SkyIsTheLimit
Bookmark

রচনা পরিবেশ সুরক্ষায় ছাদ কৃষির ভূমিকা

ভূমিকা: বর্তমানে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহরে বাড়ির ছাদে বাগান করা বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অধিকাংশ বাড়ির ছাদের দিকে তাকালেই বিভিন্ন ধরনের বাগান দেখা যায়। শহরের নাগরিকরা ছাদ কৃষির দিকে প্রতিনিয়ত ঝুঁকছে। ইট-বালিতে গড়ে ওঠা সভ্যতার শহরগুলাে থেকে দ্রুতই হারিয়ে যাচ্ছে সবুজ। কিন্তু মানুষ তার শিকড়কে সহজে ভুলতে পারে না। সবুজে ভরা গ্রাম বাংলায় বেড়ে উঠা নাগরিক সমাজের একটা অংশ সবুজকে ধরে রাখতে চায় তাদের আবাসস্থলে। শৌখিন মানুষরা তাদের ঘরবাড়িতে সবুজকে ধরে রাখার জন্য একান্ত নিজস্ব ভাবনা আর প্রচেষ্টায় আপন আপন বাড়ির ছাদে তৈরি করছে ছাদ বা বাগান কৃষি সময়ের সাথে এ বাগান এখন আর শৌখিনতায় আটকে নেই, সবজি দিয়ে পারিবারিক পুষ্টির চাহিদাপূরণ, অবসর কাটানাের এক মিলনমেলায় পরিণত হয়েছে এ ছাদ বাগানগুলাে। আর এই ছাদ কৃষি পরিবেশ সুরক্ষায় রাখছে গুরুত্বপূর্ণ অবদান।
ছাদকৃষির পরিচয়: ছাদ বাগানকে কেতাবি ভাষায় যেমন কোনাে সংজ্ঞায় নির্ধারিত করা যায়নি তেমনি এর কোনাে সুনির্দিষ্ট মডেল এদেশে এখন পর্যন্ত গড়ে উঠেনি। পাকা বাড়ির খালি ছাদে অথবা বেলকনিতে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে ফুল, ফল, শাকসবজির বাগান গড়ে তােলাকে ছাদ কৃষি বলা যেতে পারে। বাড়ির মালিক তাদের আপন আপন উদ্দেশ্যকে মাথায় রেখে আপন ভাবনায় সাজিয়ে তুলেন তাদের ছাদকে। এখানে টবে, বড় বড় ড্রাম কিংবা ট্রেতে রােপণ করা হয় নানা ফুল, ফল ও সবজি। কেউ কেউ আবার ছাদে স্থায়ী কাঠামাে নির্মাণ করে তাতে গাছ রােপণ করেন। ছাদের আকার ও সহনশীলতার দিকে লক্ষ্য রেখে নানা কাঠামাের ওপর স্থাপন করেন টব, মাচা। তবে এলােমেলাে ও অপরিকল্পিত ছাদ বাগান কেবল সময়, অর্থ অপচয় করায় না। সেই সাথে ভবনেরও নানা ক্ষতি করে। তাই কিছু মৌলিক বিষয়ের প্রতি লক্ষ্য রেখে ছাদ বাগান গড়ে তােলা প্রয়ােজন।
ছাদকৃষির ইতিহাস: ছাদে বাগান বা কৃষি কোনাে নতুন ধারণা নয়। অতি প্রাচীন সভ্যতায়ও ছাদে বাগানের ইতিহাস চোখে পড়ে। খ্রিস্টের জন্মেরও পূর্বে মেসােপটিয়াম ও পারস্যের জুকুরাক নামীয় পিরামিড আকৃতির উঁচু পাথরের স্থাপনায় বাগান ও ছােট গাছ লাগানাের জন্য স্থান নির্ধারণ করার নিদর্শন পাওয়া যায়। পম্পেই নগরীর কাছেই প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন রােমান ভিলায় কেবল একটি নির্দিষ্ট ছাদ তৈরিই করা হয়েছিল বাগান করার জন্য। এগারাে শতকে পুরনাে কায়রাে শহরে বহুতল ভবন নির্মাণ হয় যার কোনােটি কোনােটি ছিল চৌদ্দতলা পর্যন্ত বিস্তৃত। এ ভবনগুলোর সবগুলোর ছাদে বাগান স্থাপন করা হয়েছিল সৌন্দর্যের অংশ হিসেবে। আর এই ছাদের বাগানে সেচ দেয়ার জন্য প্রাণী শক্তির সাহায্যে চাকা ঘুরিয়ে পুলি দিয়ে নিচ থেকে ওপরে পানি তােলা হতাে। ব্যাবিলনের ঝুলন্ত উদ্যানও ধারণা করা হয় বিভিন্ন ছাদ ও বারান্দার সমন্বয়ে তৈরি তবে ঐতিহাসিকভাবে এ উদ্যানের কোনাে অস্তিত্ব পাওয়া না গেলেও তৎকালে বর্তমানে ইরাকের মসুল শহরের কাছেই আরেক ঝুলন্ত উদ্যানের নিদর্শন পাওয়া যায়। 
ছাদকৃষির পদ্ধতি: ছাদ কৃষি করার সময় প্রথমেই ছাদের আয়তন অনুসারে কাগজে কলমে খসড়া ম্যাপ করে বিভিন্ন স্থাপনা ও ভবনের কলামগুলাে চিহ্নিত করে নিতে হবে। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কারণ চাহিদা ও রুচি অনুসারে সাজানাে না হলে এর পুনর্বিন্যাস অত্যন্ত শ্রম সাধ্য একটি কাজ। বড় বা ভারি গাছগুলাে ছাদের বিম বা কলামের নিকটবর্তী স্থান বরাবর স্থাপন করতে হবে। ছাদ যেন ড্যাম্প বা স্যাতসেঁতে হতে না পারে সে জন্য রিং বা ইটের ওপর ড্রাম অথবা টবগুলাে স্থাপন করলে নিচ দিয়ে আলাে বাতাস চলাচল করবে এবং ছাদও ড্যাম্প হতে রক্ষা পাবে। নেট ফিনিশিংয়ের মাধ্যমেও ছাদকে ড্যাম্প প্রতিরােধ করা যায়। চাহিদা অনুসারে হাফ ড্রাম, সিমেন্ট বা মাটির টব, স্টিল বা প্লাস্টিক ট্রে সংগ্রহ করতে হবে। অনেক সময় বসতবাড়ির ভাঙা বালতি, অব্যবহৃত তেলের বােতলও ছােটখাটো গাছ রােপণের জন্য ব্যবহার করা হয়। ঠিকমতাে উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে এসব অব্যবহৃত জিনিস বাগানে ব্যবহার করা যায়। ছাদের সুবিধা মতাে স্থানে স্থায়ী বেড (ছাদ ও বেড়ে মাঝে ফাঁকা রাখতে হবে) স্থাপন করা যেতে পারে। এসব বেডে মূলত সবজি, শাক চাষ করা যায়, ফুলগাছ লাগানাে যায়। স্থায়ী বেড বানাতে না চাইলে পুরনাে চৌবাচ্চা বা জাহাজের লাইফ বােট রাখার বয়ার খােলও অনেক জায়গায় বেড হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
মানবমনে ছাদকৃষির প্রভাব: ছাদ কৃষি আমাদের প্রকৃতির সাথে সংযােগ হবার একটি সুযােগ করে দিচ্ছে। দীর্ঘ সময় ধরে বন-জঙ্গলে ঘুরে বেড়ানাে মানুষের সভ্যতায় থিতু হওয়ার সময় মহাকালের হিসেবে অতি নগন্য। পরিবেশের সাথে দীর্ঘদিন ধরে বসবাস করা মানুষের কিছু অভিযােজিত ক্ষমতা এখনও আমাদের মাঝে বিরাজমান। যে কোনাে রঙের তুলনায় আমাদের চোখে সবুজ রঙের পার্থক্যটা বেশি ধরার কারণও এই অভিযােজনের ফলাফল বলে অনেকেই ধারণা করেন। তাই নানা প্রকার সবুজের সমারােহ দেখে আমরা প্রফুল্ল হয়ে উঠি। অসংখ্য শেডের সবুজ রঙ আমাদের একঘেয়েমিতে আক্রান্ত করে না, করে উৎফুল্ল। যান্ত্রিক জীবনে ছাদ কৃষির ছােট সবুজ উদ্যান আমাদের সতেজ রাখতে সহায়তা করে। গড়ে তােলে নির্মল পরিবেশ। এভাবেই ছাদকৃষি মানব মনকে প্রভাবিত করে। 
পরিবেশ সুরক্ষায় ছাদকৃষি: পরিবেশ রক্ষা আর নগরের তাপমাত্রা কমিয়ে আনতে অনেক দেশেই বাড়ির ছাদ, বারান্দা, গাড়ি-বারান্দা, ফুটপাত, পার্ক, সরকারি খাস ভূমি, বজ্য ব্যবস্থাপনার প্রতিটি পর্যায়ে কৃষি উৎপাদন বিশেষ করে উদ্যান ফসল ও বাহারি ফুলের গাছের সমন্বয়ে তৈরি করা হচ্ছে সবুজ নগরায়ন। আমাদের দেশেও হাঁটি হাটি পা পা করে ছাদ কৃষির মাধ্যমে ব্যক্তি পর্যায়ে শহরে সবুজায়ন শুরু হয়েছে। প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নয় বরং একান্ত ব্যক্তিগত উদ্যোগেই এদেশে ছাদ কৃষির সূচনা। শহরে ছাদ বাগান স্থাপন করা হলে শহরের তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি পর্যন্ত কমে আসে। আমাদের শহরগুলােতে মাটির অস্তিত্ব দিন দিন কমে আসছে। ইট-বালি ভবনের বদলে দুতই বৃদ্ধি পাচ্ছে ইস্পাতের কাঠামাে ও কাচে মােড়ানা বহুতল ভবন। বিশেষ করে জানালায় কাঁচ ও বাণিজ্যিক ভবনের টেকসই স্থাপনার জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে হালকা কিন্তু শক্তিশালী ধাতব পাত, ফাইবার ও গ্লাস। সূর্য থেকে তাপ ও আলাে এ ধাতব ও কাঁচের কাঠামাের একটিতে পড়ে অপরটিতে প্রতিফলিত হয়। বারংবার প্রতিফলনের দরুন সে নির্দিষ্ট এলাকার তাপমাত্রা আশপাশের এলাকার তুলনায় সামান্য বেড়ে যায় এবং শহরজুড়ে তৈরি হয় অসংখ্য হিট আইল্যান্ড বা তাপ দ্বীপ। ভবনে বা এর কাঠামােতে বাগান স্থাপন করা হলে বাগানের গাছের পৃষ্ঠদেশ এ তাপ শুষে নেয় এবং গাছের দেহ থেকে যে পানি জলীয় বাষ্প আকারে প্রস্বেদন প্রক্রিয়ায় বেরিয়ে যায় তা সে নির্দিষ্ট স্থানের তাপমাত্রা কয়েক ডিগ্রি কমিয়ে আনে। অসংখ্য ছাদ কৃষি বা শহুরের গাছপালা এ প্রক্রিয়ায় শহরের উচ্চ তাপমাত্রাকে কমিয়ে আনে।
নির্মল পরিবেশের জন্য ছাদকৃষি: বাড়ির ছাদে বাগান শুধু শখের বিষয় নয়, পরিবেশ রক্ষায়ও রয়েছে এর বড় ভূমিকা। ছাদ কৃষি মাধ্যমে গ্রিনহাউজ প্রতিক্রিয়ার কবল থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, পরিবেশ দূষণমুক্ত থাকে, বায়ােডাইভারসিটি সংরক্ষণ করা যায়। এ ছাড়া তাজা শাকসবজি, ফলমূলের চাহিদাও মেটে। এসব কারণে বাড়ির ছাদ কৃষি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। অবশ্য ছাদের ওপর যেসব, বাগান দেখা যায় তার অধিকাংশই অপরিকল্পিত। পরিকল্পিতভাবে বাগান করা হলে এটি প্রাত্যহিক শাকসবজির চাহিদা মিটিয়ে পরিবেশ রক্ষায়ও দারুণ ভূমিকা রাখবে। 
উপসংহার: বিশ্বব্যাপী নগরায়ন বাড়ছে। ফলে শহুরে কৃষি নামক এক নতুন শব্দ আমাদের শব্দ ভাণ্ডারে যুক্ত হচ্ছে। এ কৃষির শুরুটা শৌখিন। ব্যাপক বাণিজ্যিক উৎপাদন অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সম্ভব না হলেও ধীরে ধীরে পারিবারিক পুষ্টি চাহিদা পূরণে এ খাত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কেবল বাংলাদেশেই নয়। বিশ্বের দেশে দেশে এর গুরুত্ব দিন দিন বাড়ছে। শহরাঞ্চলে ফুল, ফল ও সবজির পারিবারিক বাগান এখন আর কেবলই শৌখিনতা বা পারিবারিক প্রয়ােজন নয়, পরিবেশ সুরক্ষায় ছাদকৃষি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment