SkyIsTheLimit
Bookmark

মুক্তবাজার অর্থনীতি ও বাংলাদেশ রচনা

মুক্তবাজার অর্থনীতির সুফল ও কুফল
বা বাংলাদেশের শিল্প ও মুক্ত অর্থনীতি
ভূমিকা : মুক্তবাজার অর্থনীতি এ সময়ের বহুল আলােচিত বিষয়। বিষয়টি মূলত অর্থনীতির হলেও আলােচনা বা প্রতিক্রিয়া শুধু অর্থনীতির ভাবুক মহলেই সীমাবদ্ধ নেই, থাকার কথাও নয়। স্নায়ুযুদ্ধােত্তর পৃথিবীতে অর্থনৈতিক বিশ্ব ব্যবস্থায় মুক্তবাজার অর্থনীতির ধারণার প্রয়ােগ ও প্রাসঙ্গিকতার প্রশ্ন যখন উঠে তখন এ নিয়ে স্বল্প পরিসরে কিছু বলা প্রকৃতপক্ষেই দুরূহ। আর বাংলাদেশের মত একটি দেশের প্রেক্ষাপটে মুক্তবাজার ধারণার বিশ্লেষণ ও বাস্তবতা আজকের বাংলাদেশের অমােঘ হয়ে দাড়িয়েছে।
মুক্তবাজার অর্থনীতি কি? : 'মুক্ত মানে নিয়ন্ত্রণহীনতা, বাজার অর্থনীতি' মানেও স্বাভাবিক শক্তিগুলাের উপর নিয়ন্ত্রণহীনতা। এটি এমন একটি অর্থনৈতিক প্রক্রিয়া যা পণ্য বা সেবার দাম নির্ধারণের দায়িত্বটা বাজারের শক্তিসমূহ চাহিদা ও সরবরাহের হাতে ছেড়ে দেবার পক্ষপাতী। মুক্তবাজার অর্থনীতির তত্ত্বগত ভিত্তি হচ্ছে পূর্ণ প্রতিযােগিতামূলক বাজার। মুক্তবাজার অর্থনীতি কোন বাহ্যিক চাপ, সরকারি বা বেসরকারি কোন অখণ্ডিত হস্তক্ষেপ বা, নিয়ন্ত্রণ কিংবা স্বাভাবিক চাহিদা ও সরবরাহকে অগ্রাহ্য করে সৃষ্ট কোন কৃত্রিম প্রভাব মান্য করে না। এ অর্থনীতির অন্যতম পূর্বশর্ত হচ্ছে বক্রেতা বিক্রেতার সমঝােতা, পরস্পরের প্রতি আস্থা, পরিপূর্ণভাবে পণ্য উৎপাদন ও ব্যবসা করার সুযােগের নিশ্চয়তা। এ অর্থনীতি কোন অষ্বাভাবিকতা আরােপিত তত্ত্ব নয়। এটি একদিকে বাজার শক্তিসমূহের প্রতি নিরপেক্ষ মান্যতা, অন্যদিকে অর্থনীতিকে স্বাভাবিক গতির উপর ছেড়ে দেওয়ার একটি দৃষ্টিভঙ্গি। অতএব বলা যায় মুক্তবাজার অর্থনীতির প্রধান স্তম্ভ দুটি হয়।
১। পূর্ণ প্রতিযােগিতার স্বীকৃতি
২। ক্রেতা বা ভােক্তার সার্বভৌমত্ব । 
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট :
(i) সুবিধা : বাংলাদেশের অর্থনীতি দাতা দেশগুলাের উপর নির্ভরশীল। আমাদের অর্থনীতি যেন ঋণ নির্ভর অর্থনীতি। সারা পৃথিবী যখন অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির চরম সীমায় পৌছে যাচ্ছে আমরা সে মুহূর্তে এখনও অনেক সাজয়মান নীতির বেড়াজালে আবদ্ধ। SAPTA জাতীয় কিছু বাণিজ্যিক সংস্থার সৃষ্টি করে আমরা অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করলেও প্রকৃত ভিতরটি কারও কাছে অপরিষ্কার থাকার কথা নয়। যাই হােক মুক্তবাজার অর্থনীতির পূর্ণ অনুশীলন বাংলাদেশের জন্য কি সুবিধা বয়ে আনতে পারে তা আলােচনা করা হল- 
১। আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাগ শুরু করা সম্ভব হবে। 
২। জনসাধারণ অল্প ব্যয়ে বিভিন্ন দেশের দ্রব্য ক্রয় করতে পারবে। 
৩। উৎপাদনের উপকরণসমূহের বিশেষীকরণ সম্ভব হবে। ফলে উৎপাদনের উপাদানসমূহ যেমন-জমি, শ্রম, মূলধন, বৃদ্ধি পাবে সংগঠনের প্রকৃত আয় বাড়বে ‌।
৪। এ বাণিজ্যের ফলে সকল পক্ষই লাভবান হয়। ফলে অন্যান্য দেশের মত আমাদেরও উৎপাদন ও ভোগ বৃদ্ধি পাবে। 
৫। আন্তর্জাতিক শান্তি ও সহযােগিতার অংশীদার হওয়া যাবে।
৬‌। বিভিন্ন দেশের প্রযুক্তি জ্ঞান দ্বারা নিজেদের সমৃদ্ধি ঘটানাে সম্ভব হবে। 
৭। বিদেশীদের সাথে প্রতিযােগিতা করে দেশীয় উদ্যোক্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি পাবে। 
৮। ক্রেতা বিক্রেতার পূর্ণ স্বাধীনতার প্রতিযােগিতা নিষিদ্ধ হবে। 
(ii) অন্তরায়, বাস্তবতা ও সমাধান : এ অর্থনীতি অনুন্নত দেশে আপাতদৃষ্টিতে শিল্পায়নের পথে বাঁধার সৃষ্ট করে। অবাধ বাণিজ্যের সূযােগ নিয়ে শিল্পোন্নত দেশসমূহ অনুন্নত দেশের বাজার দখল করে। বাংলাদেশের মত দেশে সংরক্ষণ নীতির প্রয়ােজনের কথা তাই অনেকেই বলে। সংরক্ষণ নীতির স্বপক্ষে অন্যতম যুক্তি হলাে শিল্প যুক্তি। কিন্তু বিগত দুই দশকের অধিক সময়ের এ সংরক্ষণ নীতির সফলতা হয়ত বা দরিদ্র দেশের দরিদ্রতম হওয়ার প্রক্রিয়া ছাড়া অন্য কিছু নয়। রাষ্ট্রায়ত্ত্ব শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলাে কিছু পরিমাণ লােকসান দিয়ে এগুচ্ছে। ভর্তুকি প্রদান করে মওকুফ দিয়ে বাঙালি জাতিকে অলসই করে তােলা হয়েছে। অনেকে শ্রমিক সমস্যাকে এ বাজার অর্থনীতির একটি অন্তরায় হিসেবে দেখেন। 
(iii). প্রস্তাবনা ও গৃহীত পদক্ষেপ : ১। অর্থনৈতিক নীতির সংস্কার : লক্ষ্যমাত্রা : অর্থনৈতিক সংস্কারসমূহের চলতি বিষয়াবলির সর্বাগ্রে রয়েছে গতিশীল ও দক্ষ বেসরকারি উদ্যোগের বিকাশ সাধন। এর জন্য প্রয়ােজন সমতামূলক ব্যবসায়িক পরিবেশ সৃষ্টি করা যা উৎপাদনমুখী কর্মকাণ্ডে দক্ষতা ও প্রতিযােগিতাকে উৎসাহিত করে। 
অসমতামূলক পরিবেশ : এ পরিবেশ সৃষ্টির জন্য প্রয়ােজন, 
১। বেসরকারি সম্পত্তির অধিকারের ব্যাপারে একটি সুস্পষ্ট পদ্ধতি। 
২। চুক্তিসমূহ বাস্তবায়ন করার জন্য আইনের শাসন। 
৩। দক্ষ লােক প্রশাসন এবং  
৪। সেবাসমূহ ও বাজার তথ্যের পর্যাপ্ত অবকাঠামাে। 
সরকারি নীতি:  যেসব ক্ষেত্রে সরকার গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক নীতি গ্রহণ করবে সেগুলাে হচ্ছে, ক। শিল্প ও বাণিজ্যনীতি; খ। আর্থিক খাতের নীতিসমূহ গ। সরকারি উদ্যোগসমূহের পুণর্গঠন। 
ক। শিল্প ও বাণিজ্য নীতি : শিল্প ও বাণিজ্য নীতি সংস্থাসমূহের উদ্দেশ্য হচ্ছে এ খাতে বিকৃতিগুলাে ক্রয় করা। এগুলোর মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিকৃতি সৃষ্টি হয় বিনিময় হার। সংরক্ষণের মাত্রা এবং সেসব মূল্যের দ্বারা যা বাণিজ্য পরিবেশে উল্লেখযােগ্য ঝুঁকির সৃষ্টি করে। 
খ। আর্থিক খাতে নীতিসমূহ : এ খাতের সংস্কারের প্রধান লক্ষ্য হচ্ছে, আনুষ্ঠানিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমে দেশের সঞ্চয়ের প্রধান অংশকে সুনির্দিষ্টভাবে বিনিয়ােগ করে আর্থিক খাতকে দৃঢ়তর করা। এর জন্য প্রয়ােজন সুদের হার। উদাসীকরণ, ব্যাংকের ইতিবাচক ঋণ, সুদের হার অব্যাহত রাখা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তত্ত্বাবধান ক্ষমতা দৃঢ়তর করা, বৈদেশিক ব্যাংকসমূহ প্রতিষ্ঠানকে উৎসাহিত করে ব্যাংকিং প্রতিযােগিতা সৃষ্টিকরণ প্রভৃতি। 
