বা বন্যা ও ত্রাণ তৎপরতা
বা বাংলাদেশে সাম্প্রতিক বন্যা
বা ২০০৪ সালের বন্যা
ভূমিকা : বন্যা বাংলাদেশের একটি নিত্যনৈমিত্তিক গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতি বছরই বাংলাদেশে বন্যা হয়। বাংলাদেশ একটি নিচু এলাকার দেশ। বর্ষাকালে এদেশের নদীগুলাে পানিতে কানায় কানায় ভরে যায়। মাঝে মাঝে মুষলধারে বৃষ্টি হয় এবং পানি বিপদ সীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। একেই বন্যা বলা হয়। এতে মানুষের বাড়িঘর ভেসে যায়। মানুষের দুঃখ কষ্টের সীমা থাকে না। অনেক মানুষ রেল লাইনের পাশে থাকে। এমনকি গাছের ডালে মাচা বেঁধে বাস করে। বন্যার কারণ : বন্যার অনেক কারণ রয়েছে। অতিমাত্রায় বৃষ্টিপাত বন্যার প্রধান কারণ। অনেক সময় মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ার ফলে নদীতে অত্যধিক পানি জমে। নদী সব পানি ধারণ করতে পারে না। তাই নদীর তীর প্লাবিত হয়ে যায় এবং আশে পাশের এলাকা পানির নিচে ডুবে যায়। এভাবেই বন্যা সংঘটিত হয়। অনেক সময় সামুদ্রিক ঝড়ের কারণে বন্যার সৃষ্টি হয়। আবার অনেক সময় ভূমিকম্প এবং আগ্নেয়গিরির লাভা নির্গমনের কারণে বন্যা হতে পারে। এছাড়া ভারতের উত্তরে যেসব পাহাড় আছে, অতিবৃষ্টি হওয়ার জন্য সে পাহাড় হতে যেসব ঢল নামে, সে পানি বাংলাদেশের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়। ফলে অতিরিক্ত পানি নদীর কূল ছাপিয়ে উঠে এবং বন্যার সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশে বন্যার আরেকটি কারণ হল নদীর তলা ভরাট হয়ে যাওয়া। যার ফলে নদীগুলাে বর্ষাকালে বেশি পানি ধারণ ক্ষমতা হারিয়ে বন্যার সৃষ্টি করে। সাইক্লোন, জলােচ্ছাস ও পাহাড়ের বরফ গলেও বন্যা হয়।
বন্যার ধ্বংসলীলা : বন্যা বিরাট ধ্বংসলীলা সাধন করে থাকে। এটা আমাদের জীবন ও সম্পত্তির অনেক ক্ষতি করে। গ্রাম, শহর সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। রাস্তাঘাট ও বাড়িঘর পানির নিচে তলিয়ে যায়। গাছপালা মূলসহ উঠে যায়। এটা আমাদের ফসল ভাসিয়ে নেয় এবং লােকজনদের গৃহহীন করে। তারা স্কুল, কলেজ, রাস্তা এবং বৃক্ষের উপর আশ্রয় নেয়। জনগণ বিশুদ্ধ পানির অভাবে কষ্ট পায়।
বন্যার পরবর্তী ফলাফল : বন্যার পরবর্তী ফল ভয়াবহ। জনগণ খাদ্য, বিশুদ্ধ খাবার পানি, আশ্রয় এবং ওষুধের অভাব তীব্রভাবে অনুভব করে। কলেরা, টাইফয়েড এবং আমাশয়ের মত সংক্রামক রােগগুলাে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়ে। নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যের মূল্য বৃদ্ধি পায় এবং বন্যা কবলিত লােকেরা তা ক্রয় করতে পারে না।
সুফল : বন্যার একটি ভালাে দিকও আছে। বন্যার পানি পলি বহন করে আনে এবং মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি করে ফলে আমাদের কৃষি জমিতে অধিক ফসল উৎপাদিত হয়। বন্যার পানি নােংরা জিনিস ভাসিয়ে নিয়ে যায় এবং আশপাশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন ও স্বাস্থ্যকর রাখতে সহায়তা করে।
বিভিন্ন সময়ে বাংলাদেশের বন্যার খতিয়ান : বাংলাদেশে বাংলা ১২৮৩ সনে এক ভয়াবহ বন্যা হয়। এরপরও বাংলাদেশে অনেক বন্যা হয়েছে তবে তা এত মারাত্মক ক্ষতি করেনি। পরবর্তীতে উল্লেখযোগ্য বন্যা হয় ১৯৫৪ এবং ১৯৫৫ সনে। এর পরবর্তী বন্যা হয় ১৯৫৮ সনে। ১৯৭০ সনের ঘূর্ণিবার্তা ও প্লাবনকে খণ্ড প্রলয় হিসেবে অভিহিত করা যায়। এরপর ভয়াবহ বন্যা হয় ১৯৭৪ ও ১৯৮৭ সালে। সে বন্যার ঘা শুকাতে না শুকাতেই পরবর্তীকালে মারাত্মক বন্যা হয় ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালের শতাব্দীর উল্লেখযােগ্য ভয়াবহ বন্যা প্রায় তিন মাসব্যাপী স্থায়ী রূপ নেয়।
