নৈতিক শিক্ষা কী : ন্যায়পরায়ণতা, সত্যবাদিতা, প্রতিশ্রুতি রক্ষার মনােভাব, সাধুতা ইত্যাদি মহৎ গুণের সমন্বয়কে আমরা এককথায় নৈতিকতা বলতে পারি। আর এ সব গুণের শিক্ষালাভ করাই হচ্ছে নৈতিক শিক্ষা।
নৈতিক মূল্যবােধ কী : নৈতিক মূল্যবােধ হলাে নীতি-আদর্শ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত জীবন ব্যবস্থার অভিব্যক্তি। মানুষের জীবন সকল প্রকার অন্যায়, অবিচার, অনাচার ও স্বার্থপরতার সংকীর্ণতা থেকে মুক্ত থাকবে। আর এমন হলেই আমরা ধরে নেব সেখানে নৈতিক মূল্যবােধ আছে। সকল প্রকার দুর্নীতিমুক্ত জীবনই আদর্শ বা নৈতিক মূল্যবােধসম্পন্ন জীবন। নৈতিক মূল্যবােধের ফল হচ্ছে মানবিক গুণে গুণান্বিত চরিত্র।
নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবােধ কেন প্রয়ােজন : নৈতিকতা ও মূল্যবােধ না থাকলে মানুষের জীবন বিপথে পরিচালিত হয় এবং ধ্বংস হয়ে যায়। আমরা কেউ কখনও চাই না যে নৈতিকতা ও মূল্যবােধের অভাবে আমাদের জীবন নষ্ট হয়ে যাক। আমাদের জীবনকে সৎ সুন্দর মহৎ ও আনন্দময় করে তুলতে নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবােধ একান্তই প্রয়ােজন। যার মধ্যে নৈতিকতা ও মূল্যবােধের অভাব রয়েছে সেই অন্যায় পথে চলে। তাই অন্যায় পথ রােধ করার জন্যই নৈতিক শিক্ষা লাভ করতে হবে। নৈতিকতা ও মূল্যবোেধই হলাে সত্য ও সুন্দরের একমাত্র পথ। মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে যেমন নৈতিকতা ও মূল্যবােধের গুরুত্ব রয়েছে তেমনই ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও। তাই আদর্শ, মহৎ সৎ ও সুন্দর জীবনযাপনের জন্য নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবােধের প্রয়ােজনীয়তা অনস্বীকার্য।
নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবােধের সম্পর্ক : নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবােধ একে অপরের সাথে অঙ্গাঙ্গিভাবে সম্পর্কযুক্ত। ন্যায়-অন্যায়ের মধ্যে পার্থক্য সৃষ্টি করা যায় মূল্যবােধের মাধ্যমে। অপরদিকে নৈতিকতাও ন্যায়- অন্যায়ের মধ্যে ব্যবধান সৃষ্টি করে। নৈতিকতা ও মূল্যবােধের সকল প্রকার কার্যাবলি বিবেচনা করে দেখা যায় যে, নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবােধ নিবিড়ভাবে সম্পর্কযুক্ত।
নৈতিকতা ও মূল্যবােধের গুণাবলি : প্রেম-প্রীতি, স্নেহ-মমতা, দয়া, দান, সহানুভূতি ইত্যাদি মানব হৃদয়ের স্বভাবিক গুণ। নৈতিকতা ও মূল্যবােধের মাধ্যমে এ সব গুণের বিকাশ ঘটে থাকে। মানুষের জীবনে শান্তি ও সমৃদ্ধির প্রথম সােপান হলাে নৈতিকতা ও মূল্যবােধ। আর এ সােপান প্রশস্ত হয় পারিবারিক, সুশিক্ষা, সৎ সংসর্গ, হিতৈষী শিক্ষক ও গুরুজনের উপদেশের মাধ্যমে।
নৈতিকতা ও মূল্যবােধের সামাজিক মূল্য : নৈতিকতার সামাজিক মূল্য অপরিসীম। আজকের পৃথিবীর মানুষ সত্যকে বাদ দিয়ে মিথ্যাকে জীবনের সাথে আঁকড়ে ধরেছে। বর্তমান বিশ্বসমাজে ন্যায়, সত্য সুন্দরের বড়ই অভাব, অভাব-অনটন, দরিদ্র-ক্লিষ্ট মানুষকে মিথ্যাচারী ও অসৎ প্রবণ করে তুলেছে। অসত্যের মধ্য থেকে মানুষ জীবনের সুখ-শান্তি হারিয়ে ফেলেছে। সমাজজীবনে মানুষ খুঁজে খুঁজেও শান্তির দেখা পাচ্ছে না। শান্তিহীন সমাজে মানবজীবন হাঁপিয়ে উঠেছে। তাই সমাজ থেকে অন্যায়- অবিচার দূর করে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য নৈতিকতা ও মূল্যবােধের গুরুত্ব সর্বাধিক।
নৈতিকতা ও মূল্যবােধ অর্জনে ধর্মের ভূমিকা : এই পৃথিবীতে অনেক ধর্ম রয়েছে। প্রতিটি ধর্মেই নৈতিকতা ও মূল্যবােধের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে সমানভাবে। কোনাে ধর্মেই নৈতিকতার বিরুদ্ধে কথা বলা হয়নি। তাই বলা যায়, নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবােধের ওপর ধর্মের ভূমিকা অনস্বীকার্য।
নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবােধের উপযােগিতা : মানবজীবনে নৈতিকতা একটি অপরিহার্য গুণ। জীবনকে সুখী ও সমৃদ্ধ করতে হলে অবশ্যই নৈতিকতার মাধুর্যে উকৰ্ষমণ্ডিত করতে হবে। তা হলে জীবন হবে সুন্দর ও শান্তিময়। অন্যায় ও অসদুপায়ের মধ্যে যতই শক্তি থাকুক না কেন তার মধ্যে সবসময় একটা অশান্তি বিরাজ করে। সত্য ও ন্যায়ের পথ সবসময় উজ্জ্বল থাকে। আর অসত্য সবসময় পরাজয়ের গ্লানি বয়ে চলে। সেজন্য সবসময় নৈতিকতার অনুশীলন করতে হবে এবং জীবনে নৈতিকতা ও মূল্যবােধের প্রতিফলন ঘটিয়ে যথার্থ মনুষ্যত্বের অধিকারী হতে হবে।
নৈতিকতা ও মূল্যবােধের গুরুত্ব : মানবজীবনকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য নৈতিকতা ও মূল্যবােধের গুরুত্ব অপরিসীম। জীবনের অগ্রগতিকে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য নৈতিকতা ও মূল্যবােধ রক্ষার বিকল্প নেই। নৈতিকতাবােধ সম্পূর্ণ ব্যক্তি সবসময় সামনে এগিয়ে যায়। তার গতিকে অনৈতিকতা দ্বারা রােধ করা সম্ভব হয় না। যে সমাজের মানুষের মধ্যে নৈতিকতা ও মূল্যবােধ রয়েছে তাদের সমাজ জীবনে অসীম শান্তিও রয়েছে। তাই ব্যক্তিজীবনে ও সমাজজীবনে শান্তির জন্য নৈতিকতাও মূল্যবােধের গুরুত্ব অপরিসীম।
নৈতিক, মূল্যবােধ ও আমাদের বর্তমান : বর্তমান প্রেক্ষাপটে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় দুর্নীতির অনুপ্রবেশ ঘটায় নৈতিকতা ও মূল্যবােধের অবক্ষয় ঘটেছে। জীবনের সর্বস্তরে এখন দুর্নীতি রাজত্ব করে চলেছে। বর্তমান সমাজের মানুষ এখন অন্যায়কে অন্যায় বলে বিবেচনা করে না। অন্যায় যেন মানবসমাজে মিশে একাকার হয়ে আছে। দুর্নীতিগ্রস্ত মানুষ আজ সম্পদের পাহাড় গড়েছে। আর ন্যায়বান মানুষ ভুগছে অনাহারে। মনে হয় সমাজে অন্যায়ের প্রতিযােগিতা চলছে। বর্তমান যুগে দুর্নীতি মানুষের মধ্যে রােগের মতাে ছড়িয়ে সমাজদেহকে জর্জরিত করে ফেলেছে। সমাজ এখন দুর্নীতি রােগে রুগণ।
নৈতিক মূল্যবােধের অবক্ষয়ের কারণ : জাতীয় জীবনের সামগ্রিক পরিবেশের সঙ্গে মূল্যবােধের অবক্ষয়ের কারণ সম্পৃক্ত। নৈতিক মূল্যবােধের অবক্ষয়ের কারণ হচ্ছে দুর্নীতির ব্যাপক প্রসার। অর্থনৈতিক অভাবও এর একটি অন্যতম কারণ বলে বিবেচ্য। দারিদ্র্যসীমার ছায়ায় দেশে অধিকাংশ লােক বসবাস করছে। কেউ দু মুঠো খেতে পারছে, কেউ বা না খেয়ে দিন কাটাচ্ছে। আবার কেউ রােদে পুড়ছে, বৃষ্টিতে ভিজছে। তাছাড়া বেকারত্ব সমস্যা যুবসমাজে নৈতিক মূল্যবােধের। অবক্ষয় ঘটাচ্ছে। চারপাশে সন্ত্রাসের প্রবণতা বাড়ছে। অভাব অনটনকে মােকাবেলা করার জন্য অনেকে দুর্নীতিপরায়ণ হয়ে যাচ্ছে।
অনৈতিকতা ও মূল্যবােধহীনতার পরিণাম : বর্তমান সমাজ জীবনে নৈতিক মূল্যবােধগুলাের যে অবক্ষয় দেখা যাচ্ছে তার পরিণামে সমাজ আজ চরম নীতিবােধহীনতায় ভুগছে। আর নীতিহীনতার কারণে সমাজে লেগে আছে অশান্তির পর অশান্তি। নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে সমাজ আজ অবৈধ কার্যকলাপে পরিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মারামারি ছিনতাই, রাহাজানি যেন বর্তমান সমাজের নিত্যসঙ্গী।
অনৈতিকতা ও মূল্যবােধহীনতা রােধের উপায় : সমাজজীবন থেকে অনৈতিকতা ও মূল্যবােধহীনতা অবশ্যই রােধ করতে হবে। সমাজের সকল প্রকার অন্যায়-অবিচারের অবসান ঘটাতে হবে। অন্যায়কারীর জন্য কঠোর শান্তির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশাসনিক কাজে নীতিবােধ জাগিয়ে তুলতে হবে। জনগণের মধ্যে দেশাত্মবােধ জাগাতে হবে। তবেই অনৈতিকতা ও মূল্যবােধহীনতা রােধ করা যাবে।
উপসংহার : পৃথিবীর সকল মহামানব এই পৃথিবীতে নিজেদের স্থান করে নিয়েছেন আপন চরিত্রবলে। তারা নৈতিকতা দিয়ে অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। জীবনকে সুখী, সমৃদ্ধ ও সার্থক করতে নৈতিকতার গুরুত্ব অপরিসীম। নৈতিকতা ও মূল্যবােধ ছাড়া কখনো জীবন শান্তিময় হয় না। নৈতিক মূল্যবােধের অভাবের কারণে মানবসমাজে আজ চরম দুর্দশা। জাতি আজ হয়ে পড়ছে দিশেহারা। তাই জাতিকে সুপথে চালিত করতে, ব্যক্তিজীবনে সুখ-শান্তি ফিরিয়ে আনতে নৈতিক শিক্ষা ও মূল্যবােধ অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ।
Post a Comment