন। সাথে সাথে প্রতিবাদ হয়। ২৪শে মার্চ ১৯৪৮ সালে কার্জন হলে তিনি ঘােষণা করেন যে, পাকিস্তানে শিক্ষার মাধ্যম হতে হবে উর্দু। "তখন থেকেই শুরু হয় এর প্রতিবাদে আন্দোলন। তারই প্রেক্ষাপটে মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিকে ভাষা দিবস পালনের সিদ্ধান্ত নেয়। কারণ, ঐ দিন ঢাকায় আইন পরিষদের বাজেট অধিবেশন শুরু হবে। কিন্তু ২০ ফেব্রুয়ারি সমগ্র ঢাকায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় জনাব গাজীউল হকের নেতৃত্বে সভা শুরু হয়। আব্দুস সামাদ আজাদ এর নেতৃত্বে “৪ জনী মিছিল” হয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিলে মিছিলে একাকার হয়ে গেলে পুলিশ গুলি চালায়। এতে ছালাম, রফিক, জব্বার, বরকত, শফিউর সহ আরও অনেকে শহীদ হন। তাদের ত্যাগ আর আত্মাহুতির মাধ্যমেই আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে রক্ষা করতে পেরেছি। তাই আজ বিশ্ববাসী জানাচ্ছে তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা।
স্বীকৃতির উদ্যোক্তা : কানাডার প্রবাসী বাঙালিদের সংগঠন "মাদার ল্যাঙ্গােয়েজ অব দ্য ওয়ার্ল্ড সর্বপ্রথম এ ধরনের একটি উদ্যোগ গ্রহণ করে। কিন্তু জাতিসংঘের পরামর্শ মতে পরে তারা বাংলাদেশ শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে এ ধরনের উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য অনুরােধ করে। পরবর্তী সময়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার অনুমােদন পাওয়ার পর ৯ সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব ইউনেস্কোর সদর দপ্তরে পাঠানাে হয়। ২৮ অক্টোবর ১৯৯৯ আমাদের শিক্ষামন্ত্রী প্যারিসে ইউনেস্কোর সাধারণ অধিবেশনে একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ঘােষণার প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন। এ প্রস্তাবের পক্ষে আরও ২৭টি দেশ সমর্থন দেয়। ১৭ নভেম্বর ১৯৯৯ ইউনেস্কোর ৩১তম সম্মেলনে “একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের স্বীকৃতি পায়।
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস : প্রতি বছর ২১শে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হবে। ১৭ নভেম্বর ১৯১৯ জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সাংস্কৃতিক সংস্থা ইউনেস্কোর (UNESCO) ৩১তম সম্মেলনে বাংলাদেশের মহান একুশে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালনের স্বীকৃতি পাস হয়। বিশ্বের ১৮৮টি দেশে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি আমাদের মহান ভাষা আন্দোলনে আত্মােৎসর্গকারীদের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে অমর একুশে ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে পালিত হবে। যার মধ্যদিয়ে বিশ্বের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতি ও দেশসহ সকল জাতিই তার মাতৃভাষাকে রক্ষার ও তার ঐতিহ্য বহন করার দৃঢ় শপথে উদ্দীপ্ত হবে। 
আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস-এর তাৎপর্য : সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সংরক্ষণে ভাষা হচ্ছে সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। মাতৃভাষার প্রচলন কেবল ভাষাগত বৈচিত্র্য ও বহু ভাষাভিত্তিক শিক্ষাকেই উৎসাহিত করবে না। তা ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের উন্নয়ন ও অনুধাবনের ক্ষেত্রে অবদান রাখবে। পারস্পরিক বােঝাপড়া, সহনশীলতা ও সংলাপের উপর ভিত্তি করে বিশ্বসংহতি আরও জোরদার হবে। তাই "আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস মাতৃভাষার উন্নয়ন ও বিস্তারে সবচেয়ে কার্যকর ভূমিকা রাখবে। এ পৃথিবীর সকল ক্ষুদ্র জাতি ও তাদের ভাষাগােষ্ঠীকে আরও সমৃদ্ধ ও শক্তিশালী হতে উদ্বুদ্ধ করবে। বিশ্বের ১৮৮টি দেশের মানুষ মে দিবসের মত আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালনের মাধ্যমে, মাতৃভাষার জন্য বাঙালির আত্মবলিদানের কথা জানবে এবং শ্রদ্ধা জানাবে। বাঙালি জাতি হিসেবে আমরা পরিচিত হব আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে, হব গর্বিত। বাংলা ভাষার জন্য শহীদের আত্মাহুতি সত্যিই আজ সার্থক হয়েছে। 
প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উদযাপন : আমাদের প্রাণের ভাষা, হৃদয়ের ভাষা বাংলার জন্য যারা জীবন বিসর্জন দিয়েছেন, বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে মাতৃভাষার মর্যাদার জন্য লড়াই করেছেন, প্রতিবাদ করেছে। প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি আমরা তাদের আত্মার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে শহীদের বেদিতে শ্রদ্ধাভরে ফুল অর্পণ করি। আর ২০০০ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি প্রথম আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হওয়ায় এতে আরেক নতুন মাত্রা যােগ হয়েছে।। হূদয়ের সকল আকুতি পবিত্রতা ও শুভ্রতা দিয়ে শহীদের বেদিতে ফুল দিয়ে আমরা উদযাপন করেছি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। আমাদের মত পৃথিবীর ১৮৮টি দেশেও মে দিবসের মত উদ্যাপিত হয়েছে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’। তারা জেনেছে আমাদের গৌরব গাথা ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলনকে তারা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করেছে ভাষা শহীদদেরকে। হৃদয়ের সমস্ত শুভ্রতা উৎসারিত করে তারা শ্রদ্ধা জানিয়েছে শহীদের আত্মাহুতিকে তথা বাঙালি জাতিকে। এর চেয়ে বড় পাওয়া, বড় চাওয়া আর কি আছে আমাদের? সত্যিই আমরা গর্বিত জাতি। আমরা গর্বিত আমাদের মাতৃভাষার জন্য। মাতৃভাষা বিশ্বে আমাদের সম্মানজনক নে পৌছে দিয়েছে আর সার্থক হয়েছে শহীদের রক্তদান। আজ বিশ্ব দরবারে শত সহস্র প্রাণে বেঁজে উঠবে, 
"আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানাে একুশে ফেব্রুয়ারি 
আমি কি ভুলিতে পারি?" 
উপসংহার : বাংলা ভাষার অধিকার সংরক্ষণের জন্য ১৯৫২ সালে বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়েছিল অজস্ তাজা প্রাণ। আত্মাহুতি দিয়েছিল অসংখ্য তরুণ। তাদের আত্মত্যাগ আজ আন্তর্জাতিক পরিসরে মর্যাদা লাভ করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষ তাদের আত্মত্যাগকে স্মরণ করবে প্রতিবছর ২১ ফেব্রুয়ারি। বাঙালির গৌরবদীপ্ত জীবন গাঁথা বিশ্ববাসী শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। এজন্য আমাদের জাতীয় জীবনেও বাংলা ভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করে এ ভাষার উন্নতি ও সমৃদ্ধি ত্বরান্বিত করতে হবে। মহান ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশের ইতিহাসে চিহ্নিত হয়েছে আপােষহীন সংগ্রাম ও জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment