ভূমিকা: সভ্যতার উষালগ্নে মানুষ যেদিন মাটিতে বীজ বুনে ফল ও ফসল ফলাতে শুরু করল, সেদিন থেকেই ফসল ফলানাের কাজে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ব্যবহার শুরু হয়েছিল। উন্নত দেশসহ উন্নয়নশীল প্রতিটি দেশে কৃষি অন্যতম প্রধান শিল্প। উন্নত দেশের বিজ্ঞানভিত্তিক বৃষিব্যবস্থা বিশ্বের সব দেশেই কম-বেশি প্রসারিত হয়েছে। বাংলাদেশও তার থেকে ভিন্ন নয়। বাংলাদেশ মানেই গ্রাম-বাংলা, পল্লিবাংলা, মাটি ও মানুষের বাংলা। সেই অর্থেই গােটা বাংলাদেশ কৃষিক্ষেত্র। বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকটাই কৃষিনির্ভর। কৃষি আমাদের প্রাণ, কৃষি আমাদের ধ্যান-জ্ঞান ও সাধনা। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ কৃষিপ্রধান দেশ হিসেবে সুপরিচিত।
কৃষিকাজের গুরুত্ব: মানবজীবনে কৃষির ভূমিকা অপরিসীম। এ পৃথিবীতে কৃষিকাজ দিয়েই মানুষ তার কর্মজীবনের সূত্রপাত করেছিল। কৃষির ওপর নির্ভর করেই মানবজীবনের ধারা এখনও বয়ে চলেছে এবং চলবে। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেরই অর্থনীতির প্রধান উৎস কৃষি এবং তাদের জাতীয় উন্নয়নও কৃষির ওপর নির্ভরশীল। মানবজাতির জন্যে তাই কৃষির গুরুত্ব বিবেচনা করে বিজ্ঞানীরা অনবরত গবেষণার মাধ্যমে কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করছেন।
আমাদের দেশের কৃষক ও কৃষি: আমাদের দেশের অর্থনীতি কৃষিনির্ভর। দেশের শতকরা ৮০ ভাগ লােকই কৃষিজীবী। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, উন্নত দেশগুলােতে কৃষিকাজের সঙ্গে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠলেও আমাদের দেশে এ ব্যাপারে তেমন কোনাে অগ্রগতি সাধিত হয়নি। এখনও প্রাচীন আমলের মতাে কৃষকেরা কৃষিকাজের জন্যে জীর্ণ-শীর্ণ গরু আর লাঙল ব্যবহার করছে। কৃষকদের অবস্থাও শােচনীয়। কৃষিকাজের জন্যে তারা প্রয়ােজনীয় মূলধন যােগাতে পারে না। তারা নিরক্ষর তাই উন্নত ও আধুনিক কৃষিব্যবস্থা প্রবর্তনের উপযােগী জ্ঞান ও অর্থ তাদের নেই। ফলে আমাদের কৃষিব্যবস্থা ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার সঙ্গে সংগতি রাখতে ব্যর্থ হচ্ছে। বিবর্তনের সিড়ি বেয়ে গােটা বিশ্ব আজ অপ্রতিহত গতিতে ধেয়ে চলেছে উন্নয়নের স্বর্ণ-শিখরের পানে। দিনবদলের পালায় বাংলার কৃষক আর কৃষি আজও সেই তিমিরেই ঘুরপাক খাচ্ছে। যুগ-তরঙ্গ তাদের মাঝে কোনাে আলােড়ন সৃষ্টি করতে পারেনি। তাই আজও বাংলার কৃষক প্রকৃতির খেয়াল-খুশির খেলনা হয়ে ধুঁকে ধুঁকে মরছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এদেশের হতভাগ্য অসহায় কৃষকের ইতিবৃত্তে বলেছেন, ওই যে দাঁড়ায় নত শির মূক সবে, স্নানমুখে লেখা শুধু শত শতাব্দীর বেদনার করুণ কাহিনি, স্কন্ধে যত চাপ তার বহি চলে মন্থরগতি যতক্ষণ থাকে প্রাণ তার।
