মানুষ ও অরণ্য এক অপরের পরিপূরক: মানুষ ও প্রকৃতি পরস্পরের পরিপূরক। প্রকৃতি ছাড়া যেমন মানুষ বাঁচে না; তেমনি মানুষ ছাড়াও প্রকৃতিরও মূল্য নেই। এই যে পাহাড়, বন, শস্যখেত, নদী ও সমুদ্র নিয়ত মানুষের কল্যাণেই নিবেদিত। আমরা যখন পাহাড়ে যাই যেখানে অরণ্য শােভা বর্ধিত প্রকৃতিকে পাই। এই যে অরণ্যের সবুজ বৃক্ষরাজি, পাখপাখালি কী অপরূপ নৈসর্গিক সৌন্দর্য সৃষ্টি করে। তা সবই মানুষের মনােরঞ্জনের উদ্দেশ্যে। অরণ্যের সবুজ বৃক্ষ, পশু-প্রাণী, উদ্ভিদ সবকিছুই সৌন্দর্যের উপকরণ এগুলাে মানুষের মনকে পুলকিত ও প্রফুল্ল করে তােলে। তাই মনােরম পরিবেশের টানে মানুষ ছুটে চলে প্রকৃতির শােভার পিপাসায়।
অরণ্যের প্রয়ােজনীয়তা: মানুষের জন্মলগ্ন থেকেই অরণ্য প্রকৃত বন্ধুর মত পাশে থেকে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান যুগিয়েছে। নিঃশ্বাস নেওয়ার অক্সিজেন যােগান দিয়েছে। দূষণের আক্রমণ থেকে রক্ষা করেছে মানব সভ্যতাকে। মাটিকে আঁকড়ে রেখে ভূমিক্ষয় রােধ করেছে। বৃষ্টি নামিয়ে ধরিত্রীকে শস্য-শ্যামলা করেছে যে অরণ্য সেই অরণ্যের প্রতি মানুষের অবহেলার শেষ নেই। মানুষ গাছগাছালি কেটে ফাক করে দিচ্ছে। উচ্ছেদ হচ্ছে বন-বনানী। এই অপব্যবহারের ফলে মানুষ কে ভুগতেও হচ্ছে। প্রকৃতিতে নানা রকম পরিবর্তন ঘটছে। সময়ে বৃষ্টি হচ্ছে না। গরমে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়ে উঠছে। এক ফোটাবৃষ্টির জন্যে প্রাণিকুল হা হা করছে। বর্তমানে নানা রকম দূষণের কবলে মনুষ্য সমাজ জর্জরিত। এই সব কিছুর মূলে রয়েছে অরণ্যের অভাব।
অরণ্য শােভার জীবন্ত প্রতীক সুন্দরবন: সুন্দরবনের অরণ্য শােভা সবচেয়ে বেশি। সুন্দরী-গরান-গেউয়া প্রভৃতি গাছ। গভীর অরণ্য তীরে তীরে ঝুঁকে পড়ে সৃষ্টি করেছে অন্ধকার। কোথাও খালগুলাের দুপাশে গােলপাতা গাছের ঠাসাঠাসি সুড়ঙ্গ পথের প্রাচীরের মতাে দাঁড়িয়ে আছে। এই বন্যসৌন্দর্য একমাত্র সুন্দরবনের জন্য সংরক্ষিত। সেই বন্যসৌন্দর্য না দেখলে কল্পনা করা কঠিন। সেই শােভা দেখতে দেখতে কোনাে ত্রিমােহনা বা বাকের মুখে পৌছে দেখা যায় আরেক অপূর্ব দৃশ্য। দু'পাশে বিস্তৃত চড়া, চড়ার উপর সবুজ কেওড়া গাছের সুশ্রেণী, তার আড়ালে ঢেকে গেছে বন। গাছের ডাল ছুঁয়ে ছুটে যাচ্ছে সুন্দরবনের এই সৌন্দর্যের সম্মােহন সহজে ছিন্ন করা সম্ভব নয়। এই সৌন্দর্য একান্তই সুন্দরবনীয়।
মধুপুর অরণ্যের রূপ-বৈচিত্র: জীববৈচিত্র্যে ভরপুর বাংলাদেশের অন্যতম একটি জাতীয় উদ্যান মধুপুর। এ বনের প্রধান আকর্ষণ শালবন। এ বনের বাসিন্দা স্তন্যপায়ী প্রাণীদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলো মুখপোড়া হনুমান, চিত্রা হরিণ, মায়া হরিণ, লাল মুখ বানর, বন্য শুকর ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য। বনে দেখতে পাওয়া পাখিদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে স্ট্রক বিলড কিংফিশার বা মেঘ হু মাছরাঙ্গা, খয়রা গেছে পেঁচা, কাঠ ময়ূর, বন মােরগ, মুরগি। এ বনের মধ্যখানে লহরিয়া বন বিট কার্যালয়ের কাছে হরিণ প্রজনন কেন্দ্রে। আছে বেশ কিছু হরিণ। নানা গাছপালায় সমৃদ্ধ জাতীয় এ উদ্যান। এসবের মধ্যে উল্লেখযােগ্য হলাে শাল, বহেড়া, আমলকি, হলুদ, আমড়া, জিগা, ভাদি, অশ্বথ, বট, সর্পগন্ধা, শতমূলী, জায়না, বিধা, হারগােজা, বেহুলা ইত্যাদি। এ ছাড়া নানান প্রজাতির লতাগুল্ম আছে এ বনে। এ পথে বনের সৌন্দর্যও চোখ ধাঁধানাে । চারিদিকে শুধু সবুজ আর সবুজ। বনের ভেতরে এ পথে চলতে চলতে হঠাৎ দেখা হয়ে যেতে পারে কোনাে বন্যপ্রাণীর সঙ্গে।
সৌন্দর্যমন্ডিত ভাওয়াল উদ্যান: ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান হল বাংলাদেশের একটি অন্যতম সৌন্দর্যমন্ডিত এবং গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় উদ্যান। এটি বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ বনাঞ্চল গুলাের মধ্যে অন্যতম একটি। বাংলার বনাঞ্চলের জীবন্ত প্রতীক হয়ে দাড়িয়ে আছে এই উদ্যান। পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশের আদলে অভয়ারণ্যের ছাঁচে ভাওয়াল শালবনে এই উদ্যান গড়ে তােলা হয়। ভাওয়াল জাতীয় উদ্যান বিভিন্ন প্রকার প্রাণী দ্বারা সমৃদ্ধ। একসময় এ বনে বাঘ, চিতাবাঘ, মেঘাবাঘ, হাতি, ময়ূর, মায়া হরিণ ও সম্বর হরিণ দেখা যেত। এছাড়া ১৯৮৫ সালে এ বনে খেঁকশিযাল, বাগদাস, বেজী, কাঠবিড়ালী, গুইসাপ সহ আর কয়েক প্রজাতির সাপ দেখা যেত বলে জানা যায়। একটি পরিসংখান অনুযায়ী, ভাওয়াল গড়ে প্রায় ৬৪ প্রজাতির প্রাণী রয়েছে। অরণ্য শােভা বধিত এ ভাওয়াল উদ্যান।
রাতারগুল জলবন: দেশের একমাত্র এবং বিশ্বের অন্যতম জলাবনের নাম রাতারগুল। রাতারগুল একটি প্রাকৃতিক বন । এরপরেও বন বিভাগ হিজল, বরুণ, করচ আর মুতাসহ কিছু জলবান্ধব জাতের গাছ লাগিয়ে দেয় এ বনে। এ ছাড়াও রাতারগুলের গাছপালার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলাে কদম, জালিবেত, অর্জুনসহ জলসহিষ্ণু প্রায় ২৫ প্রজাতির গাছপালা। তাই তাে রাতারগুল সিলেট অঞ্চলের সুন্দরবন নামে খ্যাত। ভরা বর্ষায় স্থানীয় হস্তচালিত ডিঙি নৌকায় চড়ে রাতারগুল জলাবনে ঘুরে বেড়ানাের যায়। প্রতিদিন হাজারাে পর্যটকের আনাগােনায় মুখরিত এই পর্যটন কেন্দ্রে। এটি স্যেন্দর্যমণ্ডিত অভয় অরণ্য।
অপার সৌন্দর্যের পাহাড়ী অরণ্য: বাংলাদেশের অপার সৌন্দর্যের বিশাল ক্ষেত্র হচ্ছে পাহাড়ী বনভূমি। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, সিলেট, কক্সবাজার, কুমিল্লা সহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের পাহাড়গুলাে ঘন বনের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে আছে। এসব অরণ্যগুলাে মানুষকে প্রকৃতির সান্নিধ্যে যেতে হাতছানি দিয়ে যায়। ভ্রমণ ও প্রকৃতিপ্রেমী মানুষেরা দেশ-বিদেশ থেকে ছুটে আসে একটু নির্মল আনন্দ উপভােগ করতে।