২০০৪ সালের বন্যা : আবহমান বাংলার ইতিহাস পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায় যে, ১৯৭৪, '৮৮ কিংবা ৯৮ সালের ভয়াবহ বন্যাকেও হার মানাল ২০০৪ সালের সর্বনাশা বন্যা। এ বন্যার করাল গ্রাসের স্বীকার হয় বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল। তার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত বা দুর্বিসহ ও ভয়াবহতার রূপধারণ করে সিলেট, শরীয়তপুর, বগুড়া, ঝিনাইদহ, ময়মনসিংহ, নরসিংদী, নারায়ণগঞ্জ, সিরাজগঞ্জ প্রভৃতি জেলাসমূহ।। এসব জেলার হাজার হাজার একর জমির ফসল, গবাদিপশু, ঘরবাড়িসহ মানুষকে হারাতে হয় তাদের দু'বেলা দুমুঠো খাবার। সুতরাং, এককথায় বলা চলে বিভিন্ন বছরে বাংলার মাটিতে মনে হয় যেন প্রকৃতির এ সর্বনাশা খেলার তাণ্ডব তারই মনের এক অবগাহন।
সরকারি ও বেসরকারি সাহায্য : বন্যায় দুর্গতদের সাহায্যের জন্য সরকারের তরফ হতে অনেক চেষ্টা করা হয়। সরকার বন্যা বিধ্বস্ত এলাকায় খাদ্যদ্রব্য, পরিধেয় বস্ত্র, আর্থিক সাহায্য দান করে বিপদাপন্ন লােকদের অশেষ উপকার সাধন করে। ঐসব এলাকার সাহায্যের জন্য নানা দেশের মেডিক্যাল মিশন, বাংলাদেশ মেডিক্যাল মিশন, রেডক্রস মিশন গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ে। এছাড়া সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলাে হতে ঔষধ ও ইনজেকশন বিতরণ করা হয়। ভ্রাম্যমাণ হাসপাতাল স্থাপন করা হয়। বিশ্ববিদ্যালয়, কুল কলেজের ছাত্রছাত্রীরা এ সময় সাহায্যের জন্য বিশেষ চেষ্টা করে।
বন্যা প্রতিরােধের ব্যবস্থা : বন্যার করাল গ্রাস থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য নিম্নলিখিত কর্মসূচি গ্রহণ করা যেতে পারে। যথা :
(১) দেশের নদীসমূহের উভয় তীরে বেডি বাঁধ নির্মাণ করলে নিচ এলাকার শস্যকে ধ্বংস থেকে রক্ষা করা যাবে। বেড়ি বাধগুলােতে প্রচুর পরিমাণে গাছপালা লাগাতে হবে, যাতে করে বন্যার ধাক্কা বেড়ি বাঁধগুলাে সহ্য করতে পারে।
(২)ড্রেজার দিয়ে নদীগুলাের নাব্যরূপ বৃদ্ধি করতে হবে এবং চরগুলাে কেটে দিতে হবে যাতে করে বন্যার পানি দ্রুত সাগরে নেমে যেতে পারে।
(৩)বাংলাদেশের নদীগুলাের উৎপত্তিস্থল নেপাল এবং ভারত বিধায় সার্ক অন্তর্ভুক্ত দেশ হিসেবে বাংলাদেশ ভারত ও নেপালের মধ্যে ত্রিপাক্ষিক ব্যবস্থার সম্মিলিতভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণে এগিয়ে আসতে হবে।
(৪) বন্যার পানিকে খরার মৌসুমে ধরে রাখার জন্যে বিভিন্ন স্থানে 'জলাধার নির্মাণ করা যেতে পারে। এতে একদিকে যেমন বন্যার ভােগান্তি থেকে আমরা রক্ষা পাব, অন্যদিকে খরা মৌসুমে ঐ পানি আমাদের শস্য উৎপাদনের কাজে লাগবে।
উপসংহার : বন্যা একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগ। এ দুর্যোগ প্রতিরােধের জন্য পৃথিবীর অন্যান্য উন্নত দেশে যে সব ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়েছে আমাদেরও সেরূপ করা দরকার। আমাদের দেশের সরকারের উচিত দেশের বন্যা প্রতিরােধের জন্য উন্নততর ব্যবস্থা গ্রহণ করা। যে কোন মূল্যে আমাদের বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের পন্থা অবলম্বন করতে হবে।
Post a Comment