জাতীয় শিক্ষানীতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস: ১৯৭৪ সালে সর্বপ্রথম 'কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল। এটিসহ ইতােপূর্বে ছয়টি শিক্ষা কমিশন/কমিটি গঠিত হয়েছে এবং প্রতিবেদন তৈরি হয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতি-২০১০ প্রণয়নের লক্ষ্যে প্রথমে একটি শিক্ষা সংস্কার কমিটি (২০০২), এরপর একটি নয়া জাতীয় শিক্ষা কমিশন (২০০৩) গঠন করা হয়। এ কমিটি ও কমিশনও প্রতিবেদন জমা দেয়। সবশেষে একটি যুগােপযােগী বিজ্ঞানসম্মত ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় সমৃদ্ধ শিক্ষানীতি প্রণয়নের লক্ষ্যে ৬-ই এপ্রিল ২০০৯ সালে জাতীয় অধ্যাপক কবীর চৌধুরীকে চেয়ারম্যান করে নতুন একটি কমিটি গঠিত হয়।
জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণয়ন প্রসঙ্গ: ২০০৯ সালে সরকারের শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় শিক্ষানীতি ২০০৯ (চূড়ান্ত খসড়া) প্রকাশিত হয়। কবীর চৌধুরীর নেতৃত্বে গঠিত এ শিক্ষা কমিশন মূলত বিশেষজ্ঞ ১৯৭৪ সালে প্রণীত 'কুদরত-ই-খুদা শিক্ষা কমিশন’-এ প্রতিবেদনের আলােকে ও বাস্তবতার নিরিখে একটি উপযুক্ত শিক্ষানীতি প্রণয়ন করার চেষ্টা করেন। সদস্যগণ তাঁদের এ নীতি প্রণয়নে সভায় প্রাপ্ত সকল মতামত বিবেচনায় নেওয়া হয়। কমিটির মতামত ও অভিজ্ঞতার আলােকে এ নীতি প্রণয়নে অবদান রাখেন। খসড়া তৈরি এবং পরিমার্জন করার দায়িত্ব পালন করেন কাজী খলীকুজ্জামান আহমদ, মুহম্মদ জাফর ইকবাল ও শেখ ইকরামুল কবির। এ শিক্ষানীতিকে ২৯টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত করা হয়েছে। নতুন এ শিক্ষানীতিতে মােট ৩০টি বিষয় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
শিক্ষানীতির চূড়ান্ত খসড়ায় পরিবর্তন ও শিক্ষানীতির বিরােধিতা প্রসঙ্গ: ২০০৯ সালের সেপ্টেম্বরে যে চূড়ান্ত খসড়া প্রকাশিত হয় তাতে শিক্ষানীতিকে ধর্মনিরপেক্ষ হিসেবে ঘােষণা করা হয়। এ কারণে শুরু থেকে ধর্মীয় রাজনৈতিক সংগঠনগুলাে এর বিরােধিতা করে আসছিল। তাদের মতে, বাংলাদেশের বর্তমান সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার উল্লেখ নেই। এ বিরোধিতার কারণে সরকার শিক্ষানীতিকে সর্বজনগ্রাহ্য করার অভিপ্রায়ে স্থিতিস্থাপক দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় দিয়েছে। ফলে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষানীতির পরিবর্তে অসাম্প্রদায়িক চেতনাসমৃদ্ধ শিক্ষানীতির প্রবর্তন করা হয়েছে। নতুনভাবে সন্নিবেশিত ৩০টি বিষয়ের মধ্যে রয়েছে শিক্ষায় পিছিয়ে পড়া এলাকাগুলাের জন্যে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া, বাংলা ভাষা শুদ্ধ ও ভালােভাবে শিক্ষা দেওয়া নিশ্চিত করা, সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মাঠ, খেলাধুলা ও শরীরচর্চার প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা, শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য সচেতন করতে বিভিন্ন ব্যবস্থা ও মাদকজাতীয় দ্রব্যের বিপদ সম্পর্কে শিক্ষার্থীদের সতর্ক ও সচেতন করা।
নতুন জাতীয় শিক্ষানীতির কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক: নতুন জাতীয় শিক্ষানীতি বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। শিক্ষার আধুনিকায়নের ফলে আমাদের দেশের শিক্ষাপদ্ধতি হবে বিজ্ঞানসম্মত এবং জীবন সম্পর্কিত যা আধুনিক বিশ্বের শিক্ষার মূলনীতিকে ধারণ করবে। শিক্ষাব্যবস্থায় বড় ধরনের পরিবর্তনগুলাে হলাে-
১. প্রাক-প্রাথমিক ও প্রাথমিক শিক্ষা: শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছে, পাঁচ বছরের বেশি বয়সী শিশুদের জন্যে এক বছর মেয়াদি প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা চালু করাসহ প্রয়ােজনীয় পদ সৃষ্টি করা হবে। আদিবাসী শিশুরা যাতে তাদের নিজেদের ভাষা শিখতে পারে, সে লক্ষ্যে আদিবাসী শিক্ষক ও পাঠ্যপুস্তকের ব্যবস্থা করা হবে। প্রাথমিক শিক্ষা হবে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এবং তা অবৈতনিক, সর্বজনীন ও বাধ্যতামূলক। পঞ্ম শ্রেণির ফলাফলের ওপর বৃত্তির ব্যবস্থা থাকবে। সব শিক্ষার্থীর জন্যে নিজ নিজ ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা থাকবে।
২. মাধ্যমিক শিক্ষা: মাধ্যমিক শিক্ষার স্তর হবে নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত। মাধ্যমিক শিক্ষাস্তরে সাধারণ, মাদ্রাসা ও বৃত্তিমূলক শিক্ষাধারায় বাংলা, ইংরেজি, গণিত, তথ্যপ্রযুক্তি ও বাংলাদেশ স্টাডিজ শিক্ষায় অভিন্ন শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যসূচি অনুসরণ করা হবে। দশম শ্রেণি শেষে সমাপণী পরীক্ষা উপজেলা/পৌরসভা/থানা পর্যায়ে অভিন্ন প্রশ্নপত্রের মাধ্যমে অনুষ্ঠিত হবে। এ পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে বৃত্তি দেওয়া হবে।
৩. উচ্চশিক্ষা: তিন বছর মেয়াদি ডিগ্রি কোর্সকে পর্যায়ক্রমে সংশ্লিষ্ট সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে চার বছর মেয়াদি সম্মান কোর্সে রূপান্তর করা হবে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষক নির্বাচন এবং তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য বেসরকারি শিক্ষক কমিশন গঠন করা হবে। জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় বিকেন্দ্রীকরণের লক্ষ্যে বিভাগীয় সদরে এর কেন্দ্র স্থাপন করা হবে। পরে এই কেন্দ্রগুলোকে নিজ নিজ এলাকায় অনুমােদনকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে রূপান্তর করা হবে।
৪. বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা: অষ্টম শ্রেণি শেষে প্রাথমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীরা ইচ্ছা করলে বৃত্তিমূলক শিক্ষায় প্রবেশ করতে পারবে। বৃত্তিমূলক ও কারিগরি শিক্ষা সম্প্রসারণের লক্ষ্যে প্রতিটি উপজেলায় একটি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপন করা হবে। এ ছাড়া পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, টেক্সটাইল ইনস্টিটিউট ও লেদার ইনস্টিটিউটের সংখ্যা বাড়ানাে হবে।
৫. 'ও' এবং 'এ' লেভেলে বাংলা পড়াতে হবে: মাধ্যমিক স্তরের তিন ধারা অর্থাৎ সাধারণ, মাদ্রাসা ও কারিগরি শিক্ষা ধারায় বাংলা, ইংরেজি, গণিত, তথ্যপ্রযুক্তি ও বাংলাদেশ স্টাডিজসহ ছয়টি মৌলিক বিষয়ে অভিন্ন পাঠ্যসূচি বাধ্যতামূলক করার সুপারিশ করছে শিক্ষানীতি প্রণয়ন কমিটি। অনুমােদিত নীতিতে বলা হয়, 'ও' এবং 'এ' লেভেলে বাংলা এবং বাংলাদেশ স্টাডিজ পাঠ্যসূচিতে যুক্ত করতে হবে। এ দুটি বিষয় পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা সাপেক্ষে ও' লেভেলকে এসএসসি এবং 'এ' লেভেলকে এইচএসসির সমমান বিবেচনা করতে হবে।
এ ছাড়াও মাদ্রাসা শিক্ষার সংস্কার, ধর্ম ও নৈতিক শিক্ষার গুরুত্ব, কওমি মাদ্রাসা প্রসঙ্গ ইত্যাদি বিষয়েও সুনির্দিষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে। অনুমােদিত শিক্ষানীতি অনুযায়ী ফাজিল (সম্মান) কোর্স চার বছর এবং কামিল কোর্স এক বছর নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে। তা ছাড়া ইবতেদায়ি আট এবং দাখিল চার বছর নির্ধারণ করা হয়েছে।
শিক্ষানীতির বিশেষ কয়েকটি দিক: এ শিক্ষানীতিতে কয়েকটি বিষয়কে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এগুলাে হলাে— ১. তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষা, ২. প্রকৌশল শিক্ষা, ৩. চিকিৎসা সেবা ও স্বাস্থ্য শিক্ষা, ৪. বিজ্ঞান শিক্ষা, ৫. কৃষি শিক্ষা, ৬. নারীশিক্ষা, ৭. আইন শিক্ষা, ৮. ললিতকলা শিক্ষা, ৯. বিশেষ শিক্ষা, ১০. স্বাস্থ্য ও শারীরিক শিক্ষা, ১১. স্কাউট ও গার্লস গাইড ও ব্রতচারী এবং ১২. ক্রীড়া শিক্ষা। তথ্যপ্রযুক্তির এ যুগে তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষাকে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। শিক্ষার একেবারে প্রাথমিক স্তর থেকে উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত সকল ছাত্র-ছাত্রীকে কম্পিউটার ব্যবহারে দক্ষ হিসেবে গড়ে তােলার কথা বলা হয়েছে এ নীতিতে। এ ছাড়া বলা হয়েছে মাধ্যমিক পর্যায়ে বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র-ছাত্রীদের বিজ্ঞান ও গণিতের কোনাে মূল বিষয় পরিত্যাগ না করেই কম্পিউটার বিজ্ঞান বিষয় নিয়ে পড়াশােনার সুযোগ করে দিতে হবে।
স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক শিক্ষানীতি: জাতীয় শিক্ষানীতি প্রণীত হয়েছে সর্বস্তরে ব্যাপক আলােচনার ভিত্তিতে। সরকারি ওয়েবসাইট ও সেমিনার- সিম্পােজিয়ামের মাধ্যমে ব্যাপকসংখ্যক মানুষের মতামত ও পরামর্শ নেওয়া হয়েছে। মন্ত্রিসভার বৈঠকে জাতীয় শিক্ষানীতি চূড়ান্ত অনুমােদনকালে যথাসম্ভব সেসব পরামর্শ আমলে নেওয়া হয়েছে। খসড়া প্রতিবেদনে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা থাকলেও চূড়ান্ত প্রতিবেদনে সেই শব্দ পরিহার করে অসাম্প্রদায়িক চেতনা পুনঃস্থাপন করা হয়েছে। এ সিদ্ধান্তকে যেমন জবাবদিহিমূলক, তেমনই জাতীয় মতৈক্য প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা বলা যায় ।
উপসংহার: ভালাে নীতি হওয়াই যথেষ্ট নয়, কত দিনে ও কতটা সুচারুভাবে তা বাস্তবায়িত হয়, সেটাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। অতীতে অনেক ভালাে নীতি দেশ ও জনগণের কল্যাণে আসেনি নানারকম সীমাবদ্ধতার কারণে। শিক্ষানীতি বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া হতে হবে স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক। যেকোনাে রকম সংকীর্ণতা ও সীমাবদ্ধতা যেন এ মহৎ উদ্যোগকে থামিয়ে দিতে না পারে, সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
Post a Comment