গ। সরকারি খাতের উদ্যোগসমূহের পুনর্গঠন : বেসরকারি উদ্যোগে গতি সঞ্চারের কর্মসূচিতে সরকারি উদ্যোগসমূহের সংস্কার একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। 
২। অথনৈতিক সংস্কারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের চলতি অভিজ্ঞতা : সরকার বর্তমান বছরগুলোতে বেসরকার খাতকে বকত গুরুত্ব দিয়েছে। দেশী বিদেশী বেসরকারি বিনিয়ােগের উপর অনেক নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করা হয়েছে। বিদ্যুৎ ও টেলিফোন সংযােগসহ পূর্ব সংরক্ষিত কয়েকটি খাতকে বেসরকারি বিনিয়ােগের আওতাধীন করার চেষ্টা চলছে। বিদেশী বিনিয়ােগকারীদের জন্য বিনিয়ােগ উৎসাহ দেয়া হচ্ছে। শুল্ক, অতিশুঙ্ক ও বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উদাসীকরণ করা হয়েছে। ১৯৯৩ সালে বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণাধীন পণ্য সংযােগ যেখানে ছিল ২৫৩, ১৯৯৪ সালে তা নেমে আসে ৪০ এ! বৈদেশিক মুদ্রার উপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল করা হয়েছে। রপ্তানিকারকদের এখন তাদের অর্জিত ৫-১৫ শতাংশ রাখতে এবং টাকা এখন চলতি হিসেবে বিনিয়ােগযােগ্য করা হয়েছে। শ্রম সংগঠনসমূহর সংস্কারের উপায়ও চালানাে হচ্ছে। দেওয়া হয়। শিল্পসমূহ (সংশােধনী) ১৯৯০-তে শ্রম আদালতের বিরােধসমূহের দ্রুততর নিষ্পত্তির বিধান রাখা হয়েছে। বেসরকারি খাতের দক্ষ পরিচালনার জন্য ব্যাংকিং কোম্পানি ১৯৯৩ এবং ফিনানসিয়াল ইনস্টিটিউশন এ্যাকট ১৯৯৩ প্রবর্তন, কোম্পানি আইন (সংশােধনী) ১৯৯৩ পাশ, মূলধন বাজার উন্নয়নের জন্য সিকিউরিটি এ্যাকট এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি আরাে অনেক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ১৯৯৪ সালের ঘােষিত বেসরকারিকরণ নীতিতে বেসরকারিকরণের সার্বিক দায়িত্ব বেসরকারি বাের্ডের উপর ন্যস্ত হয়েছে। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ ৪৬টি U.S.U. বেসরকারির জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে। 
৩‌। সুপারিশসমূহ : মুক্তবাজার অর্থনীতির সর্বাধিক ফসল ঘরে তুলতে নিম্নোক্ত বিষয়গুলাের প্রতি সবিশেষ নজর দিতে হবে- 
১। বিনিয়ােগ বৃদ্ধি  
২। বাহ্যিক প্রতিযােগিতার মনােভাব বৃদ্ধি 
৩। সঞ্চয় একত্রকরণ
৪। বেসরকারি প্রক্রিয়া ত্বরান্বিতকরণ 
৫। আমলাতন্ত্রের সংস্কার 
৬। মানব মূলধনের উন্নয়ন 
৭। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা। 
উপসংহার : একথা সত্য যে, বাজার অর্থনীতির পথে যতটুকু সংস্কার আমরা সাধন করেছি, তার সিংহভাগই এসেছে বিশ্ব ব্যাংক ও আই, এম, এফ এর চাপে। সে যাই হােক একথা অনস্বীকার্য যে, আজ আর পেছনে ফিরে তাকাবার যেন অবকাশ নেই। বাজার অর্থনীতি আমাদের শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের জন্য এক অপূর্ব সুযােগ এনে দিয়েছে। আমরা আশা করব আরও অনেক অনেক শিল্পপতি ও ব্যবসায়ী এ অর্থনীতির সুযােগ নেবে।

লেখা-লেখি করতে ভালোবাসেন? লেখালেখির মাধ্যমে উপার্জন করতে যুক্ত হতে পারেন আমাদের সাথে Telegram এ!
Post a Comment

Post a Comment