কৃষিকাজে বিজ্ঞান: একবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে বিশ্ব ও বিশ্ববাসীর কোনাে কাজেই বিজ্ঞানের অনুপস্থিতি নেই। বিজ্ঞানের জয়যাত্রা আজ সর্বত্র অব্যাহত। বিজ্ঞানের বদৌলতে অন্ধকার ধরণী আজ আলােকাভায় পােল। বিজ্ঞানের বদৌলতেই আজ উষর মরু হয়েছে সরস ও উর্বর, দুর্গম পাহাড়ের উপত্যকা ও অধিত্যকা এসেছে চাষের আওতায়। নদী পেয়েছে নতুন গতি, শুকনাে ক্ষেতে চলছে জল-সিঞ্ন। জগৎ ও জীবনের কর্মপ্রবাহের প্রতিটি স্তরে বিজ্ঞান তার অবদানের সাক্ষর রেখে চলেছে। কৃষিবিজ্ঞানীরা বর্তমান শতাব্দীতে কৃষিকাজে বিজ্ঞানের ব্যবহারকে সাফল্যজনক পর্যায়ে নিয়ে এসেছেন। অল্প জমিতে অধিক ফসল উৎপাদনের প্রয়াসে নিবিড় চাষের জন্যে যান্ত্রিক সরঞ্জামের আবিষ্কার কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লবের সূচনা করেছে। ট্রাক্টর ও পাওয়ার-টিলারের সঙ্গে আরও নানা ধরনের যান্ত্রিক সরঞ্জাম ও যন্ত্রপাতির আবিষ্কার মানুষ ও পশুশ্রমকে মুক্তি দিয়েছে। গােবর সার, কম্পােস্ট সার ও সবুজ সারের স্থলে রাসায়নিক সার; যেমন- ইউরিয়া, টিএসপি, এসএসপি ইত্যাদির আবিষ্কারের ফলে একর প্রতি উৎপাদন দ্বিগুণের ওপরে চলে গেছে। একই সঙ্গে উল্লেখ করা যায়, বিভিন্ন ফসলের ক্ষেত্রে উচ্চ ফলনশীল বীজ আবিষ্কারের কথা। ফিলিপাইনের আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্রে ইরি ধান আবিষ্কৃত হয়। এরপর বাংলাদেশের ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট ইরি-৮ নামক উচ্চ ফলনশীল ধান আবিষ্কার করে এদেশের কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করে। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা আবশ্যক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নােবেল পুরস্কার বিজয়ী বিজ্ঞানী নর্মান বেরলগের মাক্সিপাক ও অন্যান্য জাতের উচ্চ ফলনশীল গম আবিষ্কার করে কৃষিতে বিজ্ঞানের এক মহতী উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। কৃষিকাজে বিজ্ঞানের প্রয়ােগজনিত সাফল্য শুধু ধান ও গমের ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নয়। বিজ্ঞানের এ সাফল্য প্রায় সকল ধরনের ফল- ফলারি ও কৃষিপণ্যের ক্ষেত্রেই সাধিত হয়েছে। কৃষিকাজে বিজ্ঞানের প্রয়ােগের মাধ্যমে পােকা-মাকড় দমন ও নির্মূল করার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের প্রয়ােগ ঘটেছে অন্য সকল ক্ষেত্রের মতােই। নানা ধরনের পােকার আক্রমণ থেকে শস্যকে রক্ষার জন্যে ইনসেকটিসাইড বা পােকা দমনকারী বহু রাসায়নিক দ্রব্য আবিষ্কৃত হয়েছে। এর মধ্যে এন্ড্রিন, ডায়াজিন, ক্লোর ছাড়াও রয়েছে অনেক পােকা ধ্বংসকারী ওষুধ।
বিভিন্ন দেশের কৃষিকাজে বিজ্ঞান: বর্তমানে উন্নত দেশগুলোতে কৃষিকাজ সম্পূর্ণভাবে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। জমি কর্ষণ থেকে শুরু করে বীজ বপন, ফসলের আগাছা পরিষ্কার, সেচকার্য, ফসল কাটা, মাড়াই করা ইত্যাদি সবক্ষেত্রেই তারা যন্ত্রপাতি ব্যবহার করছে। অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি তাদের কৃষিকাজে এখন আর অন্তরায় হয় না। শীতপ্রধান দেশে শীত নিয়ন্ত্রিত ঘর অর্থাৎ গ্রিন হাউজ তৈরি করে সেখানে শাক-সবজি, ফল-মূল উৎপন্ন করা হচ্ছে। প্রযুক্তির সহায়তায় মরুভূমির মতাে জায়গাতেও সেচের ব্যবস্থা করে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় ফসল ফলানাে হচ্ছে। ফলে দেখা যায়, কৃষিকার্যে বিজ্ঞান এক যুগান্তকারী বিপ্লব এনে দিয়েছে ।