অরণ্যের শােভা বিনষ্টের কারণ: মূলত অশিক্ষা, অজ্ঞতা জনসংখ্যার আধিক্যতা ও রাজনৈতিক দুবৃত্তায়নই বনভূমি ধ্বংসের অন্যতম কারণ। এছাড়া রয়েছে ভূমিদস্যুদের আগ্রাসন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন- ঘূর্ণিঝড়, বন্যা-জলােচ্ছাস তাে রয়েছেই। আমাদের দেশের বনভূমিগুলাের মধ্যে সর্ববৃহৎ বনভূমি হচ্ছে সুন্দরবন, শুধু আমাদের দেশেই নয় পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হচ্ছে সুন্দরবন। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং কাঠ পাচারকারীদের কারণে সৌন্দর্য হারাচ্ছে সুন্দরবন। এছাড়া বন দখল করে চলছে শুটকির কারবার এবং লােকসংখ্যার চাপে বনভূমি কেটে তৈরি হচ্ছে কৃষিজমি ও ঘরবাড়ি। পরিসংখ্যান মতে আমাদের মাথাপিছু বনভূমির পরিমাণ ০.০২২ হেক্টর। যা আজ থেকে চল্লিশ-পঁয়তাল্লিশ বছর আগে ছিল ০.০৩৫ ভাগ। ফারেস্টি মাস্টার প্ল্যান অনুযায়ী ১৯৮১-৯০ সাল পর্যন্ত মােট বনভূমি ধ্বংসের হার ৩.৩ শতাংশ। যা বর্তমানে আরও বেশি। সে হারে আমরা গাছ কেটে প্রাকৃতিক বিপর্যয় ডেকে আনছি তাতে গড়ে মাথাপিছু বনভূমি শূন্যের কোটায় আসতে খুব বেশিদিন সময় লাগবে না।অরণ্য রক্ষার উপায়: বাংলাদেশের পরিবেশ অনেকাংশে গাছের ওপর নির্ভরশীল। এখানে গাছ কাটা বা পাচার করা অবশ্যই রাষ্ট্রবিরােধী অপরাধ বলে বিবেচনা করা উচিত। দেশে প্রতিবছর বৃক্ষরােপণ অভিযান চলে এবং বৃক্ষমেলা হয়। এতে গাছের ব্যাপারে মানুষের আগ্রহ তৈরি হয়। মানুষ গাছ কেনে এবং লাগানাের উদ্যোগ নেয়। সরকারীভাবেও গাছ লাগিয়ে, বন সৃষ্টির উদ্যোগ নেয়া হয় যা প্রশংসনীয়। যদিও যে হারে বন ধ্বংস হয়েছে তার ক্ষতিপূরণ করা কঠিন সেজন্য বৃক্ষরােপণ খুব বেশি জরুরী। বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনগুলােকে সক্রিয় করে তােলা উচিত বৃক্ষরােপণের ব্যাপারে। পাচারকারীদের হাত থেকে বন রক্ষা এবং চুরি যাতে না হয় সে ব্যাপারে নিশ্চয়তা প্রদান করা বিশেষভাবে জুরুরী। উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনীর প্রতি আমাদের জোর দেয়া উচিত। সবচেয়ে বড়। কথা আমাদের নিজেদের আরও সচেতন হয়ে বৃক্ষরােপণ এবং এর লালনের ব্যাপারে বিশেষভাবে যত্নবান হতে হবে, তা না হলে সরকারের হাজার চেষ্টা ব্যর্থতে পরিণত হবে। নিজেদের প্রয়ােজনেই নিজেদের সচেতনতা তৈরি জরুরী।
উপসংহার: অরণ্য মানুষকে পরিশুদ্ধ করে। প্রকৃতিতে সুন্দর ও মনােরম করে অরণ্য একটি নিষ্কলুষ পরিবেশ তৈরি করে। অগণিত বৃক্ষ, গুল্ম, লতা- পাতা, উদ্ভিদ-প্রাণীর সমন্বয়ে এক একটি অরণ্য যেন নৈস্বর্গিক সৌন্দর্যের পসরা বসায়। কিন্তু মানুষ সে সৌন্দর্যকে ধ্বংস করছে। তারা এখনাে বৃক্ষনিধন কর্ম থেকে বিরত হয়নি। এখনােও অকাতরে নিজের সুখের প্রয়ােজনে বহু মূল্যবান গাছ-গাছালি কেটে ফেলছে। এটা বন্ধ করতে হবে। মানুষকে বুঝতে হবে গাছ আমাদের পরম বন্ধু। আমাদের বেঁচে থাকার জন্য আমরা একান্তভাবেই গাছের উপর নির্ভরশীল। একটি গাছ মানে একটি প্রাণ আর বৃক্ষ হত্যা মানেই নিজেকে হত্যা এই উপলব্ধি দরকার।
Post a Comment