আমাদের দেশে কৃষিকাজে বিজ্ঞান: উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে কৃষিকাজে বিজ্ঞানের ব্যাপক ব্যবহার আমাদের দেশে সম্ভব হচ্ছে না। তবে সীমিত আকারে আমাদের কৃষিতে বিজ্ঞানের ব্যবহার লক্ষ করা যাচ্ছে এবং কৃষিব্যবস্থার উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে। তবে প্রয়ােজনের তুলনায় তা অনেক কম। জমির খণ্ড-বিখণ্ডতার কারণে জমি কর্ষণে এখনও অনেক জায়গায় ট্রাক্টর ব্যবহার সম্ভব হচ্ছে না। সেচকার্যের জন্যে গভীর নলকূপ ও মেশিন চালিত পাম্প ব্যবহৃত হচ্ছে। বীজ সংরক্ষণে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ও উৎপাদনের মাত্রা বাড়াতে সার ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশে ইতােমধ্যে স্বল্পমাত্রায় হলেও কৃষির উন্নতি সাধিত হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে আরও উদ্যোগ গ্রহণের প্রয়ােজন রয়েছে।
দৃষ্টান্ত: বিস্ফোরণােন্মুখ জনসংখ্যার ভারে বাংলাদেশ আজ ন্যুজ। জনসংখ্যার গুরুভার সৃষ্টি করেছে প্রকট খাদ্য সমস্যা। আমাদের কৃষির প্রচলিত প্রাচীন পদ্ধতি জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সমতা বজায় রেখে কৃষিক্ষেত্রে ফসল উৎপাদন করতে পারছে না। আমাদের মাটির তুলনায় জাপানের মাটির স্বাভাবিক উৎপাদনক্ষমতা এক চতুর্থাংশ। অথচ তারা কৃষিক্ষেত্রে বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে আমাদের চেয়ে অধিক ফসল ফলিয়ে খাদ্য সমস্যার সমাধান করতে পেরেছে। যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিপাইন, চীন, কোরিয়াসহ বিভিন্ন দেশের কৃষিকে আমরা এক্ষেত্রে অনুসরণ করতে পারি।
আমাদের কৃষক এবং আধুনিক শিক্ষা ও প্রযুক্তি: আমাদের কৃষক সম্প্রদায় এখনও অনেক জায়গায় জমি চাষের জন্যে গবাদিপশু চালিত লাঙল ব্যবহার করে। এ ব্যবস্থা যেমনি কষ্টকর তেমনি সময়সাধ্য। এ কাজে আমরা ট্রাক্টর ব্যবহার করে অল্প সময়ে অধিক জমিতে চাষাবাদ করতে পারি কৃষিজমির মান অনুযায়ী রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ওষুধ ব্যবহার করে ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি করা যেতে পারে । উন্নত দেশসমূহের মতাে আমরাও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে অধিক উৎপাদন করে আমাদের খাদ্য সমস্যার সমাধান করতে পারি। বলতে গেলে মানুষের মৌলিক চাহিদার সবটাই যােগান দেয় কৃষি। তাই কৃষিকে অবহেলা করে বেিচে থাকা যেমন সম্ভব নয়, তেমনি দেশ ও জাতির সামগ্রিক কল্যাণসাধনও অসম্ভব। আশার কথা, এদিকে লক্ষ রেখেই সরকার কৃষিক্ষেত্রে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে সচেতন হয়ে উঠছে। কৃষিব্যবস্থার সামগ্রিক কল্যাণের স্বার্থে এদেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কৃষি কলেজ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কৃষিকে মাধ্যমিক স্তর থেকে পাঠ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় কৃষি সম্প্রসারণের ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে।
উপসংহার: পর্যাপ্ত মূলধন, কাঁচামাল ও খনিজ সম্পদের অভাবহেতু বাংলাদেশের শিল্পায়নের সম্ভাবনা সুদূর পরাহত। তাই আমাদের জাতীয় উন্নয়ন বহুলাংশে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। আর একমাত্র বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির মাধ্যমেই কৃষিক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে আমরা পরনির্ভরশীলতার অভিশাপ থেকে পরিত্রাণ পেতে পারি।
Post a